ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে সংসার করা হলো না

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৩২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৩১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীবের প্রতি ভালোবাসা। মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মানুষের সুখে নিজে সুখী হওয়া। তাঁদের দুঃখে নিজে দুঃখী হওয়া। পঙ্গুত্ব বরণ করে হাঁসতে ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর মুখে হাঁসি ফিরিয়ে আনা। কঠিন ও দূরারোগ্য রোগীকে সেবা দেওয়া। নতুন করে তাদের চোখে বাঁচার স্বপ্ন বোনা। জীবনের ৭৪টি বছরের মধ্যে ৪৭ বছর নিঃস্বার্থভাবে একনাগাড়ে সেবা দেওয়া। শুধুমাত্র ভালোবাসার খাতিরে মানবতার সেবাই কয়জন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব?

সবার পক্ষে সম্ভব হোক আর না হোক বাংলাদেশের অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য অসাধ্য এ কাজটি সাধন করছেন ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এক মানবতাবাদী নারী। মানুষের প্রতি সেবা ও ভালোবাসা দেওয়ার জন্য অনেকে তাকে দ্বিতীয় মাদার তেরেসা খেতাবে ভূষিত করেছেন।

ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে জন্মেও যিনি উন্নত নাগরিক সেবার সব কিছু তুচ্ছ করে জীবনের ৪৭টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন মানুষের সেবায়। মানুষের তরে ভালোবাসা বিলাতে গিয়ে দীর্ঘ এ জীবনে আজও স্বামী, সংসার এমনকি ভোগবিলাসের কোন মোহ যাকে স্পর্শ করতে পরেনি। তিনি আর কোন দ্বিতীয় মহামানবী নন, তিনি ভ্যালরি টেইলর।

পার্থিব যৌলুসের সবকিছু ভুলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রতিবন্ধীদের সেবায় যিনি গড়ে তুলেছেন চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘সিআরপি’, যেখান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগী সেবা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসছেন।

মানবতাবাদী এ নারী ১৯৪৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের ব্রুসলিতে জন্ম নেন। উইলিয়াম টেইলর এবং মেরি টেইলর দম্পত্তির সংসারে তিনি জন্ম নেন। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এ মানবতাবাদী ডাক্তার মানুষকে সেবা দেয়ার মন্ত্রে ১৯৬৯ সালে এসেছিলেন বাংলাদেশে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর নিজ দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কিন্তু মানবতার প্রবল ডাকের কারণে তাকে বেশিদিন যুক্তরাজ্যের শিকল বাঁধতে পারেনি। এ পরম সম্পদকে রাখতে পারেনি ইংল্যান্ড।

তাই ১৯৭২ সালে আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। রক্তাক্ত-পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের ফিজিওথেরাপি দিতে।কেউ তাকে ডেকে আনেনি। তবু তিনি চলে এসেছিলেন। সেই যে বাংলাদেশে তিনি এলেন আর কখনও তিনি ফিরে যাননি। কেননা তার হৃদয়ে আছে শুধুই মাবনসেবা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আর মনের এ অকৃত্তিম ভালোবাসায় এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানুষকে স্থান দিযে ফেলেছেন তিনি।

তাই ইংল্যান্ডে না গিয়ে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী রোগীদের সেবায় স্বেচ্ছাশ্রম বিলাতে যোগ দেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। অনেক চড়াই উৎরায় পেরিয়ে ১৯৭৯ সালে অনেক কাকুতি মিনতির পর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিত্যক্ত গুদাম ঘরখানি পেলেন। ঝেড়েমুছে শুরু করলেন একটা ছোট, খুবই ছোট ফিজিওথেরাপির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন(সি.আর.পি)।

প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন। প্রতিষ্ঠান আছে, অফিস আছে, ডাক্তার আছে। নেই কোন চিকিৎসার সরঞ্জাম। নেই কোন রোগীর বেড। নেই ন্যুনতম কোন সুযোগ-সুবিধা। তাই সাইকেল চেপে ঘুরতে লাগলেন দূয়ারে দূয়ারে। মাথা নিচু করলেন, হাত পাতলেন, অপমানিত হলেন, গঞ্জনা সইলেন, হতাশ হলেন। তবু হাল ছাড়লেন না। নিজের জন্য নয়, সেই বিদেশী নারী সব করলেন আমাদের জন্য। বাংলাদেশের মানুষের জন্য। 

মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে থাকা কিশোরী, বাবার কাধে ভর করে চলা চলন শক্তিহীন তরুণ, বাড়ি ফেরার পথে দূর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গু হওয়া পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোক যখন ব্যথা-যন্ত্রণা-দুর্বিসহ জীবন নিয়ে কাতরাতো। তখন তাদের দুঃখে কাঁদতেন টেইলরও। এরপর দিনরাত তাদের জন্য শ্রম দিতে লাগলেন।  সুস্থ্য করে তুললেন বেশ কয়েকজনকে।

ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো। একইসঙ্গে ছোট্ট এ জায়গায় তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়াও দূরূহ হয়ে দাঁড়ালো। রোগীদের দুর্ভোগ লাগবে এরপর ভাড়া বাড়ি খুঁজে খুঁজে হলেন হয়রান। যুক্তরাজ্যে নিজের সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে আনা টাকায় গড়ে তুললেন সি.আর.পি। ভাড়া বাড়িতেই শুরু করলেন নিজের হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি।

এভাবেই একদিন মহীরুহ হয়ে বাংলাদেশের বুকে সগর্বে দাঁড়িয়ে গেল সি.আর.পি। সি.আর.পি পরিণত হলো দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠানে, যেখানে ঠাঁই হলো মেরুদন্ড ভাঙা অসহায় মানুষের, ক্রাচে ভর করে চলা, বুকে হেঁটে চলা, উবু হয়ে চলা, গড়িয়ে চলা অজস্র মানুষের। আর তাঁদের নিয়েই নিজের সংসার পাতলেন মানবতাবাদী একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এ নারী।

ক্লান্তিহীন এ চলার পথে পিছু ফিরে একদিন তাকলেন সেই নারী। দেখলেন সেই টগবগে সাদা সফেদ ইংলিশ ম্যামটি আর তিনি নেই। ইতোমধ্যে কেটে গেছে ৭৪টি বছর।গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। চেহারা তার লাবণ্যতা হারিয়েছে। চুল শুভ্র হয়ে গেছে। গ্রীবার হাড় বেরিয়ে গেছে। সুটাম উৎকৃষ্ট শরীরে বার্ধক্য ছায়া ফেলছে। তিনি প্রৌড়াতে রূপান্তরিত হয়েছেন। তবে মনোবলে আজও তিনি সেই তারুণ্যের ছায়া দেখতে পান। আজও স্বপ্ন দেখেন অনেক দিন এ দুর্ভাগা মানুষদের সেবা দিয়ে যেতে পারবেন। চাওয়ার সবইতো হলো। হলোনা কেবল ভালবাসার মানুষকে নিয়ে একটি গড় সুখের সংসার। মানুষের সেবায় নিজের প্রেমিককে স্বেচ্ছায় বিদায় জানিয়ে বেঁছে নিয়েছেন এই সংসারকে। হয়তো দুজনের কোন সংসার তিনি গড়েননি। 

তবে আজ তাঁর সংসারে শত শত সদস্য। সব সদস্যর-ই যেন মা তিনি। ইতোমধ্যে দুইটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন তিনি। মেয়ে দুইটিও পঙ্গুত্ব আর পক্ষাঘাতগ্রস্তে জর্জরিত। সবার মতোই তাদেরকে কাজ শেখালেন তিনি, তারপর চাকরি দিলেন সি.আর.পিতে। দত্তক দুই মেয়ে নিয়েই তার এখন সংসার।

সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের কাছে নিজের পথচলার গল্প তুলে ধরেন মানবতাবাদীদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করা শত মায়ের এ জননী। নিজের সংসার, লক্ষ্য নিয়ে তিনি বলেনম ‘অবিরাম সেবা দিতে গিয়ে কখনও ভাবতে পারিনি স্বামী ও সংসার নামক সামাজিক বন্ধনের কোন কিছু। আমিই সেই ভ্যালরি টেইলর। যার জীবন জুড়ে আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মানুষের জন্য সেবা। আই লাইক সিআরপি, আই লাভ সিআরপি এন্ড আই ম্যারি সিআরপি( আমি সিআরপিকে পছন্দ করি, ভালবাসি, এবং একেই বিয়ে করেছি।) জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই সিআরপির সঙ্গেই থাকবো। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরেও যেন দূরাকাশের তারা হয়ে আমি এই সি.আর.পিকে দেখতে পারি সেই দোয়া স্রষ্টার কাছে।’


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি