ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বৈঠার ছন্দে বেলকুচির সাদেকের বিলে উচ্ছ্বাস

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১২:৪০, ৩ অক্টোবর ২০২০

নদী মাতৃক বাংলাদেশের গ্রামীণ লোক সাংস্কৃতিক সেই ধারাবাহিকতা বুকে ধারণ করে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চাঁদ মিটুয়ানী গ্রামে ষষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ। পৃষ্টপোষকতা করেন বাইচের প্রধান অতিথি সাবেক মন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। 

এ সময় হুরাসাগর নদীর শাখা চাঁদ মিটুয়ানী সাদেকের বিলের বক্ষে ঢাক-ঢোলের বাজনার সাথে তাল মিলিয়ে জারি-সারি ও ধুয়া গানে মাঝিদের জোরে টানো ছন্দময় বৈঠার সে দৃশ্য ছিল অতুলনীয়। ১০টি বড় পানসী নৌকার এ প্রতিযোগিতা দেখতে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ২০ হাজারের বেশি মানুষের আবেগ, উত্তেজনা এবং মুহু-মুহু করতালীতে মুখরিত ছিল পুরো এলাকা। 

গত ২ সপ্তাহ আগে বেলকুচির চাঁদ মিটুয়ানী সাদেকের বিলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে প্রচারনা চালায় গ্রামবাসী। এজন্য বাইচের দিন শুক্রবার ছুটির দিন সকালেই পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, বেলকুচি, উল্লাপাড়া ও পাবনার বেড়া থেকে বিভিন্ন যানবাহনে মিলিত হয় হাজার হাজার মানুষ। 

বেলা ৩টায় শুরু হয় মূল প্রতিযোগিতা। ঘণ্টির ঝনঝনানি, ঢোল, বাদ্যযন্ত্রের তালে-তালে উদ্বুদ্ধ করণদাতাদের ‘জোরসে বল হেইয়ো, আরো জোরে হেইয়ো, বাইয়া যাও হেইয়ো’র ছন্দে ছন্দে মাঝিরা বৈঠা হাতে বেয়ে যায় নৌকা। এ সময় তীরবর্তী স্থানে সমান তালে ছুটে চলে সমর্থকরা। দুই তীরে করতালি, হর্ষধ্বনি পরিশ্রান্ত মাঝিদের উৎসাহ জোগায়। 

এনায়েতপুর থানার রুপনাই সেভেন ষ্টার, পাবনার জনতা এক্সপ্রেস, উল্লাপাড়ার বাংলার বাঘ, বেলকুচির লক্ষিপুরের একতা, শাহজাদপুরের আগ নুকালীর করতোয়া এক্সপ্রেস পানসী নৌকাগুলো ঘিরেই ছিল সবার আগ্রহ। এসব নৌকায় প্রায় অর্ধশত মাঝি-মাল্লা নিয়ে প্রতিযোগি নৌকার সাথে টান শুরু করলে বাধ ভাঙ্গা মানুষের উচ্ছ্বাস আরও বেড়ে যায়।
 
রুপনাইয়ের সেভেন ষ্টার নৌকার তত্ত্বাবধায়ক দুলাল শেখ জানান, ‘জনতার উৎসাহেই আমরা জয় পেয়েছি। ছোট বেলায় দেখেছি বন্যার সময় হলেই চারদিকে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার ধুম পড়তো। কিন্তু এখন আর খুব একটা এ আয়োজন হয় না। তবে লতিফ বিশ্বাস গ্রামীণ ঐতিহ্যকে লালন করে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাকে উৎসাহ দেয়ায় নির্মল আনন্দের এ ধারা আমাদের সিরাজগঞ্জে অব্যাহত রয়েছে।’

এদিকে এই বাইচকে ঘিরে প্রতিযোগিতা স্থলজুড়ে বসেছিল মুখরোচক খাবারের দোকানের মেলা। সেখানেও ছিল নারী-পুরুষ বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। বেলকুচির দৌলতপুরের ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন জুয়েল, শিক্ষক সেলিম রেজা, চরচালা এলাকার ইসমাইল হোসেন শেখ, মেঘুল্লার কামাল আহমেদ, রাজাপুরের শরিফুল ইসলাম জানান, ‘আসলেই নৌকা বাইচের এই বিশাল আয়োজন আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। করোনা মহামারীর সময়ে সবাই যখন আতঙ্কিত ও দুর্দিন বিরাজ করছে সর্বত্র, ঠিক তখনই এই বাইচ প্রতিযোগিতা আমাদের হৃদয়ে নির্মল আনন্দ জুগিয়েছে। শুধু তাই নয়, সকল ভেদাভেদ ভুলে অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য সবাই এক কাতারে মিশে ছিলাম। এই আয়োজনের মাধ্যমে মাদক, যৌতুক, জঙ্গী, সন্ত্রাস বন্ধ করে সবাইকে এক হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করার আহবান জানানোয় পুরো উদ্যোগটি পূর্ণতা পেয়েছে।’
 
এছাড়া ঐতিহ্যের এই বাইচ উপলক্ষে চাঁদ মিটুয়ানী, কলাগাছি, কল্যাণপুরসহ আশপাশের গ্রামের বাড়িতে-বাড়িতে নায়রে আনা হয়েছিল ঝি-বেটিসহ আত্বীয় স্বজনদের। এ যেন ঈদের মতই আরেক আনন্দ। 

এ ব্যাপারে চাঁদ মিটুয়ানী গ্রামের গোলাম আম্বিয়া মাষ্টার, মজনু মিয়া, ও সিদ্দিক মন্ডল জানান, ‘ঈদের আনন্দের মতই ছিল নৌকা বাইচের উৎসব। নৌকা বাইচের আনন্দ আমাদের এলাকার ৮/১০টি গ্রামের মানুষ ৩ দিন উপভোগ করেছে। প্রতি বাড়িতেই স্বজনদের আনা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে হরেক রকমের পিঠা। 
  
খেলায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে স্থানীয় সমাজ সেবক সিরাজুল আলম মাষ্টারের সভাপতিত্বে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী শেখ, ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রশিদ শামীম, আশিকুর রহমান লাজুক বিশ্বাস, দৌলতপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মাসুদ রানা, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গোপাল চন্দ্র প্রামানিক, সাধারণ সম্পাদক কামাল আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষে এই অতিথিরা বিজয়ী ও অংশগ্রহণকারীদের টিভি উপহার দেন।

নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার বিষয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস বলেন, ‘নৌকা উন্নয়ন, অগ্রগতী, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই নৌকাই আখিরাতের কান্ডারী। সেই নৌকা বাইচেরই তারা আয়োজন করেছিল সকল পাপাচারের বিরুদ্ধে। সবার অংশগ্রহণ আমাদের মুগ্ধ করেছে। আগামীতেও বাল্য বিবাহ, সন্ত্রাস, জঙ্গী মুক্ত সোনার বাংলা গড়তে উৎসাহ যোগাতে এই আয়োজন অব্যাহত রাখা হবে।’

এআই//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি