ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সৈয়দ হকের অপ্রকাশিত কথা পাঠ-১

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৬, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১১:৩৪, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

আজ ২৭ ডিসেম্বর। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ৮২তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৯৩৫ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

দীর্ঘ বাষট্টি বছর লেখালেখির জীবনে সৈয়দ শামুসল হক কবিতা, গল্প, উপস্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চলচ্চিত্র, অনুবাদ, কাব্যনাট্য, গান রচনাসহ সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে সব্যসাচী লেখকের পুরোধা ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সাহিত্য চর্চা ও লেখালেখির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার সাক্ষর রাখেন। 

লেখালেখির জন্য তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কবি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

কবির ৮২তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তার অপ্রকাশিত কিছু কথা একুশে টিভি অনলাইনের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আজ প্রথম নয়, এর আগেও আমি এসেছি। আমার একটি জিনিস সবচেয়ে ভালোলাগে যে বাংলাদেশের মানুষ সহমর্মিতা এবং মানুষকে সহায়তার ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী।

রক্তদান সম্পর্কে তিনি বলেন, কোরআনে বলা হয়েছে যে, একজন মানুষকে  বাচাঁলে বা প্রাণ রক্ষা করতে পারলে সব মানব জাতিকেই যেন বাচাঁনো হলো। যারা রক্তদান করে মানুষের জীবন বাচাঁচ্ছেন তারা যেন সমগ্র মানব জাতিকে বাচাঁনোর পূণ্য অর্জন করছেন।

তাই সমগ্র মানুষের প্রতি আমার জীবনের মতই ভালোবাসা প্রদর্শন করতেই হবে। আমি দেখে খুবই আনন্দিত যে, এতগুলো মানুষ এই স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং আজকে তারা সংবর্ধিত হতে যাচ্ছেন।

আর রক্তদান সম্পর্কে আমি সচেতন হই আজ থেকে ২৪ বছর আগে যখন আমার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয় লন্ডনে। সেই সময় ডাক্তাররা আমার জন্য ৯ ব্যাগ রক্তের কথা বলেছিলেন। আমি অপারেশনে যাবার আগে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, রক্তের ব্যবস্থা কিভাবে হচ্ছে?

তখন আমার স্ত্রী বলেছিলেন, বারান্দায় তাকিয়ে দেখো। তখন বারান্দায় তাকিয়ে দেখি প্রবাসী বাঙালি কুড়ি পঁচিশজন শীতের ভেতরে অপেক্ষা করছে রক্ত দেওয়ার জন্য। সেই প্রথম আমি অনুভব করি মানুষ মানুষের জন্য কতটা ভাবলে, এ রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগ পূর্ণ অবস্থার ভেতরেও স্বেচ্ছায় এসে উপস্থিত হলেন রক্ত দেওয়ার জন্য।

তার পর তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আমি যখন আপনাদের দিকে তাকাই তখন আমার সেই দৃশ্যের কথা মনে পরে।

এই যে, মানুষকে বাঁচানো, এটি দেখে আমরা বুঝবো মানবজীবনকে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দিই। আমাদের কবি তো বলেছেন, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই। আবার দেখুন লালন বলেছেন, ‘এমন মানব জনম আরকি হবে?’

সত্যিই তো এমন মানব জনম আর হবে না। আর মানব জনম আর হবে না শুধু  এখানেই কথাটি  শেষ হয়ে যায় না মানব জনমকে উপলব্ধি করতে হবে।

আমরা যে যেখানে আছি, যে যে কাজ করছি সমস্ত কাজের ভেতরে আমরা যদি জীবনটাকে অনুভব করতে না পারি এবং আমার পাশের মানুষটিকে যদি অনুভব করতে না পরি, তাহলে আমাকে জীবিত বলা যাবে না। আমরা জীবিত তখনই যখন জীবনকে অনুভব করি। এছাড়া তিনি বলেন, মানুষের মাঝে অন্যের প্রতি প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে হবে।

যখন আমরা নিজের ভেতর প্রতিক্রিয়া অনুভব করা থেকে বাইরে চলে যাব তখন কিন্তু আমরা আর বেচেঁ নেই। বাঁচা কাকে বলে? শ্বাস গ্রহণ করাই কি বাঁচা? শুধু খাদ্য গ্রহণ করা এবং সংসার নির্বাহ করাকেই কি বাঁচা বলে? একটা কথা আছে ‘পরহিতেই জীবন’। রামকৃঞ্চ এ কথাটা বলতেন। তাকে বিবেকানন্দ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জীবন নিয়ে কি করব? তিনি বলেছিলেন পরহিতই। অর্থাৎ পরের হিত কামনায় এবং সেই পরের হিতকে কার্যে পরিণত করতে পারেন, তারাই বেঁচে আছেন।

গিতাতে বলা হয়, ভগবান কাউকে পাপ দেন না, পূণ্য দেন না। মানুষ কেবল তার কর্মফল ভোগ করে। অর্থাৎ আপনি যে কাজটা করছেন সেই কাজটাই আপনাকে হয় পাপী করে অথবা পূণ্যবান করে। এ সম্পূর্ণটাই আপনার নিজের ওপরে।

আমরা যদি সেই কর্মফলকে পূণ্যে অর্জনের পথে পরিচালনা করতে পারি তাহলেই আমরা বেচেঁ আছি।

এই কথাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে আপনাদের সামনে উপস্থিত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। আবার একইসঙ্গে এটাও বলি চারদিকের বাস্তবতা দেখে মনে হয়, আমরা যে ভালো কাজ করবার চেষ্টা করি এবং আমি আমার স্বজ্ঞানে সবসময় বলার চেষ্টা করেছি এর কি কোনো প্রভাব সমাজে ওপর পরছে না? যদি পড়ে থাকে, মানুষকে কেন আমরা দেখছি বিপথে যেতে, স্বার্থপর হতে, দুর্নীতি পরায়ন হতে। আত্ম ছাড়া চিনি না অপর, এরকম একট মনোবৃত্তি গ্রহণ করতে।

কিন্তু তারপরও কাজ তো থেমে নেই। এ কাজ আমাদের ভালো কাজ যা কিছু সেটা যেন বহমান নদীর নিচে পলিমাটির মতো স্তরে স্তরে জমা হচ্ছে। এই পলিমাটি জমতে জমতে একটি দ্বীপ দেশ গড়ে উঠবে। সেখানে ফসল হবে। সবুজ হবে। ঘর উঠবে। মানুষ সংসার করবে। এভাবেই আমাদের ভালো কাজগুলো ঠেকে যায়।

আজকে এখানে যারা সংবর্ধিত হচ্ছেন খুব সঙ্গতভাবেই বলা হচ্ছে সংর্বধনার জন্য তো তারা রক্ত দান করেননি। তারা রক্ত দান করেছেন অত্মপ্রেরণায়, রক্তদান করেছেন মানুষের জীবনকে মূল্যবান মনে করে, তারা রক্ত দান করেছেন আমার য কিছু সামর্থ আছে তা দিয়েই আমি যেন পাশের মানুষটিকে সমৃদ্ধ করতে পারি। তাকে স্বাস্থ্যে রাখতে পারি, তাকে পথের ওপরে চলবার মত শক্তি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি।

আপনাদের উপস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি এই ধরনের স্বেচ্ছা, এই ধরনের স্বদিচ্ছা, এই ধরণের সংকল্প আমরা প্রসারিত করতে পারি, তাহলে সত্যিকার অর্থে এই জীবন পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

কাজেই আজকে এই অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশন আমাকে আমন্ত্রণ করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। তেমনি আপনাদের সম্মুখে এই কথাটি বলার অবকাশ আমাকে দিয়েছেন।

আর বিশেষভাবে আজকের অনুষ্ঠানে বলছি, আমার কথা নয়, আপনি আপনার ভেতরের ইচ্ছা থেকেই এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন এবং আরও বিস্তৃতি  করবার জন্য আপনারা উদ্বুদ্ধ করবেন। কারণ এই রকম একটি কর্মজজ্ঞ মানুষের জন্যে এবং আমরা মানুষের জন্যই বাঁচি। মানুষের জন্যই জীবিত আছি। এখনো যা কিছু করবার তা মানুষের জন্য করার চেষ্টা করছি। আর আপনাদের সবার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং সংবর্ধিত সভার প্রতি আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। আপনাদের সবার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক এবং আপনারা ভালো রাখুন।

এদিকে বান্দরবানের লামায় সরই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর থেকে ৬ অক্টোবর পাঁচ দিনের পারিবারিক ভ্রমণে গিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক ও তার সহধর্মীনি কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক।

সেখানকার প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয দেখে পরিদর্শন করার সময় আলোচনায় অংশ নেন সৈয়দ হক। সভায় কবি তার বক্তব্যে প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য ও মনোরম পরিবেশ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উৎসাহমূলক আলোচনা করেন।

তোমাদের মাঝে আমি দেখেছি নতুন সূর্য উদয়ের আলো, আমার আজকে সত্যিই মুগ্ধতার কোনো শেষ নেই। দেশের নিগোষ্ঠীর ২০টি তোমরা একত্র হয়েছ তা আমাদের দেশের অন্য কোথাও ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। একসঙ্গে আছি, একসঙ্গে বাঁচি, একসঙ্গে আজো থাকবই, সব বিবেদের রেখা ভুলে গিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবই। আর আমার বাবা আমাকে চার লাইনের কবিতা মুখস্ত করিয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে ওই ‘প্রথমে যে দিন তুমি এসেছিলে ভবে, তুমি মাত্র কেঁদেছিলে হেসেছিল সবে, এমন জীবন হবে করিতে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’

মন এভাবে শক্তিমান নয়। বন্দুক যেমন গুলি সঞ্চয় করে ঠিক তেমনি মনের ভেতর ইচ্ছা সঞ্চয় করতে হয়। তাই ইচ্ছা হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি। মানুষ ইচ্ছা করেছে আর এই ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে মানুষ যা চেয়েছে তা আহরণ করতে সম্ভব হয়েছে এবং ইচ্ছাকে সে কাজে পরিণত করেছে। তবে ইচ্ছার আগেও স্বপ্ন দেখতে হয় যে আমি কি করতে চাই, কি হতে চাই। এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কি কি উপায় আছে। তা খুঁজে বের করে  বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

আমি সত্যিই অভিভূত যে আমার স্ত্রী ও আমি এরকম একটি মহা মুহূর্তে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাকে যেন শীর্ষে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন মহাযাতক গুরুঝি শহীদ আল বোখারী। তিনি আমার বন্ধু, আমার প্রিয় জন। আপনাদের গুরুজি। আমি তাকে সালাম জানাই। আমি তাকে আলিঙ্গণ করি। যখন এখানে আমার নাম  ঘোষণা করা হলো তখন আমার চোখ থেকে ধর ধর করে পানি বের হতে লাগল। তার কারণ হচ্ছে, এতো পুরস্কার নয়, তা হচ্ছে মানুষ আমাকে স্পর্শ করে। জীবন আমাকে স্পর্শ করে। সত্য আমাকে স্পর্শ করে, বাণী আমাকে স্পর্শ করে। যে হ্যা তুমি যা করেছ তা সত্যের জন্য, মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্যে, মানুষের জন্য, দেশের জন্য করেছ। এবং সেই দেশ, মাটি, আকাশ, এই খোলা প্রকৃতি তোমাকে আজকে পুরস্কৃত করছে।

আমি যখন একুশে পদক পাই ১৯৮৪ সালে তখন কাগজে খবর বের হয়নি, কোনো বন্ধু আমাকে বলেনি যে তোমাকে অভিনন্দন। কোনো মানুষ আমাকে বলেনি যে আমরা খুব খুশি হয়েছি। নিরবে নিজের হাতে নিজের পুরস্কারকে গ্রহণ করেছি। স্বাধীনতা পদক পেলাম ২০০০ সালে। আমার মনে আছে তখন আমি একটি ঘরে কাজ করছিলাম। তখন চ্যানেল আই এর ফরিদুর রেজা সাগর তিনি একটি বিশাল ফুলের তোরা নিয়ে আমার কাছে হাজির হলেন, আমি বললাম কি সাগর ফুলের তোরা কেন? সে বলল, চাচা আপনাকে অভিনন্দন যে আপনি স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। কিন্তু এত বড় যে একটি পুরস্কার ওই এক সাগর ছাড়া আর কারো কাছ থেকে আমি একটা হাসিমুখ পর্যন্ত  দেখিনি। তখন ভাবতাম যে এ পুরস্কারের জন্য তো আমি কাজ করিনি।

আমি কাজ করেছি মানুষের জন্য, আমি কাজ করেছি আমার মন যা চেয়েছে, যা স্বপ্ন দেখেছে। এবং সেই স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারি এটাই হচ্ছে পুরস্কার। যে আগামী দিনে যারা জীবনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে, তাদের মুখে একটি দুটি উচ্চারণ ও একটি দুটি কথা তুলে ধরতে পেরেছি। আর সেই যে তুলে ধরত পেরেছি তারই স্বৃর্কীতি আজকে শহীদ আল বুখারী মহাযাতক গুরুঝি তিনি আমাকে অর্পণ করলেন। আমার বলতে ইচ্ছা করছে যে আমি সেই কল্পনার সর্গের কথা শুনেছি যা চোখে দেখিনি। এই মাটিতে যদি কেউ স্বর্গ রচনা করে থাকে তাহলে সেই স্বর্গ এখানেই এখানেই এখানেই। তার জয় হোক, কল্যাণ হোক, মঙ্গল হোক। সৃষ্টিকর্তা তার বাহুকে আরও উদ্দমী করুক, আরও দীর্ঘ করোক ।

এম/এসএইচ

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি