ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

টাঙ্গুয়ার হাওর এখন মাছের মরণ ফাঁদ

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৩:৩৩, ২৫ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৩:৪৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ সবচেয়ে বড় জলাভূমি রামসার সাইট ও মাদার ফিসারিজ খ্যাত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওর এখন মাছের জন্য মরণ ফাঁদ। দিন দুপুরে পুরো হাওর জুড়ে কারেন্ট ও কোনা জাল এবং প্লাষ্টিকের মাছ ধরার গুই (চাই) পাতা রয়েছে। 

এসব ফাঁদে প্রতিদিন মাছ ও পাখি ধরা পড়ছে। এতে হাওরে কমছে মাছ।  তবে টাঙ্গুয়ার হাওরে নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকা আনসারদের ম্যানেজ করে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে চুরি করে মাছ ধরা ও অতিথি পাখি শিকার অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করে জানালেন পরিবেশবাদি সংগঠন ও স্থানীয়রা। 

অথচ হাওরে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা জানালেন,‘হাওরে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমান পেলে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ 

সরজমিনে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখা যায়, শুষ্কু মৌসুমেও টাঙ্গুয়ার হাওরে দিনের বেলা অবাধে চলছে মাছ শিকার। শিকারিরা কারেন্ট জাল দিয়ে ধরছেন মাছ। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরণের কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এছাড়াও মাছ ধরার একধরণের গুই ব্যবহার করেন জেলেরা। এসব গুই দিয়ে ছোট মাছ শিকার করা হয়। হাওরের অনেক জায়গায় অপ্রয়োজনীয় গুই ও কারেন্ট জাল পরিত্যক্ত রাখা। এগুলোর কোনো মালিক নেই। এই পরিত্যক্ত কারেন্ট জালে লেগে মাছ মরতেও দেখা গেছে। 

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা এবং স্থানীয়রা জানান,‘গোলাবাড়ি গ্রামের উত্তর দিকে টাঙ্গুয়ার হাওরের গভীর এলাকা হওয়ায় পর্যটকদের নৌকা প্রবেশ নিষেধ। অতিথি পাখি ও হাওরের সৌন্দর্য্য দেখার জন্য আলাদা ছোট নৌকা করে যেতে হয় পর্যটকদের। এসব গভীর এলাকায় পানির নিচে অসংখ্য কারেন্ট জাল পাতা রয়েছে। হাতিরগাঁতা, রউয়া, লেচ্ছচুয়া মারা, ছডাইন্না, বেরবেরিয়া, নোয়াল, কাজ্জুয়াউরির মতো বড় বড় বিলেও রয়েছে কারেন্ট জাল। পুরানো অনেক কারেন্ট জালে মাছ লেগে পচা শুরু হয়েছে। হাওরে এসব অবৈধভাবে কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে জেলেরা।’

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা এবং স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান,‘রামসার প্রকল্পভুক্ত টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনা জেলা প্রশাসনের তদারকি চলছে। কিন্তু হাওরের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বহনকারী নৌকার মাঝি ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদেরকে সপ্তাহিক টাকার বিনিময়ে প্রতি রাতেই চলে অবৈধভাবে মাছ ও অতিথি পাখি শিকার।’ 

সূত্র বলছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাওরে অভিযানে যাবার আগেই আনসার ও নৌকার মাঝিরাই মুঠোফোনে সংকেত পাঠিয়ে দিলে জেলেরা ও শিকারিরা বন ঝোপঝাড়ে কিছুক্ষণ আত্মগোপন করে থাকার পর ম্যাজিস্ট্রেট ফিরে আসার সাথে সাথেই শুরু হয় তাদের কর্মযজ্ঞ। 

মাঝে মধ্যে দু’একজন মাছ ও পাখি শিকারী ধরা পড়লে কিছু জাল, নৌকা ও পাখি আটকের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে লঘুদণ্ড ও জরিমানা আদায় করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না মাছ ও পাখি শিকার। এভাবে চলতে থাকলে অনেক প্রজাতির মাছ ও পাখি আগামি চার-পাঁচ বছর পর বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা ও হাওর পাড়ের একাধিক বাসিন্দা জানান, ‘নৌকার মাঝি ও আনসার সদস্যদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে রাতের আধাঁরে মাছ ও পাখি শিকার করা হয়। এতে প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ পেয়ে থাকেন তারা। রাতে চুরি করে পাখি ও মাছ শিকারের ফলে হাওরের জলমহালই এখন মাছ ও পাখি শুন্য হয়ে পড়ছে।’ 

উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ফয়জুল ইসলাম বলেন,‘জয়নাল সাবের আমলে টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছে ভরপুর ছিল। এখন মাছ কমে গেছে। কাগজে কলমে মাছ ধরা নিষেধ হলেও অবাধে মাছ শিকার হচ্ছে। আনসার সদস্যরা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। তাদেরকে ম্যানেজ করে হাওরে অবাধে মাছ শিকার করা হয়।’

গোলাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা ডালিম আহমদ বলেন,‘দিন-দুপুরে হাওরে মাছ শিকার করা হয় কিন্তু দেখার কেউ নেই। প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তারা হাওর দেখতে এসেও হাওরে মাছ শিকার দেখে যান। কোনো কাজ হয় না। বিশেষ করে হাওরে নিয়োজিত থাকা আনসার সদস্যরা থেকেও নেই। হাওরে মাছ শিকার করা ছাড়াও অনেক জেলেরা কারেন্ট জাল ফেলে যান, আর ওই জালে মাছ ও পাখি লেগে মরে পছে যায়।’

একই গ্রামের বাসিন্দা বাদল মিয়া বলেন,‘হাওরের মাছ ও পাখি শিকার বন্ধে কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেন, তাহলে আগামি কয়েক বছর পর মাদার ফিসারিজ খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র বিলুপ্তি হয়ে যাবে।’

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পিযুষ রঞ্জন পুরকায়স্থ টিটু বলেন,‘টাঙ্গুয়ার হাওরে কিছু অসাধু জেলেরা অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে। তারা দিন-দুপুরে কারেন্ট জাল, কোনা জাল ও প্লাষ্টিকের গুই দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এছাড়াও রাতের আধাঁরে শিকারিরা পাখিও শিকার করছেন। হাওরে মাছ শিকার শেষে প্লাষ্টিকের গুই ও পরিত্যক্ত কারেন্ট জাল হাওরে ফেলে রাখায় অনেক মাছ মারা যায় এবং পাখি ভয়ে চলে যায়। এরকম মাছ শিকার অব্যাহত থাকলে কয়েক বছর পর হাওরে মাছ ও পাখি বিলুপ্তি হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন,‘হাওরে নিয়োজিত ম্যাজেস্ট্রিট অভিযানে যাওয়ার আগে আনসার সদস্যরা অসাধু জেলেদেরকে খবর দিয়ে দেয়। মূলত হাওরে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের ম্যনেজ করে জেলেরা মাছ শিকার করছেন। কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ,  দ্রুত টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র রক্ষায় পদক্ষেপ নিন।’

এ ব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বিজের ব্যানার্জী বলেন,‘আমরা হাওর পাড়ের মানুষদেরকে নিয়ে উঠান বৈঠক ও সমাবেশ করেছি। সমাবেশে তাদেরকে মাছ ধরা ও পাখি শিকার না করার জন্য বলেছি। তাদেরকে নানান সহযোগিতা করা হচ্ছে। তবে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে হবে। তারা সচেতন হলে হাওরে মাছ ও পাখি শিকার কমে আসবে।’

তিনি বলেন, অসাধু জেলেরা দিনে ও রাতে মাছ শিকার করছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সময় কারেন্ট জাল আটক করে ধ্বংস করা হচ্ছে। তবে কোনো আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ পেলে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

এআই/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি