ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

অন্ধজনে দেহ আলো’য় ‘বার্ডো’

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ১৯:২৩, ২২ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২০:২৫, ২২ জুলাই ২০২০

স্থানীয় অসহায় নারীদের নিয়ে সভা করছেন বার্ডোর কর্মীরা, বরিশাল। ছবি- বার্ডো’র পক্ষ থেকে

স্থানীয় অসহায় নারীদের নিয়ে সভা করছেন বার্ডোর কর্মীরা, বরিশাল। ছবি- বার্ডো’র পক্ষ থেকে

অন্ধকার। শব্দটি শুনলেই বা কোথাও এর লেখ্য রূপ দেখলেই আমাদের ভাবনায় কি ধরা পড়ে? যেন সব কিছু থমকে আছে। নিরব-নিস্তব্ধ-নির্জীব। এ অন্ধকারই যুগে যুগে মানুষকে থামিয়ে দেওয়ার পায়তারা করেছে। এখনও করছে। যিনি অন্ধ তিনি জানেন অন্ধকারের উন্নাসিকতার আড়ালে প্রথ চলতে কি প্রতিবন্ধকতারই সম্মুখিন হতে হয়। আর যারা জগতের রূপ কিছুকাল অবলোকন করার পর অন্ধত্ব বরণ করেছেন তাদের কাছে এ অবস্থা আরও কষ্টের বৈ কম নয়। তখন হয়ত তাদের কাছে এ প্রশ্নটাই বার বার ঘুরে ফিরে আসে, ‘দৃষ্টি যদি নিয়েই যাবে তবে দিলে কেন?’। হয়ত বিধাতাকে তারা এ প্রশ্ন করেছেন নয়ত বা এক সময় করবেন বলে মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন।

শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে এখনও সমাজে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয়। তবে অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আবার দৃষ্টিহীনতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে অথবা অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীরা বাস্তবতার কষাঘাতের চরমাঘাত সাঙ্গ করে জীবন যুদ্ধে নামেন। বখতিয়ারের ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছেন। হয়েছেন জয়ী। তেমনি একটি সংগঠন, ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো)। সংগঠনটি সব ধরণের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়নে কাজ করছে। 

চলতি বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত সংগঠনটি ৩ দশকে পা ফেলেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নানা অগ্রযাত্রার অগ্রপথিক হয়েছে ‘বার্ডো’। ১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি শুরুতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের কাজ শুরু করলেও পরবর্তিতে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সব ধরণের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান বার্ডো’র নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুল হক। ৫৩ বছর বয়সী সাইদুলও যখন দৃষ্টি হারান তখন বয়স মাত্র ৬। ৪৭ বছর ধরে নিজের অন্ধকার জগতের সান্নিধ্যে অজস্র দৃষ্টিহীনকে করেছেন স্বাবলম্বি। শিশুকালে টাইফয়েড জ্বরের কারণে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়া সাইদুল দমে না গিয়ে বরিশাল সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। এসএসসি (১৯৮৩), বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি (১৯৮৫), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক (১৯৮৮) ও স্নাতকোত্তর (১৯৮৯) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বিএড ডিগ্রি (১৯৯৮) অর্জন করেন। সাইদুল হক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিদের অবস্থা জানার চেষ্টা করছেন। তিনি বেলজিয়াম, জার্মানি, ভারত, জাপান, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। অর্জন করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ডিগ্রি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অশোকা ফেলোশিপ ‘অশোকা ইনোভেটরস্ ফর দ্য পাবলিক’ এবং বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষ থেকে রবার্ট এস ম্যাকম্যানার ফেলোশিপ অন্যতম।

বার্ডো’র নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুল হক। ছবি- বার্ডো’র পক্ষ থেকে

বার্ডো বর্তমানে ঢাকা, গাজীপুর, বরিশাল ও বানারিপাড়া, মাদারীপুরসহ ৫টি কেন্দ্রের মাধ্যমে মোট ৭৫০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে এ সংগঠনটি ৪০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্র নিয়ে আবাসিক বিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালিত করছে। যাদের ব্যয়ভারও সংগঠনটি বহন করে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে তথ্য ও প্রযুক্তির জ্ঞানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য বার্ডো স্থাপন করেছে একটি ব্রেইল গ্রন্থাগার। ব্রেইল বই ও টকিং বুক’র এর চাহিদা পূরণ করার জন্য বেইল বই প্রোডাকশন কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্টীর সামাজিক মর্যাদা, ন্যায় বিচার, সমঅধিকার, নেতৃত্ব বিকাশ, রেফারেল সার্ভিস, প্রাইমারী রিহেবিলিটেশন থেরাপী প্রদান (পিআরটি), সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচীতে অর্ন্তভুক্ত, সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বার্ডো। 

সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ছবি- বার্ডো’র পক্ষ থেকে

সমাজভিত্তিক পুর্নবাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে গাজীপুর সদর, বরিশাল সদর এবং বানারীপাড়ায়, মাদারীপুর ও ঝালকাঠি ৫টি শাখার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, সচেতনতামুলক কার্যক্রম, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, আইনের সহায়তা প্রদান ও বিনোদনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে সমাজে ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা চলছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দ্বারা স্ব-সংগঠন তৈরী করা হচ্ছে। বর্তমানে টংগীতে ১১টি, বরিশালে ৮টি, বানারীপাড়া ১১টি এবং ঝালকাঠিতে ১০টিসহ মোট ৪০টি স্ব-সংগঠন রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কম্পানিতে চাকরি পাওয়ায় সহায়তা করেছে তারা। বর্তমানে দেশের ছয়টি জেলায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছেন বার্ডোর ৭৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী, যার মধ্যে ১৭ জন রয়েছে প্রতিবন্ধী। 

কথা হচ্ছিল সাইদুল হক ও তার সংগঠনের বেশ কয়েকজন সুবিধাভোগীর সঙ্গে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এসব মানুষের মুখের দিকে তাকালে যেন ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় না, তার স্বাভাবিক মানুষের মতো নন। তারা শারীরিকভাবে অক্ষম। তাদের কর্মস্পৃহায় যেন ঢেকে আছে সব। সংগঠনের শুরুতে নানান সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছে বলে জানান সাইদুল হক। তবে সময়ের পরিক্রমায় এ সংকট তেমন একটা নেই, ‘অর্থ, নির্দিষ্ট স্থান এবং আমার সহযোগীদের মধ্যেকে নেতৃত্ব দেবে। এসব বিষয় নিয়ে সব পিছিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু আমি থামিনি।’ একুশে টেলিভিশনের কাছে এমনটিই বলেছিলেন সাইদুল। অবহেলার যাতনা কিভাবে মন ও অবস্থানকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে একটা মানুষকে পুরোপুরিভাবে অচল করে দেয় সেই যন্ত্রণার সব ডিগ্রিই যেন অর্জন করেছেন সাইদুল। বঞ্ছনার পর বঞ্ছনা সহ্য করে টিকে থাকা তাও আবার সম্মানের সঙ্গে। এ বঞ্ছণা ও অবহেলা শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সাইদুল হক জানান তাদের লক্ষ্যের কথা। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরাও দেশের সম্পদ। তাদের পিছনে রেখে দেশ তো এগিয়ে যেতে পারে না। শিশুকাল থেকেই যেসব প্রতিবন্ধীরা পরিবারের অবহেলার শিকার হচ্ছেন তাদের এগিয়ে নিতেই কাজ করছি আমরা।’

বার্ডো’র শ্রেণিকক্ষে শিশুরা। ছবি- বার্ডো’র পক্ষ থেকে

বার্ডোর মধ্যমে নিজের অক্ষমতাকে পিছনে ফেলে এখন সংগঠনটিতেই কাজ করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। তারা মানসিক শক্তির কাছে হার মানিয়েছেন সব। রাজধানীতে বার্ডোর রূপনগরের কার্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কাজ করেন ফিরোজা আক্তার। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি বলেন, ‘এখানে কাজ করে কখনও নিজেকে অক্ষম মনে হয়নি।’ রাজধানীর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রহিমা পাটোয়ারী মিশনারি স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণি শেষে ভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর দৃষ্টিশক্তি হারান। পরে বার্ডোর কম্পিউটার প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে বার্ডোতেই প্রশিক্ষক তিনি। 

তবে বার্ডো আর্থিকভাবে যেন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় ১৪-১৫ জন মানুষের মাসিক নির্দিষ্ট পরিমাণ দেওয়া সহায়তার ওপর ভিত্তি করে চলছে এর কাজ। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক পরিশ্রমিক/বেতন ৪ লাখ। প্রতিবন্ধীদের হাস্যোজ্জ্বল আলোড়িত সংগঠনটি সব সময় এ খরচ বহন করতে পারে না। বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তবে কি ক্লান্তি কি ঝেঁকে বসবে সংগঠনটির ঘাড়ে? এই মুহূর্তেই দরকার সহযোগিতার শক্ত হাত। এতে এ সংগঠনটি প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে সমাজে আরও ভূমিকা রাখতে পারবে। 

বার্ডো’র ৩০ বছরের পর্দাপন উপলক্ষে ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠান- ছবি- বার্ডো’র পক্ষ থেকে

উদযাপনে ৩০ বছরে পর্দাপন:

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে থমকে গেছে সব। বিপর্যস্ত পৃথিবীতে কোন কিছুই এখন নিয়ম মাফিক হয় না। করা যাচ্ছে না পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। বার্ডোর ৩০ বছরে পা রাখার সময়কে স্মরণীয় করতে ঘটা করে দিবসটি পালনের পরিকল্পনা থাকলেও তা ভেস্তে যায়। ১৮ জুলাই এক অনলাইন সভার মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান, বিশেষ অতিথি ছিলেন আহসান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরচিালক প্রকৌশলী কামরুল আহসান এবং এনর্জিপ্যাক’র পরিচালক প্রকৌশলী নুরুল আক্তার প্রমুখ।  

এমএস/এসি


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি