ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪

হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসা, সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:২০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

পুঁজিবাদের বিশ্বায়নে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টে গেছে। অধিকাংশ মানুষের চিন্তা এখন একটাই-টাকার পেছনে ছোটো। শুধু ছোটো আর ছোটো। কিন্তু সম্পদ আর ভোগের পেছনে এভাবে দৌড়াতে গিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি অবিচার করে তার স্বাস্থ্যের ওপর। জীবনের একটা পর্যায়ে পৌঁছে শরীর যখন বেঁকে বসে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। একদিন যে সম্পদের পেছনে লাগামহীন ছুটতে গিয়ে সে নিজের স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়েছিল, তা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে ব্যয় হয়ে যায় তার বহু কষ্টে অর্জিত অর্থসম্পদ। আর পরিণত জীবনে স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগ।

কিছু শারীরিক উপসর্গ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে করোনারি হৃদরোগ সহজেই নির্ণয় করা যায়। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে কিছু সহজলভ্য ও স্বল্প ব্যয়ে করা যায়। আবার কিছু বেশ ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

সহজলভ্য এবং তুলনামূলক স্বল্প ব্যয়ে করা যায় এমন পরীক্ষা

> ইসিজি (ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম)
> কার্ডিয়াক এনজাইম্‌স (যেমন : ট্রপোনিন)
> ইটিটি (এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট)
> ইকোকার্ডিওগ্রাম

ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে 

 ১.করোনারি এনজিওগ্রাম (সিএজি)

>প্রচলিত পদ্ধতিতে এনজিওগ্রাম
> সিটি এনজিওগ্রাম

২. থেলিয়াম আপটেক টেস্ট বা মায়োকার্ডিয়াল পারফিউশন স্ক্যান।

কোন পরীক্ষাটি কখন করবেন, কেন?

কেউ যখন বুকে ব্যথা অনুভব করেন তখন চিকিৎসক যদি মনে করেন যে, এটি হৃদরোগজনিত ব্যথা হতে পারে তবে সর্বপ্রথম তিনি রোগীকে একটি ইসিজি করার পরামর্শ দেন। ইসিজি হলো করোনারি হৃদরোগ নির্ণয়ের একটি প্রাথমিক পরীক্ষা।

৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ইসিজিতে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, যা দেখে শনাক্ত করা যায়- রোগী করোনারি হৃদরোগে ভুগছেন কিংবা তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আবার প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে হৃদরোগ থাকার পরও ইসিজিতে কোনো পরিবর্তন পাওয়া যায় না। তখন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কার্ডিয়াক এনজাইম্‌স যেমন : ট্রপোনিন-এর মাত্রা দেখা হয়। রক্তে এর মাত্রাধিক্য দেখে বোঝা যায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা।

কিছু রোগী আছেন যারা বিশ্রামের সময় বুকে কোনো ব্যথা অনুভব করেন না; কিন্তু যখন সিঁড়ি ভাঙেন কিংবা পরিশ্রমের কাজ করেন বা জোরে হাঁটেন তখন বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তাদের ক্ষেত্রে করা হয় ইটিটি। আর হার্টের কর্মক্ষমতা বোঝার জন্যে যে পরীক্ষা, সেটি হলো ইকোকার্ডিওগ্রাম। এর মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের পরে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায়ও হৃৎপিন্ডের কর্মক্ষমতা বোঝা যায়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সহজলভ্য এবং তুলনামূলক স্বল্প ব্যয়ে করা সম্ভব।

অন্যদিকে করোনারি এনজিওগ্রাম ও মায়োকার্ডিয়াল পারফিউশন স্ক্যান হলো অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল পরীক্ষা। করোনারি এনজিওগ্রামে রোগীর হাত কিংবা ঊরুর শিরাপথে ইনজেকশনের মাধ্যমে এক ধরনের তরল রঞ্জক পদার্থ (Dye) প্রবেশ করানো হয়, তারপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গামা ক্যামেরার মাধ্যমে দেখা হয় তার করোনারি ধমনীতে ব্লকেজের পরিমাণ কতটুকু। এ পুরো প্রক্রিয়াটির ভিডিওচিত্র দেখে কার্ডিওলজিস্টরা অনুমানের ভিত্তিতে ব্লকেজের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। প্রচলিতভাবে এনজিওগ্রাম বলতে আমরা যা বুঝি তা মূলত এটাই।

প্রচলিত এই পদ্ধতিতে এনজিওগ্রাম করার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। রক্তনালীকে ছিদ্র করে তার ভেতরে রঞ্জক পদার্থ প্রবেশ করানো হয় বলে এখান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, রক্তচাপ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।  এ-ছাড়াও যাদের বয়স বেশি, যারা কিডনি-জটিলতায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি ঝুঁকিপূর্ণ।

তাই এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়ানোর জন্যে সিটি এনজিওগ্রামের পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু কিডনি রোগী এবং যাদের হার্ট রেট তুলনামূলক বেশি কিংবা অনিয়মিত-এসব বিচারে সিটি এনজিওগ্রামও পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়।

এ-ছাড়াও আছে থেলিয়াম আপটেক টেস্ট বা মায়োকার্ডিয়াল পারফিউশন স্ক্যান। হার্ট অ্যাটাকের পর হৃৎপিন্ডের যে মাংসপেশিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার কর্মক্ষমতা কতটুকু অটুট আছে সেটি বোঝার জন্যে এই পরীক্ষাটি করা হয়। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

করোনারি হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসা

গত কয়েক দশকের তুলনায় করোনারি হৃদরোগের অত্যাধুনিক বিভিন্ন চিকিৎসা এখন সত্যিই অনেক সহজলভ্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কোনো ওষুধ বা স্বীকৃত চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় নি, যা দিয়ে ধমনীর ব্লকেজ পুরোপুরি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলা সম্ভব।

হৃদরোগে ব্যবহৃত ওষুধ

প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় হৃদরোগীদের যে-সব ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দেয়া হয়, তার মধ্যে তিন ধরনের ওষুধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ব্যথা কমানোর ওষুধ। হৃদরোগীদের পকেটে বা ব্যাগে সবসময় একটি স্প্রে জাতীয় ওষুধ (নাইট্রোগ্লিসারিন) রাখার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। প্রয়োজন হলে অর্থাৎ বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হলে তারা এটি ব্যবহার করে থাকেন। এ-ছাড়া ট্যাবলেট আকারেও এ ওষুধটি হৃদরোগীরা প্রতিদিন সেবন করেন। এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন : এটি রক্তচাপ কমিয়ে দিতে পারে, কারো কারো মাথাব্যথা হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, রক্ত জমাটবদ্ধতা রোধের জন্যে এন্টি-প্লেটলেট জাতীয় ওষুধ। যেমন : এসপিরিন, ক্লোপিডগ্রেল। তবে এগুলোরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই ওষুধগুলো পরিপাকতন্ত্রে ক্ষত তৈরি করতে পারে এবং সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

তৃতীয়ত, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর ওষুধ। যেমন : স্ট্যাটিন ও ফাইব্রেট। দীর্ঘমেয়াদি সেবনে এ ওষুধগুলো মাংসপেশির ব্যথা ও দুর্বলতা এবং লিভারের সমস্যার কারণ হতে পারে।

ব্যয়বহুল এসব ওষুধ খাওয়ার পরও কি ব্লকেজের বৃদ্ধি থেমে থাকছে? তা তো থাকছেই না, বরং বেশিরভাগ সময়ই তা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তখন প্রয়োজন হয় ইন্টারভেনশন ও সার্জিক্যাল চিকিৎসার। ইন্টারভেনশন হলো এনজিওপ্লাস্টি বা স্টেন্টিং (রিং পরানো) আর সার্জিক্যাল চিকিৎসা হচ্ছে বাইপাস অপারেশন।

একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তা হলো, আপনি যদি ইতোমধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে থাকেন, তবে নিজেই ওষুধ বন্ধ করবেন না। জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি আপনি আপনার চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন অব্যাহত রাখুন। আপনার শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখে চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন- কখন কোন ওষুধটি কমানো বা বন্ধ করা প্রয়োজন।

সূত্র: ‘এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’, ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান

এমএম/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি