ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

কিলোগ্রাম বদলাচ্ছে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:০১, ১৫ নভেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৪:০৯, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

আধুনিকতার কাছে আগামীকাল শুক্রবার আত্মসমর্পণ করবেন সেই ফরাসি সম্রাট। রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে নির্বাসনে যাবেন তিনি। এখনও প্যারিসের অদূরে সেভার নামে এক জায়গায় মাটির নিচে ভল্টে রুশ পুতুলের মতো একের পর এক কাচের গোলকে শয়ান তিনি। এমনই সুরক্ষা যে, এক-একটা ওই গোলকের চাবি এক-এক জনের হাতে। নাহ্‌, চুরির ভয়ে নয়। পাছে চার পাশের আঁচ এক ফোঁটাও গায়ে লাগে, তাই। সম্রাটের নাম? ল্য গ্রঁদ কে। তিনি আসলে প্লাটিনাম এবং ইরিডিয়াম ধাতুতে তৈরি একখানি সিলিন্ডার। হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত তিনিই এক কিলোগ্রাম বাটখারা। যার যমজ ভাই সাক্ষী রেখে আপনি আলু-পটল কেনেন।

ফ্রান্সের ভার্সেই শহরে গত মঙ্গলবার শুরু হয়েছে মাপজোক বিজ্ঞানীদের ২৬তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। শেষ দিন, আগামীকাল শুক্রবার দুপুরে ভোটাভুটিতে বাতিল হবে ওই কিলোগ্রাম বাটখারা। বদলে বিজ্ঞানীরা আহ্বান জানাবেন নতুন এক কিলোগ্রামকে। যা হবে না মানুষের তৈরি কোনও বস্তুপিণ্ড। মানুষের হাত মানেই তো ভুলচুক! নতুন কিলোগ্রামে থাকবে প্রকৃতির ছোঁয়া। তাই বিজ্ঞানের চোখে তা হবে নিখুঁত। নাহ্‌, ঘাবড়াবেন না বিজ্ঞানীদের এই বায়নাক্কায়। পরশু সকালে বাজারে মাছওয়ালা যে-বাটখারায় মাপবেন রুই-কাতলা, কাল রাতে তা পাল্টাবে না। কিলোগ্রাম বাটখারার ওই ভোলবদল নেহাতই নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হওয়ার দিকে বিজ্ঞানীদের সাধনা। আর, কে না-জানে বিজ্ঞান সততই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরের দিকে ধাবমান।

মাপজোক সভ্যতার শুরু থেকে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর মূলে বেচাকেনা, যা বিনা জীবন অচল। পৃথিবীর সব জায়গায় মাপজোকের এই সমতা ফরাসি বিপ্লবের অবদান। রক্তক্ষয়ী ওই অভ্যুত্থানের আশীর্বাদ মেট্রিক মাপজোক। প্লাটিনামের তৈরি একটা দণ্ড হল মিটার, আর একটা পিণ্ড হল কিলোগ্রাম। ৯০ বছর পরে যে বার তৈরি হল আইফেল টাওয়ার, তার পরে মাপজোক বিজ্ঞানীদের প্রথম সম্মেলনে এল নতুন কিলোগ্রাম। লন্ডনে তৈরির পরে প্লাটিনাম-ইরিডিয়ামের ওই সিলিন্ডার পাঠানো হল প্যারিসে। সে দিন থেকে এখনও পর্যন্ত ওটিই এক কিলোগ্রাম বাটখারা (ল্য গ্রঁদ কে)। দেশে দেশে যার অনুকরণে তৈরি হয়েছে অনুরূপ বাটখারা।

এই ব্যবস্থায় বিজ্ঞানীরা মোটেই খুশি নন। সঙ্গত কারণে। কয়েক দশক অন্তর চাবি খুলে ল্য গ্রঁদ কে-কে বাইরে এনে দেখা গিয়েছে, তার ওজন কমছে। কত? এক মিলিগ্রামের হাজার ভাগের কয়েক ভাগ। মোছামুছিতে মানুষের আঙুলের ছোঁয়ায় খসছে ল্য গ্রঁদ কে-র কিছু পরমাণু। এমন সাবধানে তাকে নাড়াচাড়া করতে হয় যে, রক্ষণাবেক্ষণ যারা করেন, এর সামনে তাদের হাঁচিকাশিও বারণ। এসব সত্ত্বেও তিলে তিলে ওজন কমছে ল্য গ্রঁদ কে-র। মূলের যদি এই হাল, তা হলে নকলদের কী হবে?

বিজ্ঞানীরা সমাধানের কথা ভেবেছেন দীর্ঘদিন ধরে। মানুষের তৈরি বস্তুর বদলে প্রকৃতির আশ্রয় নেওয়া যাক। প্রকৃতি নিখুঁত, তাই তার সাহায্যে মাপজোক হবে ত্রুটিহীন। মাপ তো শুধু ওজনের নয়, দৈর্ঘ্যের, সময়ের, আরও নানা বিষয়ের। সেকেন্ড কি মাপা হবে দিন-ঘণ্টা-মিনিটের ভগ্নাংশে?

তার বদলে এসেছে বিশেষ পরমাণু থেকে জ্যোতি বেরোনোর হিসাব কষে। তেমনই মিটার। জানা আছে, আলো শূন্য মাধ্যমে দৌড়য় এক সেকেন্ডে ২৯৯, ৭৯২, ৪৫৮ মিটার। তাহলে মিটারের মাপও হোক আলো এক সেকেন্ডের ২৯৯, ৭৯২, ৪৫৮ ভাগের এক ভাগে যতটা দৌড়য়, ততটা।

এভাবেই কিলোগ্রামের নতুন মাপ ঠিক হচ্ছে প্রকৃতির সাহায্য নিয়ে। এ ব্যাপারে পথ দেখাচ্ছেন প্রয়াত নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী মাক্স প্লাঙ্ক। তার নামাঙ্কিত একটা ধ্রুবক বিজ্ঞানে হিসাবনিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। যার নাম ‘প্লাঙ্ক’স কনস্ট্যান্ট’। প্লাঙ্ক ওই ধ্রুবকে পৌঁছেছিলেন আলোর এনার্জি আর কম্পাঙ্কের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে। এই সম্পর্কে মানুষের কোনও হাত নেই। তা নেহাতই প্রকৃতির দান। এবং সেই সূত্রে অজর-অমর। ‘প্লাঙ্ক-স কনস্ট্যান্ট’-এর মান ০.০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,৬৬২,৬০৭,

০১৫ কিলোগ্রাম বর্গমিটার/সেকেন্ড। যেহেতু ওই মানের মধ্যে কিলোগ্রাম জিনিসটা লুকিয়ে, তাই ‘প্লাঙ্ক-স কনস্ট্যান্ট’ থেকে কিলোগ্রামের নিখুঁত মাপ পাওয়া যায়।

শুধু কিলোগ্রাম নয়, অ্যাম্পিয়ার (বিদ্যুতের পরিমাণ), কেলভিন (তাপমাত্রা) এবং মোল (পদার্থের পরিমাণ) এই তিন এককেও বদল আসবে শুক্রবার ভার্সেইয়ের সম্মেলনে। তবে কিনা ও-সব আগেই সূক্ষ্মতর হয়েছে প্রকৃতির আশীর্বাদে। এবার শুধু নিখুঁতের মান বাড়ানোর পালা। শুধু কিলোগ্রামই এত দিন পড়েছিল মানুষের অবদান হিসেবে। এবার তার পালাবদল।

কিলোগ্রাম বদলানোর উদ্যোগ সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছেন আমেরিকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির বিজ্ঞানী স্টিফেন স্খলামিঙ্গার। তার মতে, ‘ভিন্‌ গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হলে ওরা আমাদের জিজ্ঞাসা করবে, আমরা জিনিসপত্র মাপি কী করে? যদি বলি, আমাদের হাতে তৈরি জিনিসের তুলনায় মাপামাপি করি, তাহলে ওরা আমাদের ভাববে বোকা। এত দিনে আমরা চালাক হচ্ছি।’

সূত্র: আনন্দবাজার

একে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি