ঢাকা, শনিবার   ০৫ জুলাই ২০২৫

ইভিএম: যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ, কি বলছে পরিসংখ্যান?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:০০, ৩০ আগস্ট ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

হঠাৎ করেই আবারও আলোচনায় ইলেকট্রনিং ভোটিং বা ইভিএম পদ্ধতি। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের জন্য আরপিও সংশোধন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধী দল বিএনপিসহ বিরোধী জোট ইভিএমের বিরোধীতা করলেও সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এতে স্বাগত জানিয়েছে। এরইমধ্যে এক নির্বাচন কমিশনার ইভিএম বিরোধীতা করে চিঠিও দিয়েছেন। বলছেন, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের জন্য এখনও প্রস্তুত নয় ইসি। অন্যদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যরা মনে করছেন নির্বাচনকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করতে ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই।

এরই মধ্যে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, ইভিএম ব্যবহারের আসলে সুবিধাটাই বা কি? আর বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যরা কেন এর বিরোধীতা করছে? পাশাপাশি ইভিএমের অতীত অভিজ্ঞতা কি বলে? বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইভিএম ব্যবহারে কেমন সফলতা দেখিয়েছি? নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, একই ব্যক্তির একাধিক ব্যালটে সিলমারাসহ ভোট গণনার জটিলতা রোধে ইভিএম কতটুকু কার্যকরী, এসব বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইভিএমের আদ্যোপান্ত নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের পর্ব।

জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে প্রথম ইভিএম পদ্ধতির ভোটগ্রহণ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে প্রথম এই ভোটিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পর অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোতেও এই ভোটিং পদ্ধতি চালু করে মার্কিন প্রশাসন। এর পর ক্রমান্বয়ে দেশটির অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোতেও ইভিএম পদ্ধতির ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

দীর্ঘদিন ধরে সীমিত পরিসরে ইভিএম পদ্ধতির ভোটগ্রহণ শুরু করার পর ১৯৯৬ সালে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে দেশটির সরকার। ওই সময় দেখা যায়, ইভিএম পদ্ধতির ভোটগ্রহণে কিছু ত্রুটি থাকলেও তা ব্যালট ভোটের চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং নির্ভুল পদ্ধতি। এরপরই দেশটি জাতীয় নির্বাচনেও ইভিএম পদ্ধতির ভোটগ্রহণ শুরু করে।

এদিকে ইভিএম পদ্ধতির ভোটগ্রহণ কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও। দক্ষিণ আমেররিকার দেশ ব্রাজিল, উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা, ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নামিবিয়া এবং নেদারল্যান্ডে তা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে এই পদ্ধতির ভোটগ্রহণের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় এশিয়ার সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত এই পদ্ধতির ভোটগ্রহণ শুরু করে।

ব্রাজিল ১৯৯৬ সালে ৫০টি পৌরসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই পদ্ধতির ভোটগ্রহণ শুরু করে। শুধু তাই নয়, ২০১০ সালে এই পদ্ধতির ভোটগ্রহণের ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার মাত্র ৭৫ মিনিটের মধ্যে ফল ঘোষণা করেছিল দেশটির নির্বাচন কমিশন।

এদিকে ১৯৯৯ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথম ইভিএম ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনেও ইভিএমের ব্যবহার করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। এদিকে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫৪৩ আসনের ৮টিতে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেন ভোটাররা। এতেও তেমন কোনো অভিযোগ শুনা যায়নি পরাজিত প্রার্থীদের পক্ষ থেকে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। এর জের ধরে দেশে ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ব্যবহারের মাধ্যমে এই ইভিএম নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। সর্বশেষ বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করেছে নির্বাচন কমিশন। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করছে নির্বাচন কমিশন, যদিও এ সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে আঠার সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি ইভিএম নিয়ে কাজ করছে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে এবারের নির্বাচনে ৪২ হাজার কেন্দ্রের জন্য মোট প্রায় তিন লাখ ইভিএম মেশিন দরকার হতে পারে।

ইভিএম ব্যবহারের সুবিধা:

ইভিএম ব্যবহার করার ফলে যে সুবিধা পাওয়া যাবে তা হলো-
(১) কোটি কোটি সংখ্যক ব্যালট ছাপানোর জন্য কাগজের খরচ, ছাপানোর খরচ, সেগুলো পরিবহনের খরচ, ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ সবই সাশ্রয় হবে।
(২) ভোটের ফলাফল হবে নির্ভুল।
(৩) নির্বাচনের ফলাফল দ্রুত পাওয়া যাবে। এটি এর সবচেয়ে বড় সুবিধা।
(৪) ইভিএম যেহেতু কোন বাতিল ভোট গ্রহণ করে না তাই প্রতিটি নাগরিকের ভোটের মূল্যায়ন হবে।
(৫) একই মেশিন পরবর্তী যে কোন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে।
(৬) কেন্দ্র দখল করে ভোটের ফলাফল পাল্টিয়ে ফেলা সম্ভব হবে না।

ইভিএম-এর ইউনিট সমূহ:
প্রতিটি বুথের জন্য একটি করে ইভিএম ব্যবহার করতে হয়। প্রতিটি ইভিএম এর দুটি ইউনিট বা অংশ রয়েছে যথাঃ ব্যালট ইউনিট ও কন্ট্রোল ইউনিট। দুটি ইউনিট একটি তারের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। মেশিনটি সম্পূর্ণ ব্যাটারী চালিত।

১. ব্যালট ইউনিট
ব্যালট ইউনিটটি থাকে বুথের ভেতরে। ব্যালট ইউনিটের উপর প্রার্থীর নাম ও প্রতীক ছাপানো থাকে। প্রতিটি প্রতীকের পাশে রয়েছে একটি করে সুইচ। কোন প্রতীকের পাশের সুইচটা চেপে দিলে তার পাশে একটি ছোট সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে ও একবার দীর্ঘ বীপ ধ্বনি শোনা যায়। বাতি জ্বলা ও বীপ ধ্বনি শুনে ভোটার বুঝতে পারবেন যে তার ভোট গৃহীত হয়েছে। অক্ষরজ্ঞানহীন লোকও সহজেই ইভিএম দ্বারা ভোট প্রদান করতে পারবেন।

ভোটার ভোট প্রদানের সাথে সাথে যন্ত্রটি ভোটের তথ্য তার মেমোরিতে নিয়ে নেয়। ইভিএম-এর মেমোরী নূন্যতম ১০ বছর তথ্য অবিকৃতভাবে ধরে রাখে।
২. কন্ট্রোল ইউনিট
কন্ট্রোল ইউনিট থাকে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের সামনের টেবিলে। এই ইউনিটে “ব্যালট” নামক একটি সুইচ রয়েছে যা চাপলে বুথের মধ্যে রাখা সংযুক্ত ব্যালট ইউনিটটি একটি ভোট নেয়ার জন্য কার্যকর হয়। “ব্যালট” সুইচ চেপে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ভোটারকে ভোট দিতে বুথে পাঠান। ভোটার ভোট প্রদানের সাথে সাথে ব্যালট ইউনিটটি অকার্যকর হয়ে যায়। সেই অবস্থায় বারবার আরও ভোট দিলেও মেশিন তা গ্রহণ করে না। ভোট দান শেষে ভোটার বুথ থেকে বেরিয়ে গেলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের “ব্যালট” সুইচটি চেপে পরবর্তী ভোটারের জন্য ব্যালট ইউনিটটি কার্যকর করতে পারেন। কন্ট্রোল ইউনিটে আরও কয়েকটি সুইচ রয়েছে। সেগুলি সম্পর্কে পরবর্তীতে বলা হয়েছে।

কন্ট্রোল ইউনিটের সামনের দিকে একটি বড় ডিসপ্লে সংযুক্ত রয়েছে যা সকলে দেখতে পারেন। ভোটার সঠিকভাবে ভোট দিতে পারলে ডিসপ্লেটির সংখ্যা এক বেড়ে যায়। এর ফলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বা পোলিং এজেন্টরা সহজে বুঝতে পারেন যে ভোটারের ভোটটি মোট ভোটের সঙ্গে যোগ হলো অর্থাৎ ভোটটি গৃহীত হলো।

ভোট গণনার পদ্ধতি:
প্রতিটি বুথের ফলাফল আলাদাভাবে দেখা যায়। ভোট গ্রহণ শেষ হলে প্রথমে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের “ক্লোজ” সুইচটা চেপে ভোট গ্রহণের সমাপ্তি টানবেন। এই সুইচটা চাপার পর ব্যালট ইউনিটটি আর কার্যকর করা যাবে না। এর পর সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার “ফাইনাল রেজাল্ট” সুইচটা চাপলে ব্যালটে প্রথম প্রার্থীর প্রতীকের নাম ও প্রাপ্ত মোট ভোট কন্ট্রোল ইউনিটের ডিসপ্লেতে দেখা যাবে। “ফাইনাল রেজাল্ট” সুইচটি দ্বিতীয়বার চাপলে দ্বিতীয় প্রার্থীর, এভাবে একে একে সব প্রার্থীর প্রাপ্ত মোট ভোট দেখা যাবে। পূর্ব থেকে সরবরাহ করা একটি ফরমে প্রাপ্ত ভোট সংখ্যাগুলো লিখে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারকে দেবেন। প্রতিটি বুথের ফলাফল একীভূত করে প্রিজাইডিং অফিসার অন্য একটি ফরমে তুলে সই-স্বাক্ষর করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে তা পাঠানোর ব্যবস্থা নিবেন।

এক সাথে একাধিক সুইচ চাপলে যা ঘটবে?
ভোটার যদি একসাথে দুটি সুইচ চাপেন তাহলে ভোট গৃহীত হবে না এবং ভোটার তিনটি বীপ ধ্বনি শুনতে পাবেন। তার অর্থ হলো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট বাতিল হওয়ার কোন বিষয় নেই। বাস্তবক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে যে, কয়েকটি আসনে বিজয়ী প্রার্থী আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানের চেয়ে বাতিল ভোটের সংখ্যা বেশী। অর্থাৎ ভোটগুলো বাতিল না হলে ফলাফল উল্টোও হতে পারতো। ইল্ট্রেনিক ভোটিং মেশিনে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।

এক ব্যক্তি একাধিক ভোট প্রদান করতে চাইলে
একজন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীর পাশের সুইচ যতবারই চাপুন না কেন, প্রথমবার যে ভোটটি দিয়েছেন শুধু সেটিই গৃহীত হবে। আর কোনো ভোট গৃহীত হবে না। এতে জাল ভোট দেওয়ার ন্যূনতম কোনো আশঙ্কা থাকবে না।

এমজে/

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি