ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

গ্রন্থ পর্যালোচনা

বেলা-অবেলার কথা

নূরুল আলম

প্রকাশিত : ১৪:৪৮, ১৪ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৪:৫৯, ১৪ এপ্রিল ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহানের সম্প্রতি একটি বই বেলা-অবেলার কথা শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দফতরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, করেছেন আড্ডাবাজি, করেছেন বিতর্ক, নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বেতারের প্রোগ্রাম, দেখেছেন এত এত সিনেমা আর ঘুরাঘুরি। তাইতো রেজাল্ট দেখে বন্ধুবান্ধব - সুহৃদের নিয়ত জিজ্ঞাসা - আপনি পড়তেন কখন? উনি হাসেন। উনার ভাষ্য- ‘সবার আমি ছাত্র’। ভাবা যায় - চূড়ান্ত সফল একজন অর্থনীতিবিদ-শিক্ষক-লেখক কি সুন্দর করে বলেন - প্রতিটি আড্ডা, প্রতিটি বন্ধু, প্রতিটা বিতর্ক বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উনার ‘বৃহত্তর পাঠ্যসূচি’র অংশ।

পেশাগত জীবনে ঘুরেছেন ৭২ এর উপর দেশ। বক্তৃতা দিয়েছেন এই দেশ থেকে সে দেশ, এই মহাদেশ থেকে - সেই মহাদেশ। আজ নিউইয়র্ক - কাল আফ্রিকা - পরশু সিংগাপুর। কিন্তু বুকের ভিতর বয়ে বেড়িয়েছেন একটা লাল সবুজ পতাকা- ফেলে আসা বন্ধু - ভাই - স্বজন- পাশের বাড়ির দিদি- একটা সময় - একটা জীবন।

তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি। সম্প্রতি বেলা-অবেলার কথা শিরোনামে তার একটি বই বেরিয়েছে। প্রথমা প্রকশনা থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। 

বইটিতে লেখক লিখেছেন-আফ্রিকার সেই অন্ধ শিক্ষিকা যিনি পুত্র -বউমা হারিয়েছেন, প্রিয় বন্ধু রফিক যিনি অকালে হারিয়ে গেছেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া হালিমা বুবু এবং উনার নাকের নথটা, কনে দেখা আলোর লতুদি যিনি অকালে হারিয়ে গেছেন, অসাধারণ প্রতিভাবান ক্যামেরার কবি মিশুক মুনীর - প্রিয় মিশু, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট হারিয়ে যাওয়া সুলতানা আহমেদ খুকু যাঁর হয়ত মেহেদীর রংও মুছেনি তখনও, নাকি সেই সাথে হারিয়ে ফেলা প্রিয় বন্ধু শেখ কামাল!

এছাড়াও এসেছে বন্ধু ড. আতিউর রহমান, দ্বিজেন শর্মা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, আনিসুল হক, নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনসহ বেশ ক’জন নোবেল বিজয়ীর কথা, হেনরি কিসিঞ্জারসহ দেশ বিদেশের জানা অজানা অসংখ্য মানুষ। নিজের কন্যাদ্বয়ের কথা, প্রিয়তমা স্ত্রী বেনুর কথা, মা - বাবার কথা, বাপের ভিটে নোয়াখালীর কথা, বেড়ে উঠা বরিশালের কথা বার বার এসেছে বর্ণনায়- অন্যের মুখের পানে চেয়ে চেয়ে হয়ত অবচেতনে ভালবাসায়।

আজীবন সঙ্গী বেনু এর জন্য সার্বক্ষণিক বেদনা বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠে। কি অবলীলায় বলেছেন- ‘একা কিন্তু একলা না’!! প্রিয় মানুষের জন্য লালিত ভালবাসা যে কোনও মানুষের জন্য নমস্য।

আমি পড়ছিলাম আর গুনছিলাম। সারাটা বইয়ে বলে গেছেন ‘আমাদের কন্যাদ্বয়’, শুধু চারটি জায়গায়
‘আমার কন্যাদ্বয়’ বলেছেন। আজ যদি প্রিয়তমা স্ত্রী শ্রদ্ধেয় বেনু ম্যাডাম জানতেন-খুশির ঝিলিক বাতিতে আলোকিত হতেন নিশ্চিত। আমাদের দেশে কোন পুরুষ ( সফল পুরুষতো বাদই) কখনো ‘আমাদের’ বলে না , বলে ‘আমার’। উনার কন্যাদ্বয় খুশি হবেন জেনে এটা- উনাদের মা উনাদের বাবার মনে কতটুকু জায়গা জুড়ে রয়ে গেছেন এখনও।

শৈশবের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে বর্ণনা দিয়ে গেছেন - এখন এই পরিবেশ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কেন বা কিভাবে - জানি না। ভবিষ্যতে কি হবে - তাও জানি না। আমার একদল বন্ধু বান্ধব আছে যারা বিভিন্ন ধর্মের- কিন্তু আমার অন্তরের খুব কাছের। আমি তাদের জন্য গর্বিত।

এ গদ্য অন্য রকম - ভীষণ চিত্র মনোহর। এটা অর্থনীতির অধ্যাপক বা একজন গবেষকের ভাষা না। এটা উঁচু মাত্রার সাহিত্যিকের ভাষা। কিভাবে বুঝাব! এত সযতনে বাংলিশ শব্দ এড়িয়ে গেছেন - ভাবা যায় না এসময়। লেখার পরতে পরতে এত বিস্ময়, বিষয়ের এত বৈচিত্র্য! ফেইসবুককে লিখেছেন -‘অবয়বপত্র’, সেল্ফিকে লিখেছেন -‘স্বধৃতচিত্র’।

দেশ কাল পাত্র সময় ছাপিয়ে খুঁজে গেছেন হারিয়ে ফেলা প্রিয় মুখগুলো যাদের স্মৃতি এখনো বুকের অন্দরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। কি সুন্দর! কি সুন্দর! একখানি সবুজ দেশ, তার মানচিত্র সব সময় আবেশ ছড়িয়ে আছে উনার বুকে। আর এটা দিল সাহস- তাই ‘তলা বিহীন ঝুড়ি’ এর জনক দুর্দান্ত প্রতাপশালী হেনরি কিসিঞ্জারকেও খোঁচা দিতে পারেন অবলীলায় এক বক্তৃতায় উনার উপস্থিতিতে, অপরপক্ষ থেকে কথা বলার আহ্বান তুড়ি মেরে অস্বীকার করতে পারেন মাথা উচুঁ করে।

‘বিজয় ফুল’ নামে এই দেশ নিয়ে বিদেশে একটা আন্দোলনের কথা বলেছেন যার বিস্তারিত নিয়ে স্যার লিখবেন বলে স্যারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।

নোবেল বিজয়ী শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেন সেলিম জাহান স্যারকে সম্বোধন করেছেন ‘মানব উন্নয়নের হৃদয়’ হিসেবে। সে কবে ডক্টরেট হয়েছেন। কিন্তু বইয়ের পাতায় ড. সেলিম জাহান লেখাতো দেখলাম না। সে কি অসাবধানতা? আমার মনে হয় বিনয়।

বইটি থেকে উদ্ধৃত করলাম মনোহর কিছু লাইন-
‘যে জীবন নিজেকে ছাড়া অন্যকে ভাবেনি; যে জীবন উদ্ভাসিত করেনি অন্য জীবনকে; যে জীবন শুধু নিয়েছে, কিন্তু কিছু দেয়নি, সেটা কি জীবন? যে জীবন ভালবাসা নিয়েছে শুধু, কিন্তু ভালবাসা দেয়নি; যে জীবন নিজের সুখে উল্লসিত হয়েছে, কিন্তু ঈর্ষিত হয়েছে অন্যের আনন্দে; যে জীবন নিজের দুঃখে কাতর হয়েছে, কিন্তু ব্যথিত হয়নি অন্যের বেদনায়, তাকে জীবন বলি কি করে? নিজের জন্য বাঁচি, কিন্তু অন্যের জন্য বেঁচে থাকি, সেটাই তো জীবন।’


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি