ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রাণপাখি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৩৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৭:৩৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সারা বছরটা কোনমতে কেটে গেলেও, বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ের দিন কয়টি নিদারুণ ভারী ঠেকে প্রতিভা দেবীর। অত্যন্ত বেদনা কাতর হয়ে পড়েন তিনি সেই দিন গুলিতে। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া সব তুঙ্গে উঠে যায়। বাড়ির বাকী লোকজনের ব্যস্ত জীবনের তাগিদে খুব বেশি আবেগতাড়িত হয়ে ওঠার সুযোগ হয় না। কিন্তু প্রতিভা দেবী যে সেই মা, যার সন্তানের জন্য সবসময় মন টা হু হু করে!

সত্তর ছুঁই ছুঁই প্রতিভা দেবীর এখন কোন ব্যস্ততা নেই। সবসময় নিজের মতন থাকেন। দশ বছর আগে স্বামী প্রভাত রঞ্জনকে হারিয়ে টকটকে লাল সিঁথিটা শুভ্র সাদায় প্রশস্ত হয়ে গেছে। দুই ছেলে, ছেলে বউ আর নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার তার। তবু কোথায় যেন একটা শূন্যতা তাকে গ্রাস করে চলে অহরহ। মনে হয়, এখানে হয়ত আরো দুইজন নাতি-নাতনি তার বেশি থাকতে পারতো!

আজ অগ্রহায়ণ মাসের এগারো তারিখ। বাংলা তারিখটাই মনে রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। তাছাড়া ইংরেজিতে তারিখ মনে রাখার রেয়াজ তখন অত ছিলও না! তবে মাস টা নভেম্বর, তা মনে আছে। এই দিনটা আসার সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই কেমন যেন সৃষ্টিছাড়া লাগে নিজেকে, প্রতিভা দেবীর। মাঝেমাঝে ভেবে বসেন এ দিনটি না এলেও পারতো বুঝি! এই দিনে প্রতিভা দেবী আর প্রভাত বাবুর প্রথম ও একমাত্র মেয়ে মাধুকরীর জন্ম হয়েছিল। আর প্রথম মা হওয়ার স্বাদ পেয়েছিলেন প্রতিভা দেবী।

কাজল কালো চোখ, টিকলো নাক, কুচকুচে কালো চুল আর উজ্জ্বল শ্যামবর্ন গায়ের রঙ, সব মিলিয়ে মেয়ের দিক থেকে চোখ ফেরানোই দায় ছিল যেন বাবা-মার। দিনে দিনে সারা বাড়িময় শুরু হয়েছিল তার ছোট ছোট তুলতুলে পায়ের টাল মাটাল ছোটাছুটি। আদরের মাধুকরী, সবার প্রাণের মাধু হয়ে উঠছিল। ছোট্ট একটা পাখি যেন। মাধুর পরে, তার মায়ের কোলে আসে রণজিৎ । রণ, মাধুর প্রায় পাঁচ বছরের ছোট। ভাই রণর সঙ্গে, মাধু তবু কিছুদিন খেলতে পেরেছিল। কিন্তু আরেক ভাই জয়কে তো মাধু দেখতেও পারেনি। প্রতিভা দেবীর অস্তিত্বে একটু একটু বাড়ছিল তখন জয়।

খুব ভোরে উঠেছেন আজ প্রতিভা দেবী। সত্যি বলতে সারারাত ঘুমাননি একটুও। আজ মাধুর জন্মদিন। স্নান সেরে, আহ্নিক শেষে গীতার মাহাত্ম্যকথা টুকু পাঁচ বারে শেষ করলেন। আজ পারছেন না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে শুধু। পূজো দেয়ার আগে একটু পায়েস করবেন আজ। ভোগে দিবেন বলে। ঘন দুধের পায়েসে আধামুঠ ভেজানো নরম কিসমিস ছড়িয়ে দেবেন, ব্যস। মেয়েটা খুব ভালো খেত পায়েস টুকু, একেবারে বাটি সুদ্ধ চেটেপুটে।

সাত/আট বছর বয়সী মেয়েটার পছন্দ-অপছন্দের তালিকাটা তখনও খুব দীর্ঘ হয়ে ওঠেনি। তবে বড় মাছের পেটি খুব পছন্দ করতো বুড়িটা, ভেবেই স্মিত হাসি ছড়িয়ে গেল প্রতিভা দেবীর গালে। সঙ্গে ডুবো তেলে ভাজা গোল চাক বেগুন আর টমেটোর চাটনি। আর সারাদিনে সুযোগ পেলেই আম, বরই, জলপাইয়ের মিষ্টি আচার। খুব বেশি করে মেয়েটাকে জানতে পারার মত সময়ই তো দেয়নি ঈশ্বর তাকে! আজ এতগুলো বছর হয়ে গেছে এই কয়টি জিনিষের একটিও আর মুখে তোলেননি প্রতিভা দেবী।

বারবার আঙুলের কর গুণে গুণে হিসেব করার চেষ্টা করছেন প্রতিভা দেবী, কততম জন্মদিন আজ মাধুর! চশমার কাঁচ এ নিয়ে চারবার মুছলেন, আর চোখ মুছে চলেছেন তো সেই কবে থেকেই! নাকি কোন হিসেবটা সহজ, তাই নিয়ে দ্বিধায় পরছেন বারবার। ভাবছেন, জন্মদিনের হিসেবটা নাকি হারিয়ে যাওয়ার হিসেবটা কোনটা বেশি সহজ হবে তার জন্য হিসেব করতে! জীবন তাকে এমন হিসেবের গড়মিলে কেন ফেলেছিল তা আজও বুঝে উঠতে পারেননি তিনি।

"মাধু, আমার মা, আমার সোনা মেয়ে, তুই আমাকে ক্ষমা করিস না মা!" "ক্ষমা করিস না তুই, তোর বাবাকেও!" ক্ষমা করিস না তুই সেইসব মানুষরূপী পশুদের যারা দেশ দখলের আশায় লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলেছিল। যাদের তাণ্ডবলীলায় ধ্বংস হতে বসেছিল এই দেশ, এই মাটি। দেশ আর মাটি কেড়ে নিতে না পারলেও, ওরা কেড়ে নিয়েছে লাখো তাজা প্রাণ! ওদের জন্য আমি হারিয়েছি তোকে, আর তুই হারিয়েছিস সবাইকে। নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকা প্রতিভা দেবীর দুচোখ বেয়ে বয়ে চলেছে যেন দুই নদী।

৪৬ বছর হয়ে গেছে, আজও দুঃস্বপ্নের মত মনে হয় সবকিছুকে। টান টান উত্তেজনায় দিন কাটছিল তখন সবার। ছোট মফস্বল শহরে সবাই সবাইকে চিনত। একে অন্যের বিপদে বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসতো। আশেপাশে বেশ কয়েক হিন্দু বাড়ি ছাড়াও, অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বাস ছিল। সবাই, সবাইকে আশ্বস্ত করে আসছিল। শান্তিরক্ষা কমিটি আর বিহারীদের কল্যাণে প্রথমেই টার্গেট হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। নির্দিষ্ট কিছু বাড়ির আশেপাশে রেকি করা শুরু হয়ে গেল হঠাৎ করেই।

একদিন সন্ধ্যা রাতে প্রভাত বাবুর বন্ধু শ্রেণির দুই তিন জন এসে জানিয়ে গেল, আজ গভীর রাতেই কিছু একটা অঘটন ঘটার আশংকা রয়েছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। এরমধ্যে, প্রভাত বাবুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হানিফ সাহেব বললেন, "বৌদি, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র গুছিয়ে নিন, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। আপনারা আমার বাড়িতে থাকবেন।" এই বলেই তারা বেড়িয়ে গেল বাকীদেরকে সতর্ক করতে। প্রতিভা দেবী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে একবার প্রভাত বাবুর দিকে, আরেকবার ছেলেমেয়ে দুটির দিকে তাকালেন।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে যতটুকু না নিলেই না, ঠিক ততটুকুই গুছিয়ে নিলেন প্রতিভা দেবী আর প্রভাত বাবু। দুঃশ্চিন্তায় বারবার খেই হারিয়ে ফেলছেন তিনি। ছোট ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে এখন তিনি কি করবেন! কোথায় যাবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না! বেশ কিছুদিন থেকেই প্রভাত বাবু ওদের সবাইকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু প্রতিভা দেবী কিছুতেই যেতে রাজি হননি। সবাই একসঙ্গে যাওয়াতেই তার আগ্রহ ছিল। প্রভাত বাবুর বাড়িতে দুইজন সাহায্যকারী থাকত, তাদের মধ্যে মনীশকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে, হাতে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে তার গ্রামের দিকে রওয়ানা করে দিলেন। কিন্তু বাধ সাধল বুড়ি মাসী।

কোনভাবেই তাকে বোঝানো গেল না। বুড়ি মাসীর এক কথা, "মরলে তোমাগো লগেই মরমু, আর বাঁচলেও তোমাগো লগেই!" প্রতিভা দেবী বা প্রভাত বাবু যতই বলে, "মাসী গো আমাদেরই এখন যাওয়া থাকার জায়গা নাই, তোমারে কই নিব!?" ততই বুড়ি মাসী শক্ত করে মাধুর হাত চেপে ধরে। উপায়ন্তর না দেখে অজ্ঞতা বুড়ি মাসীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই হলো। তাছাড়া বুড়িকে ছেড়ে যেতে খুব মনও কেমন করছিল প্রতিভা দেবীর। তিনকূলে কেউ নেইও যে মাসীর।

একটু পরেই হানিফ সাহেব এসে হাজির হয়। "আর দেরী করা যাবে না এক্ষুনি বের হতে হবে", বলেই দুই হাতে দুই মাল নিয়ে সবাইকে তাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসলেন তিনি। চোখের জলে নিজের এতদিনের সংসার, বাড়িঘর সব ভাসিয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে সবাই এসে আশ্রয় নিল হানিফ সাহেবের বাসায়। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।

হানিফ সাহেবের বাড়ির সবাই সাদরে গ্রহণ করলো প্রভাত বাবুর পুরো পরিবারকে। সমস্ত সংকোচ উবে গেল প্রতিভা দেবীর, যখন হানিফ সাহেবের মা বুকে টেনে নিলেন তাকে আর লতিফা ভাবীর আন্তরিকতায় তাকে ভিতর ঘরে নিয়ে গেলেন। এরমধ্যে তিন চার দিন পার হয়ে গেলেও, মিশে গিয়েছিল দুইটি পরিবার এক আত্মায়! রোজ নামাজ শেষে, খালাম্মা দোয়া পড়ে নিজের নাতি নাতনীর সাথে মাধু আর রণকেও ফুঁ দিয়ে দিতেন। এমনকি প্রতিভা দেবীর মাথা ছুঁয়েও দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন, যখন জেনেছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন প্রতিভা দেবী।

হঠাৎ করেই প্রতিভা দেবীর খুব শরীর খারাপ হলো আর এদিকে যেন দেশের পরিস্থিতিও ভয়াবহ থেকে ভয়ংকর আকার ধারণ করছিল। ব্যাপক হারে ধর পাকড় শুরু হয়ে গেল। রাত একটু গভীর হতেই মুখবাধা দুই একজন লোক হানিফ সাহেবের বাড়ি ঘিরে টহল দিয়ে যেত। সব শুনে বুঝে প্রভাত বাবু আর সেখানে থেকে বন্ধুর বিপদ বাড়াতে চাইলেন না। কিন্তু হানিফ সাহেবও নাছোড়বান্ধা। কিছুতেই একা ছাড়বেন না বন্ধু ও তার পরিবারকে। হানিফ সাহেবের বড় ভাইয়ের দুই কলেজ পড়ুয়া ছেলেকেও আর নিজেদের সঙ্গে রাখার সাহস পেলেন না তিনি। অবশেষে দুই ভাইস্তা সঙ্গে করে প্রভাত বাবুর পুরো পরিবারকে ছাড়ার সম্মতি দিলেন তিনি।

খুব অন্ধকার ভোরে সবাই প্রস্তুত হলো বেরিয়ে পরার জন্য। দুই বন্ধুর একে অপরকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কান্না আজও মনে ভাসে প্রতিভা দেবীর। খালাম্মা আর লতিফা ভাবীর আঁচল চাঁপা কান্নার শব্দ এখনো কানে বাজে যেন! সারাটা দিন এদিক সেদিক করে, কখনো হেঁটে, কখনো ভ্যানে চেপে আবার হেঁটে একটা গ্রামের দিকে এসে পৌঁছালেন সবাই। সবাই খুব ক্লান্ত। তার উপর প্রতিভা দেবীর শরীরও খারাপ যাচ্ছিল। একটা জঙ্গেরের কাছাকাছি মত জায়গায় আরও এমন অনেক মানুষের দেখা পেলেন প্রতিভা দেবী আর প্রভাত বাবু। এরা সবাই বাড়িঘর ছেড়ে জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। এই জংগল শেষে এক নদী পার হয়ে যেতে পারলেই নিরাপদ জায়গা পাওয়া যাবে। দুই ভাইও ঘুরে ঘুরে এইসব খবর নিয়ে আসল। সিদ্ধান্ত হলো এদের সঙ্গেই পা মিলাবেন সবাই।

মাধু আর রণ সবসময় ভয়ে কুঁকড়ে থাকত। বুড়ি মাসী মাধুকে আর প্রভাত বাবু রণকে আগলে রাখতেন। চাপা উত্তেজনা আর দুঃশ্চিন্তায় রাতটুকু পাড়ি দিলেন সবাই। সকাল হতেই আবার হাঁটা শুরু করে সবাই। এভাবে একটা সময় দূর থেকে নদীর জল ওদের সবার চোখে চিকচিক ধরায়। সেইসঙ্গে ঘাটে থাকা কয়টি নৌকাও। কি এক আশায় গা হাত পা যেন আর নড়তে চাইছিল না।

ঘাট যত কাছে আসছিল বুকের ধুকপুকানি ঠিক ততই বাড়ছিল যেন সবার। মাধু আর হাঁটতে চাইছিল না, বুড়ি মাসী ওর হাত শক্ত করে ধরে ছেলেখেলার একথা সেকথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে সামনে নিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে রণ এক মুহুর্তের জন্যও বাবার কোল ছাড়েনি। প্রতিভা দেবী সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে না পারায়, একটু পিছিয়ে ছিলেন। আর দুভাই সবার সামনে আগে আগে চলছিল। দেখতে দেখতে পিঁপড়ার মত মানুষ জড়ো হতে থাকল, নদীর কূল ঘেষে। জীবন বাঁচাতে মরিয়া মানুষের দল।

পিছন থেকে ছুটে আসা এক দংগল লোকের ত্রাহি চিৎকারে এত সময় ধরে বোনা স্বপ্ন জাল হঠাৎ করে ছিড়ে গেল সেই মুহুর্তে। তারা চিৎকার করে বলছিল,"মিলিটারি জঙ্গলের ওই পাশের গ্রামে হানা দিয়েছে। তারা জেনে গেছে, এই নদীর তীর ঘেঁষে হাজার মানুষ ওই পাড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার তাগিদ করছে। যেকোন সময়ে হামলা হবে এই ঘাটে।" এসব শুনে অপেক্ষারত মানুষজন জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগবিদিগ ছোটাছুটি শুরু করে দিল। কেউ কেউ দৌড়ে নৌকায় উঠছিল, কেউ ছুটে উল্টো দিকে পালাচ্ছিল, কেউ বা নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল।

প্রভাত বাবু কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। নানা রকম শব্দ আর হুরোহুরি ছুটোছুটিতে সামনে হাঁটতে থাকা বুড়ী মাসী আর মাধুকে ডেকেও কাজ হচ্ছিল না। এদিকে প্রতিভা আর রণ। মাসী শক্ত হাতে মাধুকে ধরে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে নৌকার দিকে। ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলির এক পর্যায়ে কেউ একজন টেনে হিঁচরে মাসী আর মাধুকে নৌকায় তুলে নিল। প্রতিভা দেবী মাধু মাধু চিৎকার করেও মাধুকে ধরতে পারেননি। প্রভাত বাবু, প্রতিভা দেবী আর রণর জায়গা হয়েছিল অন্য এক নৌকাতে তাও অনেক কষ্টেসৃষ্টে! আর দুই ভাই!? কি জানি আদৌ কোন নৌকায় উঠতে পেরেছিল কি তখন একসঙ্গে বা আলাদা! তা আর জানা হয়নি কখনও।

মেয়ের জন্য কেঁদেই চলেছে প্রতিভা দেবী। আর মনে মনে ঈশ্বরকে ডেকে চলেছে। দুই একজন এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে, কোন না কোন নৌকাতেই তো আছে মেয়ে। ওপারে গেলেই দেখা হবে। প্রভাত বাবুও এই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিভা দেবী কোন কিছুই ভাবতে পারছিলেন না। ওইটুকুন মেয়ে, দুদিন ধরে খাওয়াও নেই ঠিকমত। কি যে করছে! মা-বাবা বলে বলে কতই না কাঁদছে! সারারাত নৌকা এক দণ্ডের জন্যও কোথাও থামেনি। আতংকে পিঙল রঙা মানুষের মুখগুলো সেই সময় টাকে আরো ভয়াবহ করে তুলছিল।

কোন ঝামেলা ছাড়াই প্রতিভা দেবীদের নৌকাখানি অবশেষে সেই কাংক্ষিত ঘাটে এসে ভেড়ে। নৌকা থেকে উদ্ভ্রান্তের মত ছিটকে নামেন তিনি। তার শরীর বা শাড়ি কোন দিকেই কোন হুশ ছিল না। তন্ন তন্ন করে মেয়েকে খুঁজতে থাকে দুই জনে মিলে। কেউ বলে ওদিক থেকে আসা এইটাই প্রথম নৌকা। তো কেউ বলে, ভোর রাতে আরও একখান নৌকা এসে ভিড়েছে। যাত্রীরা কেউ কেউ আশেপাশেই আছে, কেউ বা চলে গেছে। অনেকে বাকী নৌকা আসার অপেক্ষায় থাকার উপদেশ দিল।

বেশ কিছু সময় পর আরও দুটি নৌকা পর পর এসে ঘাটে ভিড়ল। কিন্তু বিধিবাম, এক নৌকাতেও প্রতিভা দেবীর প্রাণের মেয়ে মাধু নেই! তবে এই নৌকা দুটির যাত্রীরা আরও ভয়াবহ খবর দিল, যা শুনে প্রতিভা দেবী জ্ঞান হারালেন। তারা জানালো, ছেড়ে আসা অন্যান্য নৌকার মধ্যে দুই একটি মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েছে। আবার দুই একটা নাকি পথ পরিবর্তন করে অন্য দিকে চলে গেছে। কয়টি নৌকা ছিল, কয়টি এসে পৌঁছাল, আর কয়টি বা আসবে বা আসতে পারে সে সম্পর্কে কেউ কোন নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। হিসেব মতে, কারোর দিতে পারার কথাও না!

নদীর পাড়ে, ঘাটের কাছে দিনের পর দিন প্রভাত বাবু আর প্রতিভা দেবী অপেক্ষা করেছেন মাধুকরীর জন্য। প্রতিভা দেবী প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন, বুড়ী মাসীর হাত ধরে মাধু "মা মা" ডাকতে ডাকতে আসছে। ঘুম ভেঙে চিৎকার করে কেঁদে উঠতেন প্রতিভা দেবী। তার এই বুক চাপড়ানো কান্না আর হাহাকার যেন বাতাসে বিষের প্রলয় তোলে। এক মা আজও জানেনা, তার সন্তান কোথায়! বেঁচে আছে না মরে গেছে! মা-বাবাকে হারিয়ে ছোট্ট সেই মেয়েটার ভয়ার্ত মুখখানি ভাবলে, প্রতিভা দেবীর আর কোন ত্যাগের কথাই মাথায় থাকে না। এই সংসার! এই দেশ! এই মাতৃভূমি! কিচ্ছু না!

সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি