ঢাকা, রবিবার   ২৯ জুন ২০২৫

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন 

স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতের, প্রভাব কেমন হবে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:৪৯, ২৮ জুন ২০২৫ | আপডেট: ২১:৫৩, ২৮ জুন ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর ব্যবহার করে ৯টি পণ্যের আমদানির ওপর ভারতের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে বিশেষ করে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বড় ধাক্কা খেতে পারে। আগেই পোশাক রপ্তানিতে বাধা থাকায় এবার পাট খাতেও সীমাবদ্ধতা আরোপ বাংলাদেশকেই তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতির মুখে ফেলবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

বিবিসি বাংলা অনলাই এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, একুশে টেলিভিশনের অনলাইন পাঠকদের জন্য তা তুলে দেয়া হলো-

বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে নয় ধরনের পণ্য আমদানিতে ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞার পর দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে স্থলবন্দর ব্যবহার করে পোশাকের পর এবার পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির সুযোগ বন্ধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশই বেশি ক্ষতির শিকার হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ধারণা করছেন।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এসোসিয়েশনের ডিরেক্টর ও রাজবাড়ী জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ শামসুল আবেদিন বলছেন, ভারতের নতুন সিদ্ধান্তের প্রভাব দেশের পাটশিল্পে কতটা পড়বে সেটি তারা বিশ্লেষণ করছেন।

"কাঁচাপাট রফতানি বন্ধ হবে হয়তো। তবে স্থলবন্দর না হলে নৌপথে কীভাবে রফতানি চালু রাখা যায় সে আলোচনা এর মধ্যেই শুরু হয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য ও বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান বলছেন, স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানি বন্ধ হলে সেটি নৌপথে রফতানি করে পোষানো খুবই কঠিন বিষয় হবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ডঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণেই এসব পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্যই বেশি ক্ষতিকর হবে।

"বাংলাদেশ থেকে পোশাকের পর পাট রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আমার মনে হয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া উচিত আমাদের স্বার্থেই," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

যদিও ভারতের সবশেষ পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে এখনো কোনো বক্তব্য আসেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।

প্রসঙ্গত, গত বছর পাঁচই অগাস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক মাস ধরে বাকযুদ্ধের পর ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে।

ফলে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন সরাসরি ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে, যা দ্রুত সমাধান করা দরকার বলে মনে করেন ডঃ মোস্তাফিজুর রহমান।


ভারতের ঘোষণায় কী বলা হয়েছে

শুক্রবার ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে নয় ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কথা প্রকাশ করা হয়।

যদিও ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে,ি এসব পণ্য মুম্বাইয়ের নহ্ভা সেভা বন্দর দিয়ে ভারতে যেতে পারবে।

স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করা এসব বাংলাদেশি পণ্যে মূলত পাট ও পাটজাত পণ্য বেশি। এর মধ্যে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা, একাধিক ভাঁজের বোনা কাপড়, একক শণ সুতা, পাটের একক সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় রয়েছে এই তালিকায়।

ভারত এ ধরনের যে নয়টি পণ্যের ওপর স্থলবন্দর নিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে, এসব পণ্য থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো প্রায় পনের কোটি ডলারের কাছাকাছি, যার প্রায় সবটাই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়েছিলো।

রাজস্ব বোর্ডের হিসেবে, এই পনের কোটি ডলারের রফতানির মধ্যে মাত্র বিশ লাখ ডলারের রফতানি স্থলবন্দর দিয়ে হয়নি।

তবে ভারতীয় বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে ওই নয় ধরনের পণ্য রপ্তানিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে, যা দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

অন্যদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশ নয়শ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। মূলত ভারতীয় ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার হলো বাংলাদেশ।

ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো পোশাক এবং এরপর পাট ও পাটজাত পণ্যই দেশটিতে বেশি যায় বাংলাদেশ থেকে।

এছাড়া প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতেও বাংলাদেশ ভালো করছিলো। এর ওপরে আগেই বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত।


বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়বে

শুক্রবার স্থলবন্দর দিয়ে নয়টি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ দিল ভারত।

এর আগে গত ১৭ই মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল।

তারও আগে গত ৯ই এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল দেশটি।

এর আগে আটই এপ্রিল অন্য দেশে পণ্য রফতানির জন্য বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছিল ভারত।

এরপর পনেরই এপ্রিল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সূতা আমদানি বন্ধ করে ঘোষণা করে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ভারত অনেক দিন ধরে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।

"কিন্তু এখনকার পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি সংকট তৈরি করছে। এটা কারও জন্যই ভালো নয়। বাংলাদেশ ভারতের ওপর অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই নির্ভরশীল। আবার ভারতীয় পণ্য রফতানির জন্য বাংলাদেশের উপরেও নির্ভরশীলতা আছে। তাই দুই পক্ষই যত দ্রুত সমাধানে পৌঁছাতে ততই দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতি উপকৃত হবে," বলছিলেন তিনি।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, তৈরি পোশাকের পরে ভারতে পাট ও পাটজাত পণ্যই বেশি যাচ্ছিলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যদিও ২০১৭ সালে দেশটি বাংলাদেশি পাটপণ্যে 'অ্যান্টি ডাম্পিং' শুল্ক আরোপ করে, যা ২০২৩ সালে আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।

শেখ শামসুল আবেদিন বলছেন, ওই শুল্ক আরোপের কারণেও বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্য ভারতের রফতানিতে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিলো কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের পাট ভালো করছিলো।

"এখন হয়তো কাঁচাপাট রফতানি সংকটে পড়বে। তবে একই সঙ্গে দেশে পাটের ফিনিশড গুড উৎপাদন আরও বাড়ানো সুযোগ আছে। যদিও নৌপথে ভারতের রফতানির সুযোগ এখনো আছে। সেটি কতটা কাজে লাগানো যায় তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, পাট অধিদফতরের হিসেবে চলতি বছরের মার্চ মাসে ভারতসহ মোট বারটি দেশে ৬৯৮ কোটি টাকার কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ভারতেই ৪৪৮ কোটি টাকার বেশি মূল্যের কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে । এর প্রায় পুরোটাই গেছে স্থলবন্দর দিয়েছে।

এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এক ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি কাচাপাট রফতানি হয়েছে ভারত সহ তেরটি দেশে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩২ বেল পাট গেছে ভারতে যার মূল্য ১ হাজার ২৯ কোটি টাকার বেশি। এখানেও পুরোটা স্থল বন্দর দিয়েই রফতানি হয়েছে।

এমনকি তৃতীয় দেশে রফতানির জন্য বাংলাবান্দা স্থল বন্দর দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ বেল পাটা গেছে বাংলাদেশ থেকে।

মোস্তফা আবিদ খান বলছেন, ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাটও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

"স্থলবন্দর দিয়ে ভারত আমদানি বন্ধ করার কারণে বাংলাদেশের রফতানি অনেকটা কমে যাবে। ফলে প্রভাবটি অনেকটাই সরাসরি পড়ার আশঙ্কা রয়েছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

যদিও গত মে মাসে পোশাকসহ কিছু বাংলাদেশি পণ্য স্থলপথে আমদানি ভারত নিষিদ্ধ করার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন দাবি করেছিলেন যে, ভারতই বাংলাদেশে বেশি রফতানি করে বলে স্থলবন্দর কেন্দ্রিক বিধিনিষেধে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব বলেও তিনি তখন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি