ঢাকা, রবিবার   ০১ জুন ২০২৫

পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংনামা

বাপ্পী রহমান

প্রকাশিত : ১৬:২৩, ২৪ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৬:২৭, ২৪ জুলাই ২০২১

Ekushey Television Ltd.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ভর্তি হয়েছি তখন। আমাদের ক্লাস শুরু হয়নি, তবে বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে শুরু হয়েছে গেছে। শুনলাম ঝাঁকড়া চুলের এক প্রফেসর গল্পের মতো করে মার্কেটিং পড়ান। একদিন সাহস করে ঢুকে পড়লাম আরকি। কী আশ্চর্য্য! নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়ে গেলেন আপাদমস্তক এক শিক্ষক। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক চিলতে হাসি রেখে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের মার্কেটিং-এর গুরু ড. মীজানুর রহমান। আমি মন্ত্রমুগ্ধ, আর পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিল তখন। আমার কাছে কেবল মনে হয়েছিল, আমার বন্ধুরা ভুল বলেনি একবিন্দুও।

মীজানুর রহমানের রয়েছে হরেক রকম পরিচয়। সেসব কারণে অনেকের মতো আমারও তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল। একবার ড. মীজানের সাথে আমি আমার নবীন শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি আমাদের শেখালেন লোক প্রশাসনের ইতিবৃত্ত এবং সাম্প্রতিক ট্রেন্ডস। 

শুনেছি, ড. মীজানের বই নাকি মার্কেটিং-এর শিক্ষার্থীদের কাছে ‘বাইবেল’ সমতুল্য। সম্প্রতি ফেসবুকে তাঁর তিন পর্বের ‘পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং’ শিরোনামের লেখা পড়ে আমি তেমনটাই বিশ্বাস করছি। যদিও আমি লোক প্রশাসনের ছাত্র, তবে এতটুকুন বুঝেছি যে, এর মধ্যে হিউমার এবং একাডেমিক তত্ত্বজ্ঞানের মিক্সার রয়েছে।

প্রথম পর্বে, ড. মীজান লিখেছেন- ‘আপনি কি কোকাকোলা হতে চান?’ কনটেন্ট সমৃদ্ধ একটি লেখার শেষে পাঠক খুব চমৎকারভাবে জানতে পারবেন ব্র্যান্ডিং-এর সরল সজ্ঞা- “সচেতনভাবে এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যক্তিবিশেষের নিজের সম্পর্কে অন্যের ধারণাকে প্রভাবিত করে নিজকে ‘স্বাতন্ত্র্য’ হিসাবে উপস্থাপন এবং প্রতিযোগীর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে স্থান করে নেয়ার চেষ্টাকেই পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং হিসেবে অভিহিত করা হয়”। 

দ্বিতীয় পর্বটি ইন্টারেস্টিং-  “সওয়ারী হওয়ার জন্য একটি ঘোড়া জোগাড় করুন (Find a horse to ride)”। সেখানে তিনি পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং-এর বিকল্প হিসেবে অর্গানিক ব্র্যান্ডিং-এর আইডিয়া তুলে ধরেছেন। একই সাথে এই পথ যে আরও গোলমেলে অবস্থা সৃষ্টি করে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেশের একজন প্রতিশ্রুতিশীল বুদ্ধিজীবীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক ‘জ্ঞান ও কোটেশন’ বিতরণ করে ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করার চেষ্টাকে সামনে তুলে ধরেছেন। 

তৃতীয় পর্ব- “গলাধঃকরণ ক্ষমতার চেয়ে কামড় বড় হওয়া উচিত নয়”– এ ড. মীজান জানান দিচ্ছেন, “রাজনীতিতে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের এটি একটি অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। এ দিয়ে রাজনীতিতে বেশি দূর এগোনো যায় না। তবে এই প্রক্রিয়ায় পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত ফল অর্জন করা না গেলেও কিছু লক্ষ্য অর্জিত হয়। যেমন ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেস ব্যাপক হারে বাড়ে; তবে ‘share of mind’ বাড়লেও ‘share of heart’ বাড়ে না।  যার ফলাফল দেখা যায় জাতীয় নির্বাচনে। অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন হলেও তাঁদের জামানত থাকে না বা থাকবে না। মান্না, সাকী, নুরু, ইব্রাহিম, রতন, মাহী, পার্থ-এ ধরনের ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেসের উদাহরণ।”

অবশ্য অনেক আগে পলিটিক্যাল ইকোনমি শাস্ত্র এ সবের খোমা স্পষ্ট করে দিয়ে গেছে। প্রথমে মহামতি মার্কস পরে আন্তোনিও গ্রামসি। এমনকি বিনয় ঘোষও তাঁর সময়কালকে যথার্থভাবে তুলে ধরেছিলেন। সাচ্চা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি জানান দিয়ে গেছেন, “নামহীন পরিচয়হীন সমাজে, যেখানে শুধু সংকেত ও প্রতীক দিয়ে মানুষকে চিনতে হয়, সেখানে স্বভাবতই ব্যক্তিগত অটোমবিল ব্যক্তিপরিচয়ের সবচয়ে বড় সংকেত ও প্রতীক হয়ে ওঠে”। 

সেক্ষেত্রে ড. মীজানের এনালাইসিস অবশ্য ফেসবুক জামানার। এমন এনালাইসিসের দরকারও ছিল। কারণ আপনার-আমার চেনা জগতের সামনে ‘সংগীতশিল্পী’ কান হেলাল কিংবা টিকটকার অপু ভাই সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছেন আবার প্রতিশ্রুতিশীল বুদ্ধিজীবী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক ‘জ্ঞান ও কোটেশন’ বিতরণ করে ‘লাইক’ গুণে যাচ্ছেন। আর ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার মৌসুমি রাজনীতিবিদদের আপনি-আমি চিনি! 

আজ তাহলে থাক! কিন্তু সংঘাত গিয়ে কোথায় গড়াবে? সহজ উওর- মানুষকে ছাপিয়ে মানুষের ব্র্যান্ড-নেম তার উপর আধিপত্য করে। ফলত: মানুষ হয়ে ওঠে পণ্য, খ্যাতি কিংবা টুপাইস কামানোর দাস, ব্র্যান্ড নেম হয়ে উঠে মানুষের পরিচয়। সিদ্ধান্ত মানুষের!

লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এনএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি