ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

৮ ডিসেম্বর: বরিশাল, পিরোজপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস আজ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:০৫, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১১:২৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

মহান বিজয়ের মাস

মহান বিজয়ের মাস

আজ ৮ ডিসেম্বর। দক্ষিণালের বরিশাল, পিরোজপুর এবং দেশের মধ্য পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে এ তিন জেলা মুক্ত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে সে দিন এ অঞ্চলসমূহকে মুখরিত করেছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।

বরিশালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ

বরিশাল:

১৯৭১-এর ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল ছিল শত্রুমুক্ত। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী আকাশ পথে বরিশাল ও পটুয়াখালীতে হামলা চালায়। দ্বিতীয় দফা হামলা চালায় ২৭ এপ্রিল জল, স্থল ও আকাশপথে। এর আগেই সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে নিয়ে এ সচিবালয় গঠিত হয়। এ ঘাঁটি থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানোর কাজও হতো এ সচিবালয় থেকে।

৮ ডিসেম্বর দুপুরে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা গানবোট, লঞ্চ, স্টিমারে বরিশাল থেকে গোপনে পালিয়ে যায়। তবে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের গোপনে পালানোর খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। ভারতীয় বিমানবাহিনী দুপুর ২টায় বরিশালে হামলা চালায়। পাকিস্তানি দখলদারদের পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বিকেল ৩টায় বরিশালের অদূরে অবস্থানরত সুলতান মাস্টার ও আবদুল মান্নানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রবেশ করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

পিরোজপুর শহরের শেষ সীমায় বলেশ্বর নদী তীরে শহিদ বেধী

পিরোজপুর

১৯৭১ সালের এ দিনে পিরোজপুর পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদর মুক্ত হয়। এই দিনে ঘরে ঘরে উড়েছিল লাল সবুজের বিজয় পতাকা। পিরোজপুরের ইতিহাসে এ দিনটি বিশেষ স্মরণীয় দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়াউদ্দিনের কমান্ডের আওতায়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ১৮ ঘণ্টার মধ্যে পিরোজপুরের আওয়ামী লীগের নেতৃতাধীন মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র গুলি নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়।

১৯৭১ সালের ৩ মে পিরোজপুরে প্রথম পাক বাহিনী প্রবেশ করে। শহরের প্রবেশদ্বার হুলারহাট নৌ-বন্দর থেকে পাকবাহিনীরা প্রবেশের পথে প্রথমেই তারা মাছিমপুর ও কৃষ্ণনগর গ্রামে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। তারপর ৮টি মাস স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ও রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকজনদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়। হত্যা করা হয় ৩০ সহস্রাধিক মুক্তিকামী নারী-পুরুষ শিশুকে।

পিরোজপুরকে হানাদার মুক্ত করতে সুন্দরবনের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ৭ ডিসেম্বর রাত ১০টায় পিরোজপুরের দক্ষিণপ্রান্ত পাড়েরহাট বন্দর দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর এ আগমনের খবর পেয়ে পাক হায়নারা শহরের পূর্বদিকের কচা নদী দিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যায়। 

এর আগে স্বরূপকাঠী পেয়ারা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের গড়ে তোলা দূর্গে পাকবাহিনী আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন পাক সেনা নিহত হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হতে থাকে। অবশেষে ৮ ডিসেম্বর পিরোজপুর ছেড়ে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা পিরোজপুর অঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সম্ভ্রম লুটে নেয় প্রায় কয়েক হাজার মা-বোনের।

কুমিল্লা নগীরর প্রবেশ দ্বারে যুদ্ধ জয়’ ভাস্কর্য

কুমিল্লা:

১৯৭১ সালের এ দিনে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় কুমিল্লা। এদিন বিকেল ৪ টায় কুমিল্লা টাউন হল মাঠে তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা ও কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

দিবসটি উপলক্ষে সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে আনন্দ র‌্যালি ও দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাক বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের প্রধান ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। মিত্রবাহিনীর ১১ গুর্খা রেজিমেন্টের আর কে মজুমদারের নেতৃত্বে কুমিল্লা বিমানবন্দরের তিনদিক থেকে আক্রমণ চালানো হয়। সীমান্তবর্তী বিবির বাজার দিয়ে লে. দিদারুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল এবং অপর দুটি দল গোমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরের ভাটপাড়া দিয়ে এবং চৌদ্দগ্রামের বাঘেরচর দিয়ে এসে বিমানবন্দরের পাকসেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। রাতভর পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কতিপয় পাকিস্তানি সেনা বিমানবন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে কুমিল্লার বরুড়ার দিকে ও ময়নামতি সেনা ছাউনিতে ফিরে যায় এবং কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে। একপর্যায়ে পাকসেনাদের বিমানবন্দরের প্রধান ঘাঁটি দখল করে মুক্তিসেনারা।

এভাবেই একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ভোরে কুমিল্লা হানাদার মুক্ত হয়। এদিকে কুমিল্লা মুক্ত দিবস উপলক্ষে সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে সকালে টাউন হল মাঠ থেকে বিজয় উৎসবের আনন্দ র‌্যালি ও দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

আজ ৮ ডিসেম্বর। দক্ষিণালের বরিশাল, পিরোজপুর এবং দেশের মধ্য পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্মনবাড়িয়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে এ তিন জেলা মুক্ত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে সে দিন এ অঞ্চলসমূহকে মুখরিত করেছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।

মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের স্মরণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাউতলীতে স্মৃতিসৌধ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া:

এ দিন বিনা যুদ্ধে হানাদারমুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ও সরাইল উপজেলা। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলাকে হানাদারমুক্ত করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ দক্ষিণ দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

একই সঙ্গে মিত্রবাহিনীর ৫৭তম মাউন্টের ডিভিশন আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন ও উজানিসার সড়ক দিয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। শহরের চারপাশে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর শক্ত অবস্থানে থাকায় হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে।

তবে পালিয়ে যাওয়ার সময় ৬ ডিসেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক হানাদার বাহিনী। তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক কেএম লুৎফুর রহমানসহ কারাগারে আটকে রাখা অর্ধশত বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে পৌর শহরের কুরুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

এছাড়া শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা কলেজের হোস্টেল, অন্নদা স্কুল বোর্ডিং, বাজার ও গুদামসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরদিন ৭ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে আশুগঞ্জের দিকে পালাতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বিনা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মুক্ত ঘোষণা করে।
এদিন সকাল ৯টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযুদ্ধের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি