আইসিসিবি’র সম্পাদকীয়
রোহিঙ্গা সংকট: নিকৃষ্টতম মানবিক বিপর্যয়
প্রকাশিত : ২০:২৯, ২৬ আগস্ট ২০১৮

কোন যুদ্ধ বা কোন বিবাদ ছাড়াই বাংলাদেশ মিয়ানমার কর্তৃক মানুষের তৈরী নিকৃষ্টতম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে এসেছে।
বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা ছাড়া বাংলাদেশের কোন বিকল্প ছিলনা। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের একটা বড় অংশ হচ্ছে মহিলা ও শিশু। এর মধ্যে নব-জাতক এবং বয়োজ্যোষ্ঠ জনগণও রয়েছে যাদের বাড়তি সুবিধা এবং নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সার্বিক নিরাপত্তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জলবায়ুর উপরও এর প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার জন্য ইতোমধ্যেই ৬,০০০ একর জমির গাছ-পালা কেটে ফেলা হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ঐ ৬,০০০ একর জমির মূল্য ৭৪১.৩১ কোটি টাকা বা ৮৬.৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জানুয়ারীতে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যে চুক্তির আওতায় ক্রমাগত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ আনুষ্ঠানিক চুক্তির অধীনে একজন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুও স্বদেশে ফিরে যায়নি।
যারা স্বদেশে ফিরেছে তাদের অনেককেই আটকে রাখা হয়েছে। এবছর জানুয়ারী এবং এপ্রিলের মধ্যে ৫৮ জন রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরেছিল তাদের সবাইকে আটক করা হয়েছিল এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
তাদেরকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার আওতায় আনা হয়, কিন্তু এ ক্ষমার আওতায় বুথিডং কারাগার থেকে তথাকথিত ’রিসেপশন সেন্টারে’ স্থানান্তর করা হয়। সুতরাং, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় খোঁজা অব্যাহত থাকে।
জাতিসংঘের মহাসচিব জুলাই মাসের ২ তারিখে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসার পর মহাসচিব বলেন বিগত বছরের আগষ্ট মাস থেকে মিয়ানমারে যা ঘটেছে –এটা সম্ভবত বিশ্বে সুসংবদ্ধ মানবাধিকার লংঘনের যত নজির আছে তার মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক।
জাতিসংঘের মহাসচিবের সাথে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ছিলেন। বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান ভিত্তিক সহায়তার ঘোষনা দেন। বিশ্ব ব্যাংক প্রধান সবাইকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান যাতে তারা মর্যাদাপূর্ণ জীবন পেতে পারে।
মিয়ানমার মিলিটারী কর্তৃক রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং (জাতিগত নিধন) এর জন্য ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক নিন্দার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ কিছুই নেওয়া হয়নি।
আট বছরের মধ্যে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মত জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউসিলে রোহিঙ্গা ইস্যুর উপর মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ড্রাফট নিরাপত্তা কাউন্সিল প্রস্তাবনা চায়নার ভেটোর কারনে বাধাগ্রস্ত হয়।
সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্য বার্মিজ মিলিটারীদের সাথে সব ধরনের প্রোগ্রাম সাময়িকভাবে বিরতির ঘোষনা দেন। অক্টোবরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তাদের আমন্ত্রন জানানো স্থগিত করেন এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহযোগিতার পুনর্বিবেচনার প্রস্তুতি নেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত সমস্ত কার্যক্রমে মিয়ানমারের বর্তমান এবং প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
UNHCR-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক নির্যাতন এবং ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের মিয়ানমার ভ্রমনের অনুমতি না পাওয়ায় নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এবং মিয়ানমার সরকারকে ঘটনার মূল কারন উদঘাটন করার কথা উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া UN General Assembly, OIC ও অন্যান্য সংস্থা একটি খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক অভিযান বন্ধ, অবাধ মানবিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিজ বাসভুমে ফেরত পাঠানো এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পূর্ন নাগরিকত্বসহ মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশে বহুমাত্রিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সংকট মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশকে সহায়তা করা আবশ্যক।
যদিও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহানুভূতি পাচ্ছে কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি এখন অবদি দৃশ্যমান হচ্ছেনা।
সুতরাং, কোনরকম কালক্ষেপন না করে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব এবং নাগরিক স্বাধীনতা দিয়ে যাতে স্বসম্মানে মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয় এ বিষয়ে বিশ্ব নেতৃবন্দেকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
এমএইচ/এসি
আরও পড়ুন