ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

বেলভেদ্রের বিনোদনী

একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস

প্রকাশিত : ১৫:৫৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ২০:৪১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আহ্ কো চাহিয়ে এক ওম্র আসর হোনে তক্
কওন জীতা হ্যায় তেরে যুলফ কে সর হোনে তক

(একটি দুঃখের যন্ত্রণা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকে,
তোমার কেশের বেনী বাঁধা পর্যন্ত কে বেঁচে থাকবে?)   
----মীর্জা গালিব  

বেলভেদ্রের বিনোদনী উপন্যাসের পটভূমি মির্জা গালিবের উপরে উদ্ধৃত গজল। স্থান, সুইজারল্যান্ডের দাভোজ শহরে অবস্থিত ৭ তারকা মানের স্টাইগেনবার্গার গ্র্যান্ড হোটেল বেলভেদ্রে। এখানেই নাইট অডিটর পদে কর্মরত অবস্থায় এক গভীর রাতে লেখকের সাথে পরিচয় হয় মিরিয়াম জোনাথন নামে হোটেলের নথিবদ্ধ একজন কম্পেনিয়ন বা হোস্টেজ-এর সাথে। যাকে বাংলায় বলে বারাঙ্গনা। লেখকের ভাষায় ব্যক্তিগত আবেগ, সম্পর্কের বিষন্নতা, থ্রিল ও মর্মস্পর্শী করুণ অভিজ্ঞতা বইটি লেখার প্রধান প্রেরণা। 

মিরিয়াম জোনাথন জন্মগতভাবে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে গোড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে বেড়ে উঠা, পাড়াশোনা, চাকরি এখানেই। ব্যাংকার বাবার সংসারে জন্ম নেয়ার ৬ বছরের মাথায় মা মারা গেলেন। বাবা আর বিয়ে করেননি। ইউরোপের মতো দেশে যা একটি বিরল ঘটনা। ডরোথী নামের একজন কাজের মেয়ের কাছে মানুষ হতে লাগলেন। অর্থনীতি বিষয়ে পড়শোনা শেষ করে জুরিখের একটি ব্যাংকে চাকরিও নিলেন। এরপরে তার জীবনে আসে বহরম জামসেদি নামের ১৮ বছরের এক ইরানি যুবক। সেলুলয়েডের ফিতার মত এরপরেই মিরিয়ামের জীবনে একের পর ঘটতে থাকে রোমাঞ্চ, দুর্ঘটনা, হতাশা আর না পাওয়ার করুণ কাহিনী।

একজন নারীর জীবনে যে চাওয়া-পাওয়া থাকে তা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হয়েছেন মিরিয়াম। একমাত্র কন্যা লেইলার ভবিষ্যৎ, তাকে লালনকারি ডরোথীকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে করতে একদিন তাকে সমর্পিত হতে হয় পৃথিবীর আদিম পেশাটির দিকে। প্রথমেই তার জীবনালেখ্য পড়ে হয়ত মনে হবে জগতের অন্য আর দশজন নারীর মতই আটপৌরে, গতানুগতিক। কিন্তু যতই কাহিনীর গভীরে যাওয়া যাবে ততই পাঠকের মন আর্দ্র হয়ে পড়বে মিরিয়ামের প্রতি। চোখ সজল হয়ে উঠবে মিরিয়ামের দুঃখ গাঁথায়। তার বর্ণনায়ই জানা যাবে পৃথিবীর কত নামকরা রথি-মহারথী, রাষ্ট্র আর সরকার প্রধানরা তার বিছানায় সঙ্গী হয়েছেন। মনে হবে স্বামী বহরামের সাথে অনিবার্য পরিণতি হয়েছে বিচ্ছেদে। কিন্তু না, তার পরিণতি এতটাই উত্তেজনায় ঠাসা যে পাঠককে প্রতিটি লাইনই পড়লে মনে হবে তিনি এক ভয়াবহ রহস্য গল্প পড়ছেন।

কাহিনীর প্রতিটি চরিত্রই বৈচিত্র্যময়। মিরিয়ামকে লালনকারি ডরোথীও এক রহসম্যয় সার্বজনীন নারীর রূপ। সুইজারল্যান্ডের প্রত্যন্ত এক গ্রামের পিতৃপরিচয়হীন এই নারী জীবনে বিয়ে করেননি। অনাথ মিরিয়ামকে তিনি মায়ের স্নেহে মানুষ করেছেন। বহরামের সাথে বিয়ের পরে তার হাতেও লাঞ্চিত ও ধর্ষিত হয়েছেন। এসব সয়েও মিরিয়ামের কন্যা লেইলাকে তিনি মিরিয়ামের মতই আদর দিয়ে বড় করে তার জীবনের সকল সঞ্চয় লেইলার নামে উইল করে দিয়েছেন।

তবে কাহিনীর আরো বড় চমক মিরিয়ামের কন্যা লেইলা। বাবা ইরানী, মা ইউরোপীয়। বংশগতির ধারা সূত্র আবিস্কারক জীববিজ্ঞানী ম্যান্ডেলের তত্ত¡ অনুযায়ী বাবা ও মা’র জিন সন্তান বংশ পরম্পরায় বহন করে। ফলে উভয়েরই কিছু না কিছু চরিত্র সন্তান লাভ করে। লেইলা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে তার বাবার পুরো চরিত্রই পেয়েছে। পঞ্চদশী এই মেয়েটি কিভাবে প্রতিটি ঘটনার ঘটনপটিয়সি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তগ্রহণে স্বার্থপরতায় পরিপক্ক সে বর্ণনা পাওয়া যায় তার চরিত্র পঠনে।

১৮ বছরের বহরাম জামসেদী তেহরান থেকে পালিয়ে ছদ্মবেশে আজারবাইজান, রোমানিয়া, হাংগেরি অস্ট্রিয়া হয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে মিরিয়ামের বাসায় আসেন। বহরামসহ আরো ২ জনের জুরিখে পালিয়ে আসার বর্ণনা লেখক এতটাই রোমাঞ্চ আর নিখুঁতভাবে দিয়েছেন যে পাঠকের মনে হবে নিজেই এই দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছে। দুর্গম অভিযাত্রার গল্পকেও হার মানিয়েছে শিহরণ জাগানো এই বর্ণনা। মিরিয়ামও তখন ষোড়শী। সঙ্গত কারণে যা হওয়ার তাই ঘটলো। বহরামের সাথে প্রেম, শারীরিক সম্পর্ক, গর্ভধারণ, অতঃপর বিয়ে ও লেইলা নামে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়া। ইরানের শিয়া সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া বহরামের কাছে নারী মানেই ভোগের বস্তু। যে দেশে আজো নারী মানে এই মূল্যায়ন। স্বভাবে চরম উচ্ছৃংখল মদ এবং নারীলোভী বহরামও তার ব্যতিক্রম নন। মিরিয়ামকে ভোগের বস্তুর বাইরে কখনই স্ত্রী হিসেবে ভাবেন নি।

বিপর্যয়ের শুরু মিরিয়ামের বাবার মৃত্যুর পরে। আস্তে আস্তে বহরামের স্বরূপ প্রকাশ পেতে শুরু করে। গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টান বলে মিরিয়াম বহরামকে তালাকও দেয় না। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে যায় যে, মিরিয়াম জুরিখ থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে দাভোজ শহরে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এখানেই একদিন রাতে লেখকের সাথে দেখা হয় মিরিয়ামের। লেখকের ভাষায়, ‘ইউরোপে যে এত সুন্দরী মেয়ে থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না।’ লেখক প্রথম দেখায় মিরিয়ামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু মানসিক নৈকট্যে পোঁছায় তার সায় ছিলো না মোটেই। কারণ তিনি তখন সদ্য জার্মান ফেরত। ১৮ বছর একত্রে থাকা বান্ধবীর সাথে বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় কাতর। মিরিয়ামের প্রচণ্ড ইচ্ছা, বেলভেদ্রের এক সমকামি সহকর্মী গরান ও ২০ অনূর্ধ মেরীর সহায়তায় তারসাথে মানসিক নৈকট্যে পৌঁছেছেন আরো পরে। সে বর্ণনা দিয়েছেন অত্যন্ত কৌশলে। সম্পর্কের বর্ণনাটি এমনভাবেই করেছেন, যাতে পাঠকের মনে ক্রমাগত ঔৎসুক্য আর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে এরকম যে মিরিয়ামের সাথে না জানি কি হচ্ছে তার সরস কাহিনী। লেখক এখানে বর্ণনার রাশ টেনেছেন অত্যন্ত নির্মোহভাবে। সতর্ক ছিলেন ঘটনার বিবরণ যেনো ইরোটিক পর্যায়ে না যায়। নিঃসন্দেহে লেখকের এটা বড় মুন্সিয়ানা।

এই উপন্যাসটি আত্মজৈবনিক হলেও ঘটনার উপস্থাপন পাঠককে ঘোরের মধ্যে রেখে দিবে-এতে সন্দেহ নেই। প্রতিটি চরিত্রই আলাদা। প্রতিটি চরিত্রেরই একটি নিজস্ব জগত আছে এবং প্রতিটি চরিত্রেরই সমাপ্তি হয়েছে রোমাঞ্চকর, করুণ এবং রহস্যময়তা দিয়ে- যা কি না যে কোনো প্রেম, রহস্য, দুঃখ আর রোমাঞ্চে ভরা উপন্যাসেও বিরল। এছাড়া দেশটির নৈসর্গিক বর্ণনাও ভ্রমণপিপাসুদের তৃপ্তি দেবে। বিশেষ করে দাভোজ শহরের প্রতিটি রাস্তা, হোটেল, জঙ্গল-এর বর্ণনা লেখক এতটাই নিখুঁতভাবে দিয়েছেন যে, পাঠক নিজেই সেই স্থানের মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করবেন।   

সুইজারল্যান্ডকে অনেকেই ভূস্বর্গ বলে। অসম্ভব ও নয়নমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দশভাগের নয়ভাগই ছোট-বড়-মাঝারি পাহাড়-পর্বত। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত যাতায়াত ছিল গিরিপথ দিয়ে। পাহাড়ি আর পাথুরে খঞ্জর এলাকা। চাষাবাস প্রায় অসম্ভবই। মধ্যযুগে গরু-মেষ-শুকুর ইত্যাদি পশুপালনই ছিল প্রধান জীবিকা। এসব কারণে লোকসংখ্যা বরাবর নয় লাখের কম। এখনও এখানে বেশ কিছু ‘মাত্র একটি পরিবার বা এক বাড়ির গ্রাম’ রয়েছে। এই বর্ণনাগুলো এসেছে তথ্যসহ।

দীর্ঘ বাক্য, কোনো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছাড়া সার্বিকভাবে সুসম্পাদিত বইটি যে কোন পাঠককেই আকৃষ্ট করবে বলে আমার বিশ্বাস। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকের তরুণ বন্ধু ও কবি শিমন রায়হানকে। অফসেট কাগজে ছাপা, প্রচ্ছদ এবং উন্নত বাঁধাই বইটির গুনগত মান বজায় রেখেছে।

লেখক পরিচিত: বোহেমিয়ান লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন প্রায় চার দশক ইউরোপ প্রবাসী। বর্তমানে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী নয়ে-ইজেনবুর্গ শহরে থাকেন। ঘুরেছেন পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক দেশ।   

২০০২ সালের ডিসেম্বরে চলে যান সুইজারল্যান্ড। সেখানে তিনি অ্যাঙ্গেলবার্গের একটি হোটেলে এবং পরে দাভোজের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাত তারকা হোটেল গ্র্যান্ড স্টাইগেনবার্গার বেলভেদরে নাইট অডিটর পদে চাকরি নেন। দাভোজে বছরে একবার, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক কনফারেন্স’ নামে পাঁচদিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে থাকে। যেখানে সারা পৃথিবীর সেলিব্রিটি, গায়ক-নায়ক-শিল্পী, শিল্পপতি এবং রাজনীতিকরা যোগদান করেন। তাদের মধ্যে যারা রাজার রাজা, সবাই বেলেভেদ্রেতে রাত্রিযাপন করেন। সেই সুবাদে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে ক্ষণিকের জন্য হলেও লেখকের ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে। কয়েকজনের সঙ্গে দীর্ঘসময় ধরে কথাবার্তাও হয়েছে। এদের মধ্যে বিল ক্লিন্টন, নেলসন ম্যান্ডেলা, কফি আনান, পিটার উস্তিনভ, পল ম্যাকার্টনি, ম্যাডোনা, রোমান পোলানস্কি, বিল গেটস, টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস প্রমুখ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। জার্মানিতে ফিরে আসেন ২০০৫ সালে। বিচিত্র ও চমকপ্রদ এসব অভিজ্ঞতা তার লেখার অনুপ্রেরণা।

তিনি রবীন্দ্রসংগীতের বিশেষ অনুরাগী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বড় ভাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজন আবদুল্লাহ আল-মামুন।  

বইয়ের নাম: বেলভেদ্রের বিনোদনী
লেখকের নাম: আবদুল্লাহ আল হারুন 
শ্রেণি: আত্মজৈবনিক উপন্যাস
মূল্য: ৪০০ টাকা
প্রকাশক: ঐতিহ্য প্রকাশনী , ঢাকা
প্রকাশকাল: বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯

এসি

     


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি