ঢাকা, রবিবার   ০৫ মে ২০২৪

তাই পুষ্প রেখে যাই

প্রকাশিত : ২২:৩৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৮

গতবছর এ রকম দিনের কথা- তাপমাত্রা প্রায় হিমাংকের নিচে। উলের দস্তানা জোড়ার ভেতর হাত হিম হয়ে আসছে। আমার হাতে একটি প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে স্কিম্ড দুধের সবুজ ঢাকনাওলা প্লাস্টিক বোতল,আজকের পত্রিকা, দুটো আপেল, সদ্য বেক করা ছোট্ট একটি রুটি ও মাখন। রুটি ও মাখনের সুগন্ধ আসছে। এ মাখনের রঙ সাদা নয় বাটা সর্ষের মত হলদে। এ রুটিকে এখানে লোফ বলে না বলে ব্রেড। এ ভিনদেশে সব রঙই ভিন্ন।

ছোটবেলায় বাংলাদেশের ছোট্ট এক মহকুমা শহরে থাকতাম। নাম ছিলো তার জামালপুর। আজ ওই রুটির গন্ধ আমাকে সেখানে নিয়ে গেছে আর আমার ঠাণ্ডা গালে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলধারা। তখন ঘোষের ভাড়ের কলাপাতায় ভাসা হাতে তোলা সাদা মাখন নান্নার দোকানের মিষ্টি লোফের উপর দিয়ে খেতাম। আমাদের হীম সাগর গাছে নিচেই একপাশে নান্নার ছাপড়া দোকান মড়া ব্রম্মপুত্রের পাড়ে আমাদের বাংলা মার্কা টিনশেড বাড়িটা ছিল। ঘোষ আমাদের বাড়ি ঘুরে কয়েক বাড়ি পরে, বকুল তলা ছাড়িয়ে বাবুল ভাইদের বাড়িতে যেতো। তাকে মেয়র আনিসুল হক নামে, নগরপিতা নামে চেনে। আমি চিনতাম বাবুল ভাই নামে। ওরা চার ভাই ও এক বোন। আমরা দুভাই দুবোন। আমরা সবাই বাবাদের কর্মসূত্রে বড় হচ্ছিলাম সেই ছোট্ট সুন্দর শান্ত এক রাস্তার শহর জামালপুরে।

বাবুল ভাই,

তোমাদের বাসা ছিলো ওই রাস্তা থেকেই বেরিয়ে যাওয়া পোস্ট অফিসের পাশে বকুলতলা পেরিয়ে আমাদের গার্লস স্কুলের ঠিক পেছনে। আমার বাবা আর তোমার বাবা শরীফুল হক চাচা প্রবল শিল্পপ্রেমী ছিলেন। তারা ওই ছোট্ট শহরটিকে সাংস্কৃতিক আনন্দে,কৃষি শিল্প মেলা, নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র রাগিনীর আয়োজনে জাগিয়ে রাখতেন। আমরা সেই দুই বন্ধু-বাবার হাতে ধরে প্রথম পা ফেলেছিলাম সেই অঙ্গনে। সে সময় আমজাদ হোসেন ও আনোয়ার হোসেন আমাদের ওই টুকরো শহর থেকেই ঢাকায় নাম করতে শুরু করেছেন। তাদের সঙ্গে নাটক করতে আমাদের শহরে আসতেন সুজাতা। গান করতে আসতেন খন্দকার ফারুক আহমেদ।

মনে পড়ে বাবুল ভাই? চাচা ও আব্বা নদীর ধারে পাবলিক লাইব্রেরির হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবেন বলে চাঁন মিয়া চাচার বাসায় আমাদের নিয়ে যে লাগাতার মহড়া দিতেন! বেনু দা সেতার নিয়ে আসতেন, পরান দা তবলা জোড়া। আম্মা ও চাচী সুচির হালুয়া ও আটারুটি খাইয়ে আমাদের রিহার্সেলে পাঠাতেন। চাচা ছিলেন জামাল্পুরের আনসার এ্যাডজুট্যান্ট আর আব্বা ফুড কন্ট্রোলার। সে ছিলো আমাদের এক অনন্য নির্ভেজাল কৈশোর ও উষাকালের যৌবন।

তুমি ও ভাইয়া ছিলে জিগরী দোস্ত। ছিলে শেষাবধি। তোমার প্রয়ানের তিন চার মাস আগেও তোমার এক ডাকে ভাইয়া হেমিলটন থেকে চলে এসেছিলো ঢাকায় তোমাদের জামালপুইরাদের আড্ডায় যোগ দিতে। কিযে আড্ডাবাজ আর কৌতুকপ্রিয় ছিলে তুমি! নান্নার দোকানে তখন চা হতো কি-না আজ আর মনে নেই। কিন্তু পাব্লিক লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে হয়তো তিলের খাজা, লোফ আর কলা খেয়েই আড্ডা দিতে তোমরা। তোমাদের অনেকগুলো দুষ্টুমীর খবর আমার জানা। তোমার ভাই ইকবাল ছিলো আমার বন্ধু আর আমার ছোটভাই শোয়েবের, তোমার ভাই হেলাল। বেলাল ও জেসমিনকে আমরা তখন হিসেবে ধরতাম না। ওরা আমাদের পেছনে ছিলো দুধভাত। আমি, ইকবাল, মুহিত ও মন্টি – আমরা চার বন্ধু ভোর বেলা উঠে দুধ মুড়ি খেয়ে পড়তে যেতাম নিজামুদ্দিন সারের কাছে। ভাইয়া তখন তোমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াক সেরে কূয়োর জলে স্নান করতে যেতো।

তখন ছোটদের সাইকেল আছে বলেও জানি না। জানলেও সৎ সরকারি চাকুরে বাবাদের যেখানে রেশনের চালে সংসার চলে তাদের তা কেনার সামর্থ্য ছিলো না। তোমরা সবাই আমাদের পিওনদের সাইকেলের রডের তিন কোনার ভেতর অদ্ভূতভাবে দেহ গলিয়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে প্যাডেল মেরে সাইকেল চড়া শিখে ফেলেছো। তাই দেখে আমরা কয়েক বন্ধুও তাই করলাম। পাথালিয়ার বিশাল বিশাল জামগাছ ছাওয়া রাস্তা ধরে আসতো শেলী। আমড়া পাড়া থেকে ডলি। আর বকুল তলা থেকে আমি আর মন্টি। কোমরে ওড়না বেঁধে, সালোয়ার উঁচু করে আমরাও নামতাম পিওন আরব আলী ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে। আর এমনি ভোর বেলা তুমি, গেন্দা ভাই, ভাইয়া, শাহাবুদ্দিন ভাই আমাদের নার্ভাস করার জন্য সাড়া রাস্তার এমাথা ওমাথা জুড়ে লাইন ধরে হাঁটতে। প্রায় আমাদের গতিপথ রুদ্ধ করে ‘মর্নিং ওয়াক’ করতে! তোমাদের অমন ঘোরা ফেরাকে আমরা বলতাম ফিল্ডিং। আমরা নড়বড়ে বালিকা সাইকেল চালিকা প্রাণপনে বেল দিতে থাকলেও একদম সরতে না। তোমাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়বার সময় দুষ্টু হাসি হেসে, ‘ছেড়ে দেরে ছেড়ে দেরে’ বলে রাস্তা ছেড়ে দিতে। কোন মতে ফোঁকড় গলিয়ে বেরিয়ে গেলে শুনতাম তোমাদের হাসি। ওটাই ছিলো আমাদের সবার ফান। তখন এখনকার মত মারাত্মক ইভটিজিং ছিলও না। কিন্তু সবারটা ছাপিয়ে উঠতো তোমার হা হা ধবনি। যা কি না একদিন হয়ে উঠেছিলো পুরো ঢাকাবাসীর এক অনন্য আস্থার ধ্বনি উৎস।

বাবুল ভাই, মনে আছে সেই আমাদের বাসার উলটো দিকেই শুকনো খালের ওপাড়ে ছিলো ধাঙ্গর বসবাসের কথা? ছুটির দিনে আমাদের বৈঠক খানার মুখ বের করা খোলা বারান্দায় কাঠের পিলারে ঠেস দিয়ে তুমি আর ভাইয়া দেখতে শুকরে মদে নালায় পড়ে ওদের গড়াগড়ি। বিকেল বেলা বকুলতলায় ক্রিকেট হাতে আমাদের বড় আপার ছেলে বুলবুল ভাইসহ খেলতে ক্রিকেট। তোমরা তখন আশেক মাহমুদ কলেজে পড়তে। আর ছুটি ছটাতে ঢাকা কলেজে পড়ুয়া জামাল ভাই এসে ছক্কা মারতো তোমাদেরই মাঠে। আমি আর মন্টি তখন মা’দের জন্য বই ধার করার নাম করে ওই মাঠের সামনে দিয়ে একবার পাবলিক লাইব্রেরি যেতাম আবার ফিরে আসতাম।

বাবুল ভাই, মাঝের গল্পগুলো আরও রঙিন। আরও চন্মনে। তোমার অর্জনের। এবং আনিসুল হক হয়ে ওঠার। এমনকি শেষের দিকের গল্পও। ততদিনে তুমি শুধু আনিসুল হক হয়ে শুধু সিঁড়ির পর সিঁড়ি মাড়িয়ে উঠেই চলেছো। সে আমি বিলেত চলে আসার পরও।

আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরাও ভাইবোনের নিগড়ে ঢাকা মাতিয়ে আনন্দ করে চলছিলো। আর তুমি হয়ে উঠেছিলে দেশের এক অনন্য আইকন। ছোটবেলার সে দূর্বার বাবুল ভাই হয়ে উঠেছিলে ডাকাবুকো ঢাকা উত্তরের দেশপ্রেমী প্রবল পরাক্রান্তশালী মেয়র। নগরপিতা।

 

তুমি দেহত্যাগ করেছিলে গত বছর এই লন্ডনেই। তার দু’ঘণ্টার মধ্যে তীব্র শৈত্যের মধ্যে লন্ডন শহীদ মিনারে আমরা সবাই বিজয় ফুল নিয়ে বিজয় মাসের সূচনা করবার আগে তুমি ও তোমার কীর্তি স্মরণ করে এক মিনিট নিরব হয়েছিলাম। সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা বলছিলেন তুমি ছিলে তাদেরই উত্তরসূরী। তরুণরা বলছিলো তুমি তাদের ছিলে প্রেরণা। অল্প বয়সীরা অবাক হয়ে ভাবছিলো কেন এই আনন্দের দিনে বিজয় মাসের সূচনা লগ্নে আমরা কেন এত ভারাক্রান্ত! কে সেই ব্যক্তি যার কারণে বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে এই মানুষগুলো এত কাতর হয়ে পড়েছে!

আগের গত তিন মাস এই লন্ডনেই নিথর হয়ে যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলে- আমি ভেবেছিলাম তুমি সেই হাল্কের মত যেভাবে চরম শক্তিতে দেশের বিদেশি দূতাবাসের স্ল্যাব উঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলে নির্ভিক বাংলাদেশ আবার তেমিনি দাঁড়াবেই। কারণ তোমার রুবানা তোমার পাশে তো আছেই। যে তোমার মিশন ও ভিশনের সঙ্গে হাত ধরা ধরি করে আছে প্রায় কিংবদন্তী নারীর মতই। যে নারী জীবনে কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি। যে নারী এবারো শত হায়নার আঁচড় থেকে নিজে অসামাজিক অপ্রিয় হয়ে তোমাকে আগলে রেখেছিলো। কিন্তু এ নারী এবার তোমাকে ফিরিয়ে আনার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলো। হায় এ্যাড্রোমেকি! তোমার ক্রন্দনে ও বীরের মহা প্রয়ানে আমি পুষ্প রেখে যাই। আমাদের দেশের আগামীর সন্তানদের কাছে প্রত্যাশা রেখে যাই। হে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বীর আমরা তোমাকে ভুলবো না।

লেখক: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি