ঢাকা, রবিবার   ১৯ মে ২০২৪

সফিক শিকদার আওয়ামী লীগের জন্য কিছুই করেননি?

প্রভাষ আমিন

প্রকাশিত : ১৬:৩১, ৪ মে ২০২৪ | আপডেট: ১৭:০০, ৪ মে ২০২৪

প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে আমি যখন কুমিল্লায় যাই কলেজে ভর্তি হতে, তখন তিনি হিরো। হিরো মানে হিরোই। তখন মুম্বাইয়ে ‘হিরো’ ছবি দিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা জ্যাকি শ্রুফের স্টাইলের সাথে তার দারুণ মিল ছিল। এটি অবশ্য আমার মত। এই হিরো সফিক শিকদার তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। রাজপথের লড়াকু সৈনিক। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার নানান সাহসিকতার গল্প তখন মুখে মুখে, আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তখন তার লড়াইটা ছিল বহুমুখী। রাজপথে ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই। কলেজ ক্যাম্পাসে নৃশংস ছাত্রশিবিরের মুখোমুখি।  কদিন পর এলো সশস্ত্র ফ্রিডম পার্টি। বহুমুখী এই লড়াই তিনি লড়েছেন সাহসের সাথে। শুধু সফিক শিকদার নন, ৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কুমিল্লার শিকদার পরিবারের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বড় কোনো পদ ছিল না, কিন্তু শিকদার পরিবারের সবচেয়ে বড় আওয়ামী লীগার ছিলেন সফিক শিকদারের পিতা মরহুম ফজলুল করিম শিকদার। 

সফিক শিকদারের ছোট ভাই লিটন শিকদার ছাত্রলীগ করেছেন, যুবলীগ করেছেন। তার আরেক ছোটভাই কবির শিকদার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নির্বাচিত সভাপতি, বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা। তার ছোট বোন ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার জলি কবির মহিলা আওয়ামী লীগের নোয়াখালী জেলা সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। জলি কবিরের স্বামী এডভোকেট হুমায়ুন কবির রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সভাপতি। সফিক শিকদারের ভাগিনা, ছাত্রলগের সাহসী সৈনিক দুলাল প্রাণ হারিয়েছেন দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে। কুমিল্লা পৌরসভার প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান হাজী তারু মিয়া তার নানা। সাবেক সাংসদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার আহমেদ তার মামা। কিন্তু দলীয় আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন সফিক শিকদারের সাথে তার মামার রাজনৈতিক বৈরিতা ছিল কুমিল্লার রাজনীতির আলোচিত ঘটনা।

কুমিল্লার মোগলটুলিতে শিকদার পরিবারের বাসাটি ছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল। ঢাকার অনেক ছাত্রনেতাও আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিতেন এই বাসাটিকে। শেখ হাসিনা বারবার বলেন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তার তৃণমূল। এই তৃণমূলের শক্তির কারণেই ৭৫এর পর আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা যায়নি। সেই তৃণমূলের একটা শক্তিশালী শিকড় কুমিল্লার শিকদার পরিবার। সফিক শিকদার একজন আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ। তার দুয়ার সবসময় সবার জন্য খোলা থাকতো। রাত-বিরাতে কত বিপদাপন্ন মানুষ তার সহায়তা পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দলের কর্মীদের জন্য রাতভর থানায় গিয়ে বসে থাকতেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আমার কাছে কত মানুষ পাঠিয়েছেন, তার সংখ্যা গুনে রাখা মুশকিল।

ছাত্র রাজনীতির পর তিনি টানা ১৭ বছর কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। সারাজীবন দলের জন্য কাজ করেছেন। বিশাল পরিবারকে ছায়া দিয়ে রেখেছেন। নিজের জন্য কিছুই করেননি। রাজনীতিকে কখনো টাকা বানানোর মেশিন করেননি।

সারাজীবন দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলেও কুমিল্লার রাজনীতির নানা সমীকরণে সফিক শিকদার এবং শিকদার পরিবার কোনঠাসা হতে হতে এখন প্রায় অপাংক্তেয়। সফিক শিকদার যেন এক ভুলে যাওয়া নাম। যেন আওয়ামী লীগের জন্য তিনি বা তার পরিবার কিছুই করেননি। টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, কিন্তু শিকদার পরিবার কোথাও নেই। এত বঞ্চনা, অবহেলার পরও সফিক শিকদার বা শিকদার পরিবারের কেউ কখনো দলের সাথে বেঈমানী করেননি। রাজপথের লড়াকু সৈনিক সফিক শিকদার জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই নানা অসুখ কাবু করে ফেলেছে তাকে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস ভোগাচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। ঈদের কয়েকদিন আগে পায়ের পাতায় একটা সমস্যা হয়েছিল। শুকাচ্ছিল না বলে কুমিল্লায় অপারেশন করে পায়ের দুটি আঙ্গুল ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। উল্টো ইনফেকশন আরো বেড়ে যায়। ঢাকায় এনে প্রথমে বারডেম, পরে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার সিসিইউতে ভর্তি আছেন তিনি। ভর্তি নয় শুধু, আসলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। 

সংক্রমণ ঠেকাতে পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ডাক্তাররা। কিন্তু হার্ট এবং কিডনি দুর্বল থাকায় অপারেশন করার মত অবস্থায় নেই উনি। আবার পা কেটে ফেললেও যে ভালো হয়ে যাবেন, তেমন নিশ্চয়তাও দিতে পারছেন না ডাক্তাররা। এটা একটা চেষ্টা মাত্র। সফিক শিকদার বারবার ডাক্তারদের অনুরোধ করছেন, যেন তার পা কাটা না হয়। তার আকুতি, ‘এটা রাজপথের পা। আমি আবার এই পায়ে মিছিল করতে চাই।‘ তার সেই চাওয়া পূরণ হবে কিনা, তেমন গ্যারান্টি দিতে পারছেন না কেউই। সফিক শিকদারকে বাঁচাতে পুরো পরিবার একাট্টা হয়ে তার পাশে দাড়িয়েছে। কিন্তু টাকা খরচ হচ্ছে পানির মত। হাসপাতালের খরচ মেটাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, সারাজীবন রাজনীতি করা সফিক শিকদার আসলে নিজের জন্য কিছুই করেননি। যে সংগঠনের জন্য তিনি সারাজীবন উৎসর্গ করলেন, সেই সংগঠন কোথাও নেই। আওয়ামী লীগের কাছে সফিক শিকদার যেন এক ভুলে যাওয়া নাম। নিজের পায়ে আবার যিনি মিছিলে যেতে চান, সেই মিছিলের সাথীরা আজ কোথায়? অন্তত হাতটা একটু ধরার জন্যও তো তারা আসতে পারেন। শেষ সময়ে সফিক শিকদারকে জানাতে পারেন আওয়ামী লীগ তাকে ভুলে যায়নি। যে সফিক শিকদাররা দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের পাশে ছিল, তার দুঃসময়ে কি আওয়ামী লীগ পাশে থাকবে না?

লেখক- প্রভাষ আমিন : বার্তাপ্রধান এটিএন নিউজ। 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি