ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

লেখকের কথা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:৩৯, ১৮ আগস্ট ২০১৮

গেল একুশে বইমেলার ঘটনা।
পরিচিত এক ছোট ভাই ইনবক্সে স্যাড ইমো পাঠাল।
জানতে চাইলাম, `কি রে মন খারাপ?`
জবাব এলো, হু।
`কেন রে?`
কয়েক মুহুর্ত কেটে গেলেও কৌতুহলী এই প্রশ্নের আর উত্তর এল না। তারপর এলো ফোন। সেই ছোট ভাই। মিনিট দশেকের আলাপ। দুঃখজাগানিয়া গল্প। সে আলাপের সারাংশ বলার আগে ওর সম্পর্কে দুটো কথা বলে নেই।

ছেলেটা পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়ে। বন্ধুরা যখন ফেসবুকে প্রেমের তুবড়ি ছোটায়, ও তখন রাত জেগে গল্প লেখে। মেলায় একখানা উপন্যাসও ছাপিয়ে ফেলেছে। লেখার হাত খারাপ না। সম্ভাবনা আছে। লেগে থাকলে হয়তো পারবে।

কয়েক মিনিটের সে ফোনালাপে কাঁদো কাঁদো গলায় ছেলেটা জানাল, বই প্রকাশ করার পর অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা সে নিতে পারছে না। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাই তাকে এড়িয়ে চলছে। একজনও নাকি বই কেনেনি। বছরজুড়ে নানা রকম কাজ করিয়ে নেওয়া আপুটা মেলায় ঘুরে ঘুরে অন্য দশটা বই কেনে। ওর স্টলমুখো হয় না। নিজের ক্লাসে শতাধিক শিক্ষার্থী। এদের কেউ বই কেনা দূরে থাক, জানতেও চায় না মেলার খবর! অথচ ছেলেটার ধারণা ছিল বন্ধু-পরিচিতজনরাই কয়েকদিনে প্রথম সংস্করণ শেষ করে ফেলবে !

আমি চুপচাপ ছেলেটার কথা শুনলাম।
তারপর নিজের জীবনের একটা গল্প বললাম। বেদনার গল্প, একাকিত্ত্বের গল্প। আমার প্রথম গল্পের বই `উড়ে যায় নীল টিপ` প্রকাশকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের মাস্টার্সে পড়ি। ক্লাসে প্রায় তিন শ` শিক্ষার্থী। অথচ গুটিকয় ঘনিষ্ট বন্ধু ছাড়া কেউ-ই বইটা কেনেনি। বিতর্ক-সংবাদিকতা করায় ততোদিনে বহু চেনাজানা। সারা বছর নানা মানুষের উপকার করি। আমন্ত্রণ জানিয়েও এদের কেউকে আমার স্টলমুখো করা যায়নি!
আচমকা এদের কারো সঙ্গে বইমেলাতে দেখা হলে, বই কেমন যাচ্ছে- জানতে চেয়ে মুহুর্তেই ঢুকে যেত আরেক স্টলে। বই আর কিনত না। ওদের কথা কি বলব, আমারই লজ্জা লাগত!

স্বপ্নপূরণে কাছের মানুষদের এমন অবহেলা মন ভেঙ্গে দিল। বইটা ঠিকই কিনল স্বল্প চেনাজানা ভার্চুয়াল বন্ধুরা। এরপর
ধীরে ধীরে আমার পাঠক বাড়তে লাগল। দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও। কালচক্র আমাকে শক্ত ভিত্তি এনে দিল। ফেসবুকে সে খবর পৌঁছে গেল ক্লাসমেটদের কাছে, সেইসব কাছের মানুষদের কাছেও। বই না পড়েই তারা মাঝে মাঝে ইনবক্স করত। তুমি তো দেখি ভালোই লিখছ!
এমন কান্ডে হাসি পেত। পরবর্তীতে এদের কেউ কেউ মেলায় আসতে শুরু করল। বইও কিনতে শুরু করল।

মনে পড়ে, প্রথম আলোয় ৭০তম জন্মদিনের বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে সেলিনা হোসেন যেদিন কালচক্রের প্রশংসা করলেন, আমাকে সময়ের সম্ভাবনাময় লেখক বললেন, শুরুর দিনগুলিতে উপেক্ষা করা, পাশে না থাকা বহুজনই দেখলাম ফোন করল। গর্বিত লিখে পোষ্ট দিল ফেসবুকে!

জীবন এমনই। এমনই সাফল্যের কাঙাল। এখানে পরাজিতের স্থান নেই, নেই সম্ভাবনারও। ডিম ফুটে একদিন বাচ্চা বেরোবে- এ আশায় বসে থাকা লোকের সংখ্যা এখন কম। বাচ্চা ফুটেছে, পারলে দৌড়ায়- এতেই আস্থা সবার।
ফলে দিনশেষে আপনাকে করে দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন মানুষের বাহবা জুটবে না। জুটলেও তা শেষ প্রান্তে, যখন আরো বহু মানুষ বাহবা দিতে শুরু করবে।

অথচ গল্পগুলো উল্টো হওয়ার কথা।
যারা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেন, পশ্চিমের আকাশে দেখেন সোনার সিংহ, তারা অনেকটা দূর্লভ ফুল বা দামি ক্যকটাসের মতো। ক্যকটাসের যেমন বাড়তি যত্ন নিতে হয়, ছাগলে না খায় ভয়ে বেড়া দিতে হয় ফুলগাছে, তেমনি শিল্প-সাহিত্যের দূর্গম পথে একাকি হেঁটেচলা লোকগুলোরও বাড়তি যত্ন লাগে। লাগে কাছের মানুষদের মমতা আর ভালোবাসাও। না হলে শিল্পসত্ত্বা বিকশিত হওয়া দূরে থাক, অনুভূতিগুলো শুকিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মরেও যায় একদিন।

একটা ঘটনা বলে শেষ করি।
বছর দশেক আগের এক বিকেল। খুলনা শহরের অলিতে-গলিতে সাইকেলে চেপে পোস্টার সাঁটাচ্ছে এক যুবক। দাঁড়িয়ে থেকে সেই পোস্টার পড়লাম। কবিতার বই বেরিয়েছে কারো। ছবিসহ তারই খবর। জানতে চাইলাম, ভাই কবিতা লেখেন নাকি?
জবাব এলো, `নারে ভাই।`
`তাহলে কার বই, কার পোস্টার?`


লোকটা কাচুমাচু ভঙিতে বলল, `আরে আমার বাল্যবন্ধু। বিএল কলেজে পড়ে। কবিতা-টবিতা লেখে। একখান বইও বাইর করিছে। এসব কাজে তো কেউ উৎসাহ দেয় না। ভাবলাম ওরে উৎসাহ দেওয়া দরকার। আমাগের আবার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা। পোস্টার ছাপায়া দিলাম। লাগাবি কিডা? নিজেই নাইমে পড়লাম। বন্ধু মানুষ। কবিতা লেখে। লোকজন জানুক। এই অারকি!`
মুগ্ধতায় চোখে জল আসার জোগাড়।

নিত্য দিনের বহুরঙা বেদনায় হামেশাই চোখ ঝাপসা হলেও মুগ্ধতায় ঝাপসা হবার এমন ঘটনাগুলো আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে!

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি