ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা : বিশ্ব মানবতার কন্ঠস্বর 

তাপস হালদার

প্রকাশিত : ১০:৪৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, বাংলাদেশের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিন। এই দিন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট জাতিসংঘে ভাষণ দেন। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য এক মাহেন্দ্রক্ষণ। 

তখনকার সময়ে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ খুব সহজ বিষয় ছিল না। জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি চীন, তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ছিল প্রবল আপত্তি। জাতিসংঘের স্বীকৃতির পাওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু মাত্র তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্র নীতির কারনে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সফল হয় বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশের মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। এর মাত্র সাত দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। জাতিসংঘে এটিই ছিল প্রথম বাংলায় ভাষণ। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ পেয়েছে গর্ব করার সুযোগ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনা। কিন্তু ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেয়া ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাহসী উচ্চারণ।

সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতাফ্লিকা। শুরুতে সভাপতি বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন। কারণ জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি, ফ্রেঞ্জ, আরবি, রাশান, চায়নিজ ও স্প্যানিশ এই ছয়টি। তার মধ্যে বাংলা ভাষা নেই। বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে বলেন ‘মাননীয় সভাপতি আমি আমার মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই’। 

বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে অধিবেশনের সভাপতি জাতির পিতাকে বাংলায় বক্তব্য দেয়ার অনুমতি দেন।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মঞ্চে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরা ছিল বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন, সেদিন তিনি সেই স্বপ্নপূরণ করে ইতিহাস তৈরি করেন। বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর মমত্ববোধ। তিনি দিয়ে হৃদয় ধারণ করতেন বাংলা ভাষাকে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভাষা আন্দোলনে রেখেছেন অসামান্য অবদান। ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন তিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন। এটি ছিল আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি লাভের প্রথম পদক্ষেপ।

সেদিনের ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত, শোষিত মানুষের কথা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি সাহসী উচ্চারণ। ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, বিশ্ব মোড়লদের শোষন বঞ্চনা, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে অবস্থান, পারস্পারিক ঐক্যের কথা তুলে ধরেছিলেন।

তিনি বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশ আজ যে বিশ্ব সভায় প্রতিনিধিত্ব করছে সেটিকে স্মরণ করে বলেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙ্গালি জাতির ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহুর্ত। বাঙ্গালি জাতির আজ স্বপ্নপূরণ হওয়ার দিন। জাতি হিসেবে আজ বাঙ্গালি গর্বিত।’

বঙ্গবন্ধু বক্তব্যের শেষ অংশে আরো বলেন, ‘মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করতে চাই।’

মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই। আমাদের মতো দেশগুলো যাদের অভ্যুদয় সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে, এই আদর্শে বিশ্বাসই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হতে পারে, কিন্তু আমাদের ধ্বংস নেই। এই জীবন যুদ্ধের মোকাবেলায় জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ কথা। আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। ----সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হতে পারি, গড়ে তুলতে পারি উন্নততর ভবিষ্যৎ।’

বাংলা ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন’ বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক মুজিব’ বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এ যাবৎ আমরা কিংবদন্তি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব। বুলেটিনটিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে বিশ্ব নেতাদের মতামত তুলে ধরা হয়। ভাষণ শুনে জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ।’

বিশ্ব সভায় বাংলাকে এর আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেনি। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করে ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের ৫১ তম অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দেন। তারপর থেকে তিনি প্রতিবছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সফল কুটনীতির ফলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। আজ প্রিয় বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশ পালন করছে।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ব সভায় মাত্র একটি ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি বিশ্বশান্তির সঙ্গে ন্যায় সমতার তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, ‘মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরী এবং তাহা সমগ্র বিশ্বের নর-নারীর গভীর আকাঙ্খারই প্রতিফলন ঘটাইবে। এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিই দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে।’ 

বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাও পিতার মতই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবব্ধ। এজন্যই তিনি স্পষ্ট করে বলতে পেরেছেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে।’ তাই তো বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক নিপীড়িত ও রোহিঙ্গাদের মতো নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ জাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তণ  জনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় দেশরত্ন  শেখ হাসিনা দৃঢ় পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বিশ্বে হচ্ছে ব্যাপক প্রশংসিত। করোনা ভ্যাকসিন নিয়েও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ভ্যাকসিন কে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সকল দেশ যাতে সময় মত এবং একই সঙ্গে ভ্যাকসিন পায়, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের কথা বলেন নি। তিনি সবসময় সকল অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা বলেন। এটাই বঙ্গবন্ধু কন্যার বৈশিষ্ট্য।

এবারের ৭৬তম সাধারণ অধিবেশন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার জাতিসংঘে ১৮তম ভাষণ। জাতিসংঘের ইতিহাসে আর কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট/প্রধানমন্ত্রী এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হয়নি। জাতিসংঘ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রমে অসাধারণ অবদানের জন্য দেশরত্ন শেখ হাসিনার মতো আর কেউই এত বেশি অ্যাওয়ার্ড/পদক লাভেও সক্ষম হননি। তিনি মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের বিশেষ স্বীকৃতি স্বরূপ ২৮টিরও অধিক অ্যাওয়ার্ড/পদক পেয়েছেন। সর্বশেষ যখন জাতিসংঘে গিয়েছিলেন তখন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে মানবিক ও দায়িত্বশীলতার নীতির জন্য অনন্য নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মর্যাদাপূর্ণ ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৮ ‘স্পেশাল ডিস্টিংশন অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মাননা পেয়েছিলেন। এ বছর আবার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের পথে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কন্ঠস্বর। পিতার দেখানো পথেই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা এগিয়ে চলছেন। মানবতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হয়ে উঠেছেন ‘বিশ্ব মানবতার মা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে বিশ্বমঞ্চে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন আজ তাঁর কন্যার হাতে আত্মমর্যদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। 
লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল : haldertapas80@gmail.com

এসএ/
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি