ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪

ঝর্ণার ডায়েরিঃ চিরায়ত নারী অবদমনের একটি প্রতিবিম্ব

বাপ্পী রহমান 

প্রকাশিত : ১৫:৫৯, ২২ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ১৬:২১, ২২ এপ্রিল ২০২১

গণমানুষের শেষ ভরসা গণমাধ্যম। তত্ত্বের বয়ানও তেমন-গণমাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রধান সহায়ক। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমকে যেভাবে প্রভাবিত করছে সেটি বেশ লক্ষণীয়। হেফাজতে ইসলাম নেতা মামুনুল হক ‘কুপোকাত’ হয়েছিলেন ফেসবুকের কারনে। মূলত ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওর মাধ্যমে দেখা গেছে এক নারীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়্যাল রিসোর্টে অবকাশ যাপনের সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন হেফাজতে ইসলাম নেতা মামুনুল হক। অবশ্য তিনি দাবি করেছেন, ওই নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তবে ঘটনার বেশ কয়েকটি অডিও-ভিডিও ফাঁস হওয়ার কারণে প্রকাশ্যে এসেছে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের অনৈতিক কর্ম। 

অন্যদিকে আষাঢ়ে গল্পের প্লট বানাতে পটু  মামুনুল ‘মানবিক বিয়ে’ প্রপঞ্চ আবিষ্কার করে তৌহিদী জনতাকে প্রায় রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছিলেন। এমনও দাবী ছিল ‘স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে, স্ত্রীকে খুশি করতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে কোনো সত্যকে গোপন করারও অবকাশ রয়েছে।’ তবে তার গল্পের অসারতাও প্রমাণিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে রিসোর্টের ঘটনার পর থেকেই সঙ্গে থাকা নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে আসা মাওলানা মামুনুল হক তৃতীয় বিয়েরও দাবি করেছেন। এক বছর আগে গাজীপুরের কাপাসিয়ার বাসিন্দা এক নারীকে তিনি বিয়ে করেন বলে ওই নারীর ভাইকে জানান।  

আমরা মামুনুলের বিয়ের সংখ্যা গুনতে বসিনি। মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী একজন পুরুষ একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারেন। বাধ সেধেছে পদ্ধতিতে। গণমাধ্যম থেকে জেনেছি গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত মামুনুল হক বলেছেন, তিনি পরের দুইজনকে বিয়ে করেননি। তবে দুই জন স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে মামুনুলের চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছে, মামুনুল হক তাদের বিয়ে করবেন না। স্ত্রীর মর্যাদাও দেবেন না। তবে তাদের ভরণপোষণ দেবেন। এই শর্তে যে, তিনি স্ত্রীর মতো করে তাদের সঙ্গে মিশবেন। যেখানে যেতে বলবেন, সেখানে যেতে হবে এবং তার সঙ্গে রাত্রিযাপন করতে হবে। মামুনুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিয়ে না করে কারো সঙ্গে চুক্তি করে থাকা যায় কি-না? জবাবে মামুনুল হক বলেছেন, এই শরীয়ত সম্মত। তিনি স্ত্রীর মর্যাদা না দিলেও তাদের ভরণপোষণ দিচ্ছেন। তার বিনিময়ে তারা তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। এটা ইসলামের বিধিবিধানের মধ্যেই তিনি করেছেন বলে দাবি করেছেন। ব্যাস, হয়ে গেল! না, হয়নি! ইসলাম বিবাহ-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককেই অনুমোদন দেয়নি। কোরআনের বেশ কয়েকটি জায়গায় জিনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোরআন মুসলিমদের জিনায় লিপ্ত না হওয়ার আদেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআন বলছে,‘তোমরা জিনার ধারে কাছেও যেয়ো না। কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়’ (সূরা: ১৭ (আল-ইসরা/বনি ইস্রাঈল), আয়াত: ৩২)।

মামুনুল হক ইসলামের সাথে যেমন প্রতারনা করছেন তেমনি নারীকে দেখেছেন ‘পণ্য’ হিসেবে। তার প্রমাণ মেলে  জান্নাত আরা ঝর্ণার লেখা ২০০ পৃষ্ঠার ৩টি ডায়েরি থেকে। জান্নাত আরা ঝর্ণার আগে বিয়ে হয়েছে, সেই ঘরে আব্দুর রহমান ও তামীম নামে দুজন পুত্র সন্তান আছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডায়েরিগুলো তার মায়ের বলে নিশ্চিত করেছেন ঝর্ণার পুত্র আব্দুর রহমান। ঝর্ণার ডায়েরিতে লেখা, ‘আমাকে বিয়ে না করেই গ্রীনরোডের একটি বাসায় রাখেন মামুনুল হক। আমাকে খরচের টাকাও দিতেন। কিন্তু বিয়ে করে স্ত্রী বানাননি।’

ঝর্ণার ডায়েরিতে লেখা, বিয়ের আশ্বাসের বিনিময়ে অবৈধ মেলামেশা করতেন মামুনুল যা মেনে নিতে পারেননি ঝর্ণা। বিয়ে না করে দীর্ঘদিন ধরে তার সাথে মেলামেশা করেছেন মামুনুল হক। বিবাহবহির্ভূত মেলামেশার অনুশোচনার কথাও উঠে এসেছে ঝর্ণার ডায়েরিতে। ডায়েরির পাতায় পাতায় রয়েছে মামুনুলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আর্তনাদ। ডায়েরিতে ঝর্ণা লেখেন, আমি তাকে ভালোবাসি না ঘৃণা করি বুঝতে পারছি না। কিন্তু সে আমার জীবনকে নরক বানিয়ে ফেলছে। ডায়েরিতে ঝর্ণা বিয়ে প্রসঙ্গে লিখেছেন, মামুনুল হক বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন তিনি পূরণ করেননি।

ঝর্ণার ডায়েরি স্পষ্টতই প্রমাণ করে নারীকে অবদমন করে রাখার চিরায়ত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। স্পষ্টতই মামুনুল একজন যৌন নিপীড়ক। অথচ মামুনুলের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের খবরের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তার যৌন নিপীড়নের খবর। অবশ্য এমন নিপীড়কের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। এমনকি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুবৃত্ত শিক্ষকরাও যৌন নিপীড়নকে রীতিমতো রেওয়াজ হিসেবে বিবেচনা করে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। যৌন নিপীড়কদের কোনো কার্টেল আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে আপনি যদি যৌন নিপীড়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি তর্জমা করেন তাহলে স্পষ্টতই দেখতে পাবেন নিপীড়ক ক্ষমতা কাঠামোর আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনার চোখ এড়িয়ে তথাকথিত ভালো মানুষটিও নিপীড়ককে পরোক্ষ সহায়তা দিবে মাঝেসাঝে। আপনার বুঝতে খটকা লাগবে কে কার নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। হয়তো বহু কাল ধরেই এমন ঘটে আসছে আমার কিংবা আপনার না চেনা কোনো এক জগতে। তবে সেই না চেনা জগতে যে আবরনের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন আর জীবাণু রোধ করতে পারছে না। বেরিয়ে আসছে দগদগে ঘা!  

পুনশ্চঃ ইবাদত করার উপযোগী জায়গায় রাখার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হক।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি