ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভয় নেতিবাচকতা টেনশন একটা মরীচিকা

প্রকাশিত : ১৪:৩৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১১:৩৫, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

লেখক বুদ্ধদেব বসু তার প্রথম যৌবনে থাকতেন ঢাকার পুরানা পল্টনে। তিনি তাঁর একটা গল্পে লিখেছেন, আমরা পুরানা পল্টনে যেখানে থাকতাম সেখানে একটা বটগাছ ছিল।সেই বটগাছে চিলের কান্না শুনে ` ভয় পেতে ভালবাসতাম।` তো দেখা যাচ্ছে, ভয় যে সবসময় ভীতিকর তা কিন্তু নয়। ভয় পেতে অনেক সময় আমাদের ভালোও লাগে। সব আবেগের মতো ভয়কে যদি শিল্পমন্ডিত করে প্রকাশ করা যায়, ভয় তখন মানুষের কাছে প্রাণপ্রিয় না হলেও মোটামুটি উপভোগ্য ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। আমাদের টেনশনও অনেকটা তা-ই।

মানুষ শুধু বলে, টেনশন থেকে বাঁচার উপায় কী। অথচ দেখুন, টেনশন মানুষের অন্যতম প্রিয় জিনিস। এ না হলে আমরা প্রায় বাঁচি-ই না। আমরা ডিটেকটিভ ছবি,সাসপেন্স ছবি, ভূতের ছবি, ভয়ের ছবি এতো দেখি কেন? টেনশনের লোভেই তো। নাটকীয়তা জিনিসটা তো একটা টেনশন-ই। টেনশন জীবনযাপনের এক মজাদার মসলা। নাটকীয়তাহীন জীবন যেমন আটপৌরে, টেনশনহীন মানুষও তেমনি নির্জীব। সবাই জগতে কিছু না কিছু টেনশন করে।টেনশন না থাকলে টেনশন খুঁজে বেড়ায়। চিকিৎসা শাস্ত্রে বলে, সুস্থ থাকার জন্য টেনশন দরকার। বলা হয় মাইন্ড টেনশন ইজ গুড ফর হেলথ।অল্প মাত্রার টেনশন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। জীবনের ভেতর এ উদ্যম জাগিয়ে দেয়।

টেনশন ভালো কিন্তু মাত্রার বেশি হলে এ ক্ষতিকর। যেমন বাঁচতে হলে খেতে হয়। কিন্তু অতি খাওয়া অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। শীতের রাতে আগুন পোহানো আরামদায়ক কিন্তু চুলোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেওয়া নয়। টেনশনও তেমনি। ভয়ও তা-ই। অল্প ভয় আনন্দের কিন্তু বেশি ভয় ভয়াবহ। আমার ধারণা যা কিছু মানুষকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, ভয় তার একটা। আমরা যাদের রিপু বা শত্রু বলি যেমন- কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য এরা সবাই মাঝেমধ্যে আমাদের ক্ষতি করে।কিন্তু ভয় আমাদের ক্ষতি করে প্রতিদিন।সীমা অতিক্রম করে গেলে ভয় সত্যি ভয়ংকর।

ব্যাপারটাকে তাই সীমার মধ্যে রাখতে হবে।সবকিছুর বেলাতেই এ সত্যি। সব ধর্মেই বলা হয়েছে মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা।কিন্তু আমরা সবসময় সীমা লঙ্ঘন করি। জীবনকে পরিপূর্ণ উপভোগের লোভে সীমালঙ্ঘন না করেও পারি না,আবার করেও নির্মম শাস্তি পাই।

পৃথিবীশুদ্ধ মানুষ যে নেতিবাচকতা নিয়ে আজ এতো কথা বলছে, যার হাত থেকে বাঁচার পথ খুঁজছে, সেই নেতিবাচকতার উৎসও কিন্তু ভয়। কখন আমি মানুষের সামনে দাঁড়াতে দেনোমনা করব? ভয় যখন আমাকে দুর্বল করে ফেলবে, তখনই তো।কখন আমি সাহস হারিয়ে ফেলব,মনে হবে আমি পারব না,আমি হেরে যাব ভেঙে পড়ব। যখন ভয় আমার আত্নবিশ্বাস কমিয়ে দেবে, তখনই তো। ভয় আমাদের জন্মান্ধ শক্তিকে নিস্ক্রিয় করে দেয়, চিন্তাভাবনাকে অক্ষম আর ওলট-পালট করে ফেলে। পরিণামে আমরা নেতিবাচক হয়ে পড়ি। হেরে যাই। সুতরাং আসুন আমরা জাগি, উঠে দাঁড়াই।

যেভাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন– ‘মুহূর্তে তুলিয়া শির একত্রে দাঁড়াও দেখি সবে- তেমনিভাবে উন্নতশিরে, পরিপূর্ণ আত্নবিশ্বাসে।’ আসুন মরীচিকা, বিভ্রম আর মায়ায় ভরা অশুভ নেতিবাচকতাকে মোহাম্মদ আলী ক্লে’র মতো বলিষ্ঠ মুষ্ঠাঘাতে উড়িয়ে দিয়ে, ইতিবাচকতার দীপ্র উজ্জল রাজ্যে আমরা হো হো করে হাসি।

ভয় ব্যাপারটা কেমন তা নিয়ে নিজেরই একটা ব্যক্তিগত গল্প বলি। ঘটনাটা সেদিনের। হঠাৎ একটা দাঁতে কনকনে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, দাঁতটার রুট ক্যানাল করতে হবে। দেখতে পাচ্ছি দাঁতের কথা ওঠায় আপনারা অনেকেই মৃদু মৃদু হাসছেন,যেন পৃথিবীতে একমাত্র আমারই দাঁতে ব্যথা হয়। বন্ধুগণ, এ সবারই হয়। আপনাদের অনেকেরই হয়েছে। যাদের হয়নি তারা একটু ধৈর্য ধরুন। আসিতেছে শুভ দিন। সবাই জানেন রুট ক্যানাল করার আগে মাড়ির পেছনে আর দাঁতের গোড়ায় বেশ কটা ইন্জেকশন দিতে হয়। আগেও আমি বহুবার দাঁতের রুট ক্যানাল করিয়েছি। অনেক ইন্জেকশন নিয়েছি। কখনও এ নিয়ে মনে একটা ভয় কোনো দ্বিধা হয়নি।ইন্জেকশন দেওয়ার আগে পরে ডাক্তারদের সঙ্গে নানা ব্যাপার নিয়ে হাসিতামাশাও করেছি।কিন্তু এবার ইন্জেকশনের কথা ভাবতেই আমার ভেতর ভয় শুরু হয়ে গেল।এর কারণ কাগজের একটা খবর।একদিন কাগজ খুলতেই দেখলাম,` দাঁত তুলতে গিয়ে একজনের মৃত্যু`। আর সেটা ঘটেছে দেশের বড় একটি হাসপাতালে। খবরটা পড়তেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।

হঠাৎ মনে হল আমারও তো কিছুদিনের মধ্যেই দাঁত তুলতে হবে। আমিও কি তাহলে ওভাবে....। মনে নানা প্রশ্ন জাগতে লাগল। আচ্ছা, ইন্জেকশন দিতে গিয়ে লোকটা মারা গেল কেন? এনেসথেশিয়াটা কি খারাপ ছিল? রক্তচাপ কি অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল? হ্রদযন্ত্র বন্ধ করে দিয়েছিল? এমনও তো হতে পারে, কোনো নতুন বা শিক্ষানবিস ডাক্তার ইন্জেকশনের ওষুধটাও যদি ওরকম হয়! তাছাড়া কে না জানে, দাঁত মস্তিষ্কের একবারে কাছাকাছি থাকে।

দাঁতে কিছু হলে ধাঁ করে তা মগজে ধরে যায়।এমনও তো কিছু হয়ে যেতে পারে। নানা বাস্তব অবাস্তব দুর্ভাবনায় বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। কেন যেন মনে লাগল, নির্ঘাত রকমই একটা কিছু আমার হবে। পরে দুজন গেলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে। সেখানেও পড়ল মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। কে এক অতিথি মতো ভদ্রলোক হঠাৎ করে ওই খবরটা নিয়েই আলাপ শুরু করলেন। শুনে আরেকজন বলল, আরে, ছেলেটা তো দাঁত তুলতে মারা যায়নি, ইন্জেকশনটা যখন দিচ্ছিল তখনই শেষ হয়ে গেছে। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি তো যাচ্ছি একই ব্যাপারে। ইন্জেকশন দেওয়ার সময় যদি...? কে জানে..? ক্রমাগত ওই বিপদের কল্পনা আমার মাথার ভেতর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল।টেনশন অসহ্য হয়ে উঠলে আপাতত রুট ক্যানাল করা থেকে পালানোর কথা ভাবতে লাগলাম।

ডাক্তারের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট ওই দিনই রাত ন`টায়। সন্ধ্যা ছ`টায় ডাক্তারকে ফোন করে বললাম, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং থাকায় আজ আসতে পারছি না। আরেকদিন আসব। কী করে সেই ভয় থেকে উদ্বার পেয়েছিলাম সেটা অনেক বড় গল্প। কিন্তু দেখুন,কীভাব। ছোট্ট একটা ভয় আমার সাহস গুড়িয়ে দিয়ে আমার আত্নবিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছিল।সামান্য একটা দাঁতের ইন্জেকশন নিতেও আমি অপারগ হয়ে পড়েছিলাম।

ধরা যাক, আপনি কলেজের নাটকে অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।আপনাকে নেওয়া হয়েছে নায়কের রোলে। না,এমনি এমনি নেওয়া হয়নি। নেওয়া হয়েছে আপনি যোগ্য বলেই।আপনার চেহারা ভালো,কন্ঠ ভালো, সংলাপ বলা সুন্দর।এক কথায় সর্বদিক থেকে আপনি নায়কোচিত। রিহার্সাল চলছে জোরেশোরে। আপনি অভিনয়ও করেছেন চমৎকার। কারো মনে সন্দেহ নেই যে, নির্ধারিত দিনে আপনি অসাধারণ অভিনয় করবেন। কিন্তু এদিকে একটা জায়গায় হঠাৎ কিছুটা অসুবিধা দেখা দিতে শুরু করল।অভিনয়ে নাম দেবার পরের দিন থেকেই আপনি যেন বুকের ভেতর একটা মৃদু হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। আওয়াজটা প্রতিদিন অল্প অল্প করে বাড়ছে। খুবই উৎকট সেই শব্দ। টের পেলেন আপনার বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ অতিকায়ভাবে ধুক ধুক করছে।

চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটল অভিনয়ের দিন। মঞ্চে উঠে আপনি টের পেলেন আপনি অদ্ভুতভাবে সংলাপ ভুলে যাচ্ছেন। আপনার অভিনয় খারাপ হচ্ছে। যা কিছু করলে আপনি সেরা অভিনেতা হতে পারতেন, সেগুলো ছাড়া আপনি সবই করছেন।

প্রায় একই রকম ব্যাপার অনেকসময় দেখা যায় বাংলাদেশ ফুটবল টিমের বেলায়। ধরা যাক, বাংলাদেশ কোনো দেশের সঙ্গে ফুটবল খেলছে। বাংলাদেশ দলের একজন খেলোয়াড়কে বারে বারে চোখে পড়ছে।খুব ভালো খেলছে সে।একবার দেখা গেল বিপক্ষ দলের বেশ কজন খেলোয়াড়কে পুরো কাটিয়ে বল নিয়ে ওদিকের গোলকিপারের একেবারে সামনে চলে গেছে সে।এখন তাকে বাধা দেয়ার কেউ নেই,এখন পা দিয়ে আস্তে করে বলটাকে ছুঁয়ে দিলেই গোল।সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ জয়ী।" বাংলাদেশ বাংলাদেশ" ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠবে দেশের কোটি কোটি মানুষের কন্ঠ।

ঠিক সে সময় হঠাৎ কী যে হয়ে গেল আমাদের সেই খেলোয়াড়ের মাথার। যে বলটাকে আস্তে করে ছুঁয়ে দিলেই গোল, সেই বলটাকে নিয়ে সে করে বসলো অদ্ভুত এক কারবার।সে এমন জোরেই কিক করলো যে বলটা গোলবারের ওপর দিয়ে চলে গেল অথবা সেটাকে আলতো করে গোলকিপারের হাতে তুলে দিয়ে বীরদর্পে ফিরে এলো।

কেন হল এটা? ভয়ে।কীসের ভয়? সাফল্যের ভয়।ওরে আব্দুল কুদ্দুস, তুই শেষে কি না নায়কের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করে ফেলবি? এ্যাঁ তুই কিংবা, ওহে খেলোয়াড়, স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ তোর প্রশংসা উদ্বেল হয়ে উঠবে, মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর হবে দেশের দর্শক।গোটা বাংলাদেশ অভিনন্দনে মেতে উঠবে।পত্রপত্রিকা তোর রঙিন ছবিতে ভরে যাবে। সারাদেশ তো জয়ধ্বনি করবে! এত বিরাট মানসিক চাপ সে সহ্য করতে পারে না। যে এর আগে জীবনে কোনদিন বড় কিছু পায়নি,এত বড় বিরাট প্রাপ্তির চাপ সে কী করে সহ্য করবে। ফলে যা করার তার ঠিক উল্টোটা করে সে ফিরে আসে। একজন অভুক্ত মানুষ, যে অনেকদিন খেতে পায়নি তার সামনে যদি পৃথিবীর সব সেরা খাবার সাজিয়ে রেখে হঠাৎ বলেন, এসব শুধু তোমার, শুধু তোমার জন্য, ঝটপঁট সাবড়ে ফেলো তো এগুলো। তাহলে সে যেভাবে দিশেহারা হয়ে পড়বে, ভয় আর অবিশ্বাস নিয়ে যেভাবে পালিয়ে যাবে,আত্নবিশ্বাসহীন মানুষদেরও হয় ঠিক সেই অবস্থা।যুগ যুগের অপ্রাপ্তি,পরাজয়,আতঙ্ক আর অবিশ্বাস তাকে এভাবে গুঁড়িয়ে ছোট করে রেখেছে যে,সামনে কোনো ন্যায্য প্রাপ্তি বা সাফল্য এলেও নিজেকে সে তার যোগ্য ভাবতে পারে না।

এ ধরনের ভয়কে বাড়তে দিলে তা আমাদের ধীরে ধীরে নিস্ক্রিয় করে তোলে।আমাদের মধ্যে হীনমন্যতা দেখা দেয়।আমরা সবকিছুর ওপর ভরসা হারিয়ে নেতিবাচক হয়ে উঠি।কিন্তু যদি খেলায় এক দুই করে জয় শুরু হয়, বা অভিনয়ে সাফল্য আসতে শুরু করে তবে সেই খেলোয়াড়ের মতো আমাদেরও আত্নবিশ্বাস বেড়ে যায়, নিজেদের আমরা অসম্ভবের নায়ক বলে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি।তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা নেতিবাচক হয়ে উঠি ভর, আত্নবিশ্বাসের অভাবে। এই ভয় থেকে বের হওয়ার প্রধান উপায় হল কাজের জগতে ক্লান্তিহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। জীবনকে আক্রমণ করা। তা থেকে সাফল্য ছিঁড়ে আনা। ভয়ের ওই অশুভ প্রেতটাকে ঝেঁটিয়ে আমরা যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি তবে আমরা বিশ্বরাজ্যের রাজা।আমরা সফল,দুর্নিবার।

ভয় আমাদের নানা ভাবে ক্ষতি করে। আজও বহু মানুষ আছে যারা প্লেনে উঠতে ভয় পাই। ওড়ার প্রযুক্তিটির ব্যাপারে জ্ঞান না থাকার কারণে এটা হয়।সেজন্য দেখবেন এদেশ থেকে যখন কেউ হজে বা বিদেশে যায় তখন গ্রামশুদ্ধ আত্নীয়স্বজন এয়ারপোর্টে এসে হাজির হয়।মনে হয় যেন ফুল মাল্য দিয়ে একেবারে চিরবিদায় দিতে এসেছে। ভাবখানা এমন যে জিনিসে উঠছে, ওতে উঠে কেউ কি আর জ্যান্ত ফিরে আসে?

আমার নিজেরও এই ভয় ছিলো। দেশের ভেতরে প্লেনে তবু ওঠা যায়, ওটা আকাশে উঠতে না উঠতেই নেমে পড়ে।কিন্তু যখন প্রথম বিদেশে গেলাম, মনে হল, প্লেন চলছে তো চলছেই... থামার কোন মতলব নেই দেখছি! যত সময় যায় তত আতঙ্ক বাড়ে। এ কি আর কোনোদিন নামবে নাকি? প্রথমবার বিদেশযাত্রার আগে এ আতঙ্ক এমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে, যাত্রার দিন পনেরো আগে থেকে আমি প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। প্রথম রাতে দেখলাম আমাদের প্লেনটা হঠাৎ সোজা ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে একসময় প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে চারপাশে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো।এরকম দিনের দুঃস্বপ্ন একটা আরেকটের চাইতে ভয়ংকর। আমি তখন এ ব্যাপারে পড়াশোনা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে জানলাম প্লেনগুলি একেকটা এক থেকে দুশ’ টন ওজনের। এখন প্রশ্ন ১৮০ টনের প্লেন আকাশে ওড়ে কী করে? কী করে এ সম্ভব? যার অর্থ একটাই আসলে ওগুলো উড়ছে না, নিচের দিকে পড়ছে। ভয়ে আমি আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম।তার ওপর ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, প্লেন নামলেও প্লেনের চাকা অনেক সময় নামে না। আবার পেছনের চাকা নেমেছে তো সামনের চাকা নামার হদিস নেই। নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় মন দিশেহারা হয়ে উঠল। অনেক মানুষের মধ্যেই কিন্তু এ ধরনের বিচিএ রকমের ভয় আছে। পৃথিবীর ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী মাও সেতুং। অথচ প্লেনে ওঠার ভয়ে কোনদিন চীনের বাইরে যাননি তিনি। প্লেনের মতো এমনি আরও কত ধরনের ভয় যে আছে পৃথিবীতে।

নিজের ভেতরে ইতিবাচকতা বাড়াতে আমি একটা পদ্ধতি অনুসরণ করি। আমি কল্পনা করি বিশাল মহাশূন্যে দুটো গোল বেলুন ভাসছে- একটা সাদা একটা কালো।সাদাটা তুলনামুলক বড়।ওটা হলো ইতিবাচকের প্রতীক।কালোটা নেতিবাচকতার,ওটা কালো।একসময় ঝটকায় আমি কালো বেলুনটাকে আকাশ থেকে মুছে দেই।কালো বেলুন বলে তখন আর সেখানে কিছু নেই।।আছে কেবল সাদাটা।অর্থাৎ সারা আকাশজুড়ে রয়েছে শুধু ইতিবাচকতা,উজ্জলতা আর আলো। শেষ অবধি ইতিবাচকতা জীবনকে বাঁচায়। এর মধ্য দিয়ে আমরা হয়ে উঠি নিজেদের অধীশ্বর। ওই যে মেডিটেশনে বলা হয় - বলুন ‘আমি এক অনন্য মানুষ,আমার অসাধ্য কিছু নেই’ এসব বলতে বলা হয় সেজন্যই।

পৃথিবীতে খারাপের চেয়ে ভালো অনেক বেশি। না হলে জগৎ ধসে পড়ত।

সুতরাং যে ইতিবাচকতা জগতকে ধারণ করছে, বিশ্বচরাচরকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে, তা-ই হোক আমাদের নিয়তি। আসুন একে আমরা বিশ্বাস করি, এর জন্য সংগ্রাম করি।এ দিয়ে তৈরি হোক জীবনের বিজয় স্তম্ভ।আমরা প্রায় বলি কাজ হচ্ছে গঙ্গাজল। কাজের মধ্যে বেঁচে থাকা মানে জীবনোল্লাসের মধ্যে বেঁচে থাকা।নেতিবাচকতা তখন আর স্পর্শ করতে পারে না।আসুন সেই স্বপ্নে আমরা উজ্জীবিত থাকি,কাজের মধ্যে বেঁচে থাকি।

লেখক : অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা

**ভাঙো দুর্দশার চক্র বই থেকে নেওয়া।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি