ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

করোনাক্রান্ত মায়ের প্রতি সন্তানের অসীম ভালোবাসা

রুমী সুলতানা

প্রকাশিত : ১৪:১৭, ৮ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৪:২১, ৮ জুন ২০২০

বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে এখন গোটা বিশ্ব। মরণঘাতী এ ভাইরাসটির মরণ ছোবলে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় চার লাখ মানুষ। বাংলাদেশেও মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছুঁই ছুঁই। ভাইরাসটির ভয়ে যেখানে হাজারো সন্তান তাদের বাবা-মাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যায়, কোনো খোঁজ খবর নেয় না, কেউ কেউ বাসায় থেকে ফোনে খোঁজ নেয় কিন্তু কাছে আসে না, এমন খবরও শুনেছি যে, মাকে সন্তানেরা জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে। 

এমন প্রতিকূল মুহূর্তেও মায়ের প্রতি এক সন্তানের ভালোবাসা দেখে সত্যিই অভিভূত হলাম। এখনো অনেক সন্তান আছে যারা সুশিক্ষিত আর সঠিক আদর্শে উজ্জীবীত।

ঘটনাটি হচ্ছে- মায়ের করোনা ভাইরাসের লক্ষণ থাকলেও ছেলেটির কোনো লক্ষণ ছিলো না। কিন্তু ছেলেটি তার মাকে এতো বেশি ভালোবাসে যে, মাকে রেখে গেইটের বাহিরে থাকতেও নারাজ। কিন্তু হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষের উপস্থিতিতে অন্য মহিলা রোগীরা অস্বস্তি অনুভব করে। তার মায়ের কাছে সে সন্তান, কিন্তু অন্য মহিলাদের কাছে সে পরপুরুষ, তাই তাদের খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। 

যাইহোক, অনেক কষ্ট করে সে একটা শেয়ার কেবিন ব্যবস্থা করে। যেখানে আরও দুই জন রোগী আছে। প্রথম দিন সে মায়ের পাশে বসে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়। দ্বিতীয় দিন সে ডাক্তার, নার্স সবাইকে অনুরোধ করে বলে যে, আমাকে একটু ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করে দেন, আমিও একটু জ্বর, কাশি অনুভব করছি। দরকার হলে আমি মায়ের বিছানার পাশে ফ্লোরে থাকবো তবু মায়ের কাছেই থাকতে চাই। 

তার কথা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলো। তাকে সহায়তা না করে কেউ পারলো না। অতঃপর ছেলেটিকে ভর্তি করে বিছানার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। এতো সুন্দর করে কথা বলা, ভদ্র আচরণ করা, মায়ের জন্য সর্বক্ষণ কান্না করা, সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

আসলে, প্রতিটা সন্তানেরই উচিত, বাবা-মাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসা। বাবা-মায়ের জন্যে প্রার্থনা করা। ছোটবেলায় বাবা-মা আমাদেরকে যেভাবে লালন পালন করেছেন, সেভাবেই তাদেরকেও যত্ন করা উচিত। বাবা মায়ের ভালোবাসাই একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।

সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক (বামপাশে)।

অথচ, আমরা প্রতিনিয়তই যেন কিছু একটার পিছনে ছুটে চলেছি। যাদেরকে জীবনে সবচেয়ে বেশি আপন মানুষ মনে করি, আসলে তারা আমাদের কতটা আপন? জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় যদি সেই মানুষগুলো পাশে না থাকে, তাহলে তাদের কথা ভেবে জীবনের সুখগুলো আমরা কেন বিসর্জন দেই। মৃত্যুর সময় সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলো কাছে থাকে না। যন্ত্রণায় ছটফট করার সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো প্রিয়জনকেই মানুষটা খুঁজে পায়নি। ডাক্তার-নার্স ছাড়া কাউকে দেখতে পায়না। আমি জানিনা এই যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ।

মধ্য বয়সী এক বাবা যখন বলেন, আমার ছেলেটাকে একটু ডেকে দিবেন? শত খুঁজেও পাওয়া যায় না। ভর্তি ফর্মে নাম্বার দিয়ে কল দিলে ছেলে যখন বলে- হাসপাতালে আমাদের কেউ ভর্তি নেই, আপনি ভুল করছেন। এই কথাগুলো বাবা শুনে কতটা কষ্ট পান আমি জানিনা।

বৃদ্ধ বয়সে, অনেক টাকা পয়সা থাকা সত্ত্বেও যখন কোনো কাজে আসে না, ছেলেমেয়েরা সবাই দেশের বাইরে থাকে, তাকে সেবা করার মতো কেউ থাকে না। একজন ড্রাইভারের অত্যাচার, খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে হয়, তখন সেই মানুষটার কতটা কষ্ট হয় আমি জানিনা।

এক ভাইকে যখন আইসিইউতে নেয়ার মতো অবস্থা হয়, তখন পরিবারকে ফোন দিয়ে জানালে যদি অন্য ভাই বলে যে- আপনাদের কাছে রেখে আসছি, আপনারা যা খুশি তাই করেন। তখন সে ভাইটি মারা গেলে তার কতটা কষ্ট হয় আমি আমি জানিনা। স্ত্রী এবং ছোট সন্তানকে হাসপাতালে ফেলে রেখে স্বামী যখন চলে যায়, ফোন বন্ধ করে রাখে, তখন ওই স্ত্রীর কতটা কষ্ট হলে অঝোরে কাঁদে আমি জানিনা।

বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এক ছোট ছেলে আর একটা ছোট ভাইকে নিয়ে যখন বলে, আমাদেরকে কেউ দেখতে আসেনা, কোনো আত্মীয় স্বজনরা আমাদের খোঁজ নেয় না, আমি এই ছোট্ট ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে কিভাবে থাকবো! তখন অনুভূতি কতটা কষ্টের হয় আমি জানিনা। আবার, একসাথে বাবা-ছেলে ভর্তি হয়, ছেলেটা স্বাস্থ্যকর্মী। তার মাধ্যমে হয়তো বাবা আক্রান্ত হয়, বাবা মারা গেলে ছেলেটা নিজেকে কতটা অপরাধী মনে করে আমি জানিনা।

এভাবে সারাদিন লিখলেও শেষ হবে না...। আমরা যারা স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত, কতটা কষ্ট করতে হচ্ছে, পরিবার, ছোট ছোট বাচ্চা, সবাইকে দূরে রেখে, কাজ করতে হচ্ছে। এক একটা ডিউটি কতটা কষ্টের, সাধারণ মানুষ বুঝবেনা। দিনশেষে রাতের ঘুমটাও ভালো হয়না, ঘুমের মধ্যেও দেখি রোগী খারাপ হয়ে মারা যাচ্ছে। জানিনা, কবে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবো। কবে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবো।

আসলে, এই পৃথিবীতে কেউ কারোর নয়, সময়ের প্রয়োজনে, সামাজিকতা রক্ষার জন্য, মানুষ একটা বন্ধনে জড়িয়ে আছে, আর কিছু না। করোনা ভাইরাস তাই আপনজনদের খুব ভালো করে চেনার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। ভালো থাকুক আপনজন, ভালো থাকুন সবাই।

লেখক- সিনিয়র স্টাফ নার্স, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি