ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

শ্যামার গানে নজরুল

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:১৫, ২৭ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১০:১৬, ২৭ আগস্ট ২০১৯

নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা করেছেন এবং অধিকাংশের সুর নিজেই করেছেন, যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা ‘নজরুল গীতি’ নামে পরিচিত, যার বড় একটি অংশই শ্যামা সঙ্গীত। শাক্তসঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘রাঙা-জবা’। ১৯৬৬ সালে ১০০টি শ্যামাসঙ্গীতে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত। এছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে নজরুল ইসলামের আরো শতাধিক শাক্তগীতি ও শ্যামাসংগীত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক মালায় গাঁথার অপেক্ষায়।

বাংলা শাক্ত সঙ্গীত বা শ্যামার গানে নজরুল যে স্বাতন্ত্র্যের রূপ দেখিয়েছেন, সেখানে কালী শক্তির দেবী অপেক্ষা দেশমাতারূপে প্রধানতঃ রূপায়িত হয়েছে। ১৮৬৭ সালে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার আগে তেমন কোনো গানের চিহ্নই পাওয়া যায় না দেশমাতৃকার বন্দনারূপে। স্বদেশী গানে দেশকে ‘মা’, ‘মাতা’ সম্বোধন করে তৎকালে বহুগান রচিত হয়েছে। নজরুলের শ্যামাসংগীত মূলতঃ সেখান থেকেই শুরু। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো অন্যান্য গীতিকারদের স্বদেশী গানের মধ্যে সরাসরি দেশকে বিষয় করে পদ রচিত হয়েছে, আর নজরুল শ্যামাসংগীত নাম প্রচলিত গানের মধ্যে এনেছেন প্রত্যক্ষ স্বদেশীয়ানা। এর সাথে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ রূপ জনমানসকে সরাসরি বিপ্লবী ও প্রতিবাদী করে তুলতে সাহায্য করেছিল। তাই তিনি প্রতীক আকারে বেছে নিয়েছিলেন শ্যামাকে, যিনি অশুভনাশিনী পরাক্রমশক্তি। সর্বোপরি তিনি শ্যামাকে তাঁর অসংখ্য গানে বিভিন্ন রূপ ও চরিত্রে, ভাবে ও প্রেমে দাঁড় করিয়েছেন।

উদাহরণস্বরূপ, নজরুলের একটি গানেই হয়ত কালীকে বিভিন্নরূপে তিনি দেখছেন :

‘আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।
(তুই) কালি দিয়ে লিখলি হিসাব কেতাব পুঁথি, শিখলি পড়া,
তোর মাঠে ফসল ফুল ফোটালো কালো মেঘের কালি-ঝরা।
তোর চোখে জ্বলে কালির কালো, তাই জগতে দেখিস আলো
(কালী)-প্রসাদ গুণে সেই আলো তুই হূদ-পদ্মে দেখবি কবে?’

এই গানে ‘কালী’ শব্দটিকে গুরুত্ব প্রদান করে দেশপ্রেমের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন কবি। কালি অর্থে বিদ্যার আধার কলমের কালি, কালী অর্থে দেবী মহামায়া, ভূমি ও স্বদেশ আবার কালি অর্থে জল- জীবন ও জীবিকার উপাদান। এই গানটি যমক অলংকারের একটি সুন্দর উদাহরণ (কালি -কালী) রূপেও বাংলা কাব্য-গীতিতে বিশেষ স্থান দাবি করে। (কৃতজ্ঞতা স্বীকার: তত্ত্বকথা - সাইম রানা)
নজরুল দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিমে বিভাজিত সে সময়কার ভারতীয় সমাজে। মুসলিম হওয়ার কারণে হিন্দুদের একটা শ্রেণী নজরুলকে বিজাতি মনে করত। ঠিক একইভাবে একশ্রেণীর মুসলমান নজরুলকে বিজাতি ঘোষণা করেছিল, কারণ ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতি নজরুলের আগ্রহ। কিন্তু এত বিরোধিতার মধ্যেও দিগভ্রষ্ট না হয়ে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন, মনেপ্রাণে থেকেছেন শুধু ‘মানুষ’ হয়ে। তৎকালীন ভারতবর্ষের অবস্থা উত্তাল, একদিকে বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি। বিশ্বময় পুঁজিবাদী দেশগুলোর আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। এমন উত্তাল সময়ে প্রতিবাদই ছিল নজরুলের একমাত্র ভাষা। সে সময় ‘শাক্তদর্শন’ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল নজরুলকে। কিন্তু নজরুলের কবিতা ও গানে মা এলেন শ্বেতাঙ্গ অসুর-রাজের বিরুদ্ধে ভারতের যুব-রক্ত টগবগিয়ে ফুটিয়ে তুলতে, শক্তিদায়িনী, ত্রাণকর্ত্রী-রূপে।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে, চণ্ডী বা দুর্গাদেবীরই একটি বিশেষ রূপ হল ‘কালী’ বা শ্যামা। বৌদ্ধ বজ্রযান তন্ত্রসাধনায় হয়ত এর ডাকিনী-যোগিনী রূপ ছিল, চণ্ডীতে মুণ্ডমালিনী দিগ্‌বসনা যুদ্ধরতা ‘শ্যামা মা’ রূপে যাঁর রূপের আলংকারিক ব্যাখ্যা নজরুল তাঁকে এক অনন্য ভাবে এঁকেছেন-

‘... মা গো, তোমাকে না পেয়ে লোকে লোকে
যে অশ্রু ঝরেছে মোর চোখে,
সেই আঁখিজল জবাফুল হয়ে শোভা পেতে ওই চরণে চায়।।
মা গো, কত অপরাধ করেছিনু বুঝি, সংহার করি সে অপরাধ,
বল লীলাময়ি মিটেছে কি তোর মুণ্ডমালিকা পরার সাধ?
যে ভক্তি পায়নি চরণতল, আজ কি তা হল গঙ্গাজল!
মোর মুক্তির আশা মুক্তকেশী গো
এলোকেশ হয়ে পায়ে লুটায়।।’

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, আবেগের গভীরতা। কেউ কেউ মনে করেন, নজরুল হৃদয়ের গভীর থেকে শ্যামার প্রতি ভক্তি নিবেদন করেছিলেন। আর সে ভক্তি সাকার হয়েছিল তার গানের ভাষাতে। তিনি লিখেছিলেন-

‘ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।’

মোট কথা নজরুলের হাতে শ্যামাসঙ্গীতের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে। শক্তির দেবী কালীকে একদিকে যেমন তিনি লোলরসনা রণরঙ্গিনী মূর্তিতে আহবান করেছেন, অন্যদিকে তাঁকেই কখনো স্নেহময়ী জননী আবার কখনও বা দুরন্ত উচ্ছলা কন্যারূপে কল্পনা করেছেন।

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি