ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪

পুরো পরিস্থিতিই উল্টে গেল

আবদুল্লাহ আল ইমরান

প্রকাশিত : ১৯:৩৭, ৫ জুন ২০২০

শেষ বিকেল। সন্ধ্যা হতে তথনও ঢের বাকি। তবু চারিদিকটা কেমন বিষন্ন অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আমি জানালায় উঁকি দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখার চেষ্টা করি। চার-দেয়ালের বাইরে কতোকাল, কতো দীর্ঘকাল সবুজাভ পৃথিবী আমি চেয়ে দেখিনা!

একেকটা ভবন এমন গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে যে, অন্য বাড়ির স্পর্শের দূরত্বে থাকা গৃহস্থালি অবয়ব চোখে পড়লেও মস্ত আকাশ কিংবা বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি দেখার কোনো সুযোগ মেলে না।

বৃষ্টির শব্দ শোনার অভিপ্রায়ে আমি মাথার কাছের জানালাটা খানিক খুলে রেখেছি। এমন দিনে বিরামহীন জলের গান আমার ভালো লাগে। ফেলে আসা অজস্র স্মৃতি ভর করে মনের দরোজায়, চৌকাঠে।

কম্পিউটারে বাজছে কলকাতার জনপ্রিয় ব্যান্ড ফকিরা। ফোক অ্যালবাম 'ইতরপনা'র প্রিয় গানগুলো একটার পর একটা বেজে চলেছে। তিমিরদা'র অদ্ভূত মনকাড়া কন্ঠে গভীর ভাবনার অর্থবহ এক আবহ তৈরি হয়েছে চারপাশে। এই লোকটা যে কি গভীরভাবে আমাকে এই সময়গুলোকে সঙ্গ দিলেন, সে গল্প আরেকদিন বলব।

কাছে-দূরে কিছুক্ষণ পর পর প্রবল গর্জণে বাজ পড়ছে। বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে চোখেমুখে। করোনাজর্জরিত জীবনের নানা হিসাব-নিকাশের জন্য এ এক অপার্থিব পরিবেশই বটে।

তবে এই পরিবেশ খুব বেশি প্রগাঢ় হতে পারল না। ফোন বাজল। ইদানিং কারো ফোন ধরতে ইচ্ছে হয় না। ডিস্লেতে দেখলাম নাম্বারটা সেভ করা। বিএসএমএমইউয়ের ভাইরোলজী বিভাগ প্রধান অধ্যাপক মুন্সি সাইফ কল করেছেন। চারিদিকে প্রবল অরাজকতার ভীড়ে মাত্র দুদিন আগেই আমাদের চূড়ান্ত ফলোআপ টেস্টের জন্য তাকে অনুরোধ করেন প্রিয় শিক্ষক ড. সাদেকা হালিম।

এতে কাজ হয়। আমরা স্যাম্পাল দিয়েছি গতকাল। আজ ফল পাওয়ার কথা। বাইরে যেতে, প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে আড্ডা দিতে এবং অসমাপ্ত অনুসন্ধানগুলো শুরু করতে আমার মন ছটফট করছে। কতো প্লান করে রেখেছি, কতো নতুন ভাবনা এসেছে মনে, ঠিক ঠিক সুস্থ্য হলে, কতো কি করবো এবার!

প্রাথমিক ফল মোবাইলে ম্যাসেজ আকারেই আসার কথা। কিন্তু এতো বড় একজন মানুষ, এই জরুরি সময়ে যাকে ফোনে পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার, তিনি নিজে আমাকে কল করায় বেশ খানিকটা অবাক হলাম।

ফোন ধরতেই তিনি বললেন, ‘ইমরান আপনার কেসটা বেশ রেয়ার। আমি আরও দু-তিনটা এমন কেস পেয়েছি। ফলে আমার মেডিকেল রিসার্চের অংশ হিসেবে নিজেই ফোন করলাম আপনার কেস হিস্ট্রিটা বিস্তারিত একটু জানতে।’

আমি ঘটনা তখনও বুঝতে পারছি না। চারদিন আগেই প্রথম ফলোআপ টেস্টে আমি এবং আমার স্ত্রী নেগেটিভ হয়েছি। এখন দ্বিতীয় টেস্টে নেগেটিভ হলেই বেঁচে যাই। ভালো সংবাদটা সবাইকে জানাতে পারি। এরমধ্যে ডাক্তারের এমন কথায় খানিক ভড়কে গেলাম।

প্রফেসর সাইফ জানতে চাইলেন, ‘আপনি কবে আক্রান্ত হয়েছেন?’

আমি বললাম, ‘মে মাসের ১১ তারিখ জেনেছি যে আমরা পজেটিভ।’

‘কোথায় টেষ্ট করিয়েছেন?’
‘আপনাদের ওখানেই, বিএসএমএমইউতে।’
‘তারপর?’
‘ভালো বোধ করায় গত ৩০ মে প্রথম ফলোআপের নমুনা দেই। ঢাকা মেডিকেল থেকে রিপোর্ট আসে ২ তারিখ। আমরা দুজনই নেগেটিভ হই।’

‘আপনার শরীরে এখন কি কি লক্ষণ আছে, কেমন বোধ করছেন?’

আমি খানিক দম নেই। বলি, ‘শরীরে তো তেমন কিছু নেই। তবে গতকাল রাত থেকে আমাদের দুজনেরই হঠাৎ ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। হয়তো খাওয়ায় কোনো গন্ডগোল হয়েছে। আমরা সকাল থেকে স্যালাইন খাচ্ছি। আচ্ছা, কোনো সমস্যা হয়েছে? আমাদের রেজাল্টটা কি জেনেছেন?’

ডাক্তার সাইফ শান্তনার সুরে বলেন, ‘জেনেছি। মন খারাপের কিছু নেই। আপনার স্ত্রীর রিপোর্ট নেগেটিভ। কিন্তু আপনার পজেটিভ এসেছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে ফল এভাবে উল্টে যাওয়ার কথা না। এই কেসগুলো আমরা নোট রাখতে চাই। ফলোআপ করতে চাই। তাই আপনার সঙ্গে কথা বললাম। লক্ষণও বলছে, আপনি এখনও পজেটিভ।’

বাইরের বিষন্ন পরিবেশের পুরোটাই যেন এবার আমার উপর ভর করেছে। আমার জীবনে এটাই একমাত্র ‘পজেটিভ’ শব্দ, যা আমার পুরো জগতটাকেই প্রায় বিশ-পঁচিশটা দিন ধরে নেগেটিভ করে রেখেছে।

আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা ইকবাল আর্সেনাল স্যারের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। স্যারকে ঘটনা জানালাম। স্যারও একটু অবাক হলেন। বললেন, ‘আমি ডাক্তার সাইফের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলব।’ একটা এন্টিবায়োটিক দিলেন এবং নিয়মগুলো পুনরায় মানতে বললেন।

ঘটনা জেনে তিন্নির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

বেচারি করোনায় বেশ ভূগেছে। গত কয়েকদিন ধরে তাকে হাসিখুশি দেখছিলাম। ফের কেরানীগঞ্জের মানুষের পাশে থেকে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অফিসে যাওয়ার তারিখও ঠিক করে ফেলেছিল।

করোনাসংক্রান্ত নিয়ম-কানুনগুলো ও অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে, আমাকেও মানতে বাধ্য করেছে। আজ রাতে দুজনের একসাথে একটা ভিডিও তৈরির কথা ছিল। যেখানে, করোনা জয়ের ঘোষণা এবং এ সময়ে করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে। কিন্তু পুরো পরিস্থিতিই উল্টে গেল। আসলে মানুষ যা ভাবে এবং প্রত্যাশা করে, সব সময় তা হয় না। করোনা আমাদের এ উপলব্ধি আরও প্রগাঢ় করেছে। তাই মেনে নেওয়া ছাড়া তো আর কিছু করার নেই।

মনকে শক্ত করে ফের খাতা-কলম নিয়ে বসেছি আগামী ৭ দিন আমাদের কি করণীয়। তিন্নি যেহেতু নেগেটিভ (যদিও পুনরায় আক্রান্তের খানিক লক্ষণ আছে), তাকে ভিন্ন রুমে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার মিশনে নেমেছি।

গরম পানিতে গোসল, গরম পানি খাওয়ার পুরনো রুটিনে ফিরে গেছি। এছাড়া দারুচিনি, এলাচ, আদা, লেবুর ভাগ নেওয়ার মিশনও ফের শুরু।

ডাক্তার বলেছেন, করোনা এবার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আমাকে কাবু করতে পারবে না। সাতদিন পর আরেকবার নমুনা টেষ্ট করতে হবে। এরমধ্যে পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা দারুণ এক গবেষণা রিপোর্ট পাঠালেন। যেটা পড়ে শান্তনা পেলাম।

রিপোর্টের সারমর্ম হলো, করোনা থেকে সেরে উঠে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফের পজিটিভ হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু এ নিয়ে আশঙ্কা দেখছেন না দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকেরা। তাদের মতে, দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া এসব রোগী অন্যদের আর সংক্রমিত করতে পারবেন না।

কোরিয়ান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর বিজ্ঞানীরা ২৮৫ জন রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়েছেন, যারা করোনা থেকে সেরে উঠার পরেও ফের তাদের দেহে ভাইরাসটির উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

তবে দ্বিতীয়বার পজিটিভ রোগীরা ভাইরাসটি সংক্রমণ করছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং তাদের দেহ থেকে সংগৃহীত ভাইরাসের নমুনা ‘কালচার’ করা যায়নি, তার মানে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার উপযুক্ত করে তোলা যায় নি।

এর অর্থ হলো যে এই রোগীরা যে ভাইরাস কণিকা ত্যাগ করছেন, সেগুলি মৃত কণিকা, যার দ্বারা সংক্রমণ সম্ভব নয়।

এই গবেষণাটিকে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুখবর হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ হয়ে উঠলে তারা বলতে গেলে নিরাপদ। তাদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।

আক্রান্ত হওয়ার পর এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, যা অভূতপূর্ব। সেই ভালোবাসার শক্তিতেই আরো কয়েকটা দিন লড়াই করতে চাই। জয়ী হতে চাই। নিশ্চয়ই আপনাদের প্রার্থনায় আমাদের নাম থাকবে।

এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনও মেঘ ডাকছে।

মনে হচ্ছে রাতভর বৃষ্টি হবে। এই বৃষ্টির রাতগুলোয় ঘুম আসে না আমার। কতো কথা মনে পড়ে, কতো কতো আনকোড়া স্মৃতি! এইসব স্মৃতিগন্ধা নির্ঘুম বর্ষণের রাত শেষে নিশ্চয়ই একটা ঝলমলে সকাল দেখবো। এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।

ঘাসফুলের আয়ু নিয়েও আমাদের চাওয়ার তো আসলে শেষ নেই। চাওয়াকে পাওয়ায় রূপ দিতে শেষ নেই ছোটাছুটিরও। কী হবে, কেন হয়নি, এমন হতাশার ডামাডোলে জীবনের সবচেয়ে বর্ণিল, সবচেয়ে মহিমান্বিত বহমান মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলি আমরা।

দিন শেষে ঝরে যাওয়ার আগে বুঝতেই পারি না জীবন মানে অলীক সম্ভাবনার ডালপালা নয়। জীবন মানে প্রতিটা মুহূর্ত খুশি করে বাঁচা।

জীবন মানে স্বল্প আয়ুর বাস্তবতা মেনেও। ঘাসফুলের মতো অবাক ফুটে থাকা।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি