ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

অভিনয়ের ব্যাপারটা ওভাবে ভাবা হয়নি : আঁখি

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৯:৪০, ১২ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৯:১০, ৪ মার্চ ২০২০

আঁখি আলমগীর। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সংগীত শিল্পী। হালের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। মিষ্টি সুরের অগণিত গান দিয়ে মন জয় করেছেন নানা বয়সী মানুষের। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দাপটের সঙ্গে গান গেয়ে চলেছেন এই শিল্পী। তার রয়েছে অগনিত ভক্ত।

ভক্তদের মধ্যে অনেকেই এই সুদর্শনী শিল্পীকে অভিনেত্রী হিসেবে দেখতে চাইলেও তিনি ওই দিকে আগ্রহ দেখাননি। দ্যুতি ছড়ান গানের জগতে। ইটিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আঁখি আলমগীর কথা বলেছেন নিজের ভালো লাগা নিয়ে, সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে, ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেনআউয়াল চৌধুরী

ইটিভি অনলাইন : বাবার চলচ্চিত্রে ‘গল্প কথার কল্পলোকে জানি, একদিন চলে যাবো’ শ্রুতিমধুর গানে সম্প্রতি কণ্ঠ দিয়েছেন, কেমন লাগলো ?

আঁখি আলমগীর : চলচ্চিত্রে অনেক বছর ধরে গান গাই। বাবার চলচ্চিত্রে গান করছি এটা একটা আলাদা প্রেসার ছিল। তারপর শ্রদ্বেয় রুনা লায়লা এই গানটির সুর দিয়েছেন এবং এটিই তার প্রথম সুর করা গান, যেখানে আমি কণ্ঠ দিয়েছি। কাজেই ওনার সুর করা একটা গানে প্রথম কণ্ঠ দিচ্ছি এটা আমার জন্য একটা কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। অনেক প্র্যাকটিসের পর যেভাবেই হোক ওনার জন্য আমি নিজেকে তৈরি করেছিলাম। রেকর্ডিংয়ের দিন মিউজিক ডিরেক্টরকে হ্যাপি দেখে অনেক ভাল লেগেছে। সবাইকে খুশি করে স্টুডিও থেকে বের হতে পেরেছি। তাছাড়া ফিল্মের ডিরেক্টর যখন হ্যাপি হয়েছেন তখন মনে হয়েছে কষ্টটা  র্স্বাথক হয়েছে। এখন মানুষের কাছে পৌছানো পর্যন্ত অপেক্ষা। হয়ত মানুষ এ গানের মাধ্যমে একজন নতুন আঁখিকে খুঁজে পাবে।

ইটিভি অনলাইন : ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর আপনাকে আর দেখা যায়নি। এখন যদি নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের অফার আসে, করবেন?

আঁখি আলমগীর : হা হা হা, আপনার কি মনে হয় আমাকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কেউ অফার করেনি। এটাও কি সম্ভব যে, কেউ অফার দেয়নি? আসলে অভিনয়ের ব্যাপারটা ওভাবে ভাবা হয়নি। এদেশের অনেক বড় বড় প্রডিউসাররা আমাকে অভিনয় করার জন্য বলেছিল। এখন আমি কারো নাম বলতে চাচ্ছি না। আমাদের দেশের যারা আইডল তারাও আমাকে বলেছে। কিন্তু অভিনয় আমাকে সেভাবে টানে নি। আর মনে হয়েছে যদি কাজ ভালো না হয়, না পারি। একটা ভয় কাজ করেছে। এজন্য সেভাবে আর পারা হয়নি।

আসলে গানে অনেক সময় দিতে হয়। তারপর নিজের একটা ব্যাক্তিগত জীবনও থাকে। আমি যদি সব কাজ একাই করতে থাকি তাহলে আমার লাইফ বলে কিছু থাকবে না।

ইটিভি অনলাইন : অভিনয় তো আপনার রক্তের সঙ্গে

আঁখি আলমগীর : হ্যাঁ অভিনয়টা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। আমি একটা ছোট্ট ইতিহাস বলি, বাংলাদেশের সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর প্রডিউসার ছিলেন আমার দাদা। তাহলে আমরা কত আগে থেকে এ সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। বলতে গেলে এটা আমাদের ঐতিহ্য। আমরা ঐতিহ্যগতভাবে অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই বংশের মেয়ে হিসেবে অভিনয়ে আসাটা হতেই পারতো। কিন্তু আমারও মনে হয়েছে একটা নতুন কিছু করি। আমার জন্য গানটাই চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ আমাকে সংগীত শিল্পী হিসেবে হয়তো অনেকে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। সবাই বলেছিল হয়তো অভিনয়-ই করবো। আমি যে গান গাইবো, গানে প্রতিষ্ঠা পাবো, এটা কখনো অন্যারা বিশ্বাস করতে চায়নি। গানটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। অভিনয় করাটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল না। চ্যালেঞ্জটাই গ্রহণ করেছি। এবং দর্শকের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।

ইটিভি অনলাইন :  আপনার পরিবার সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

আঁখি আলমগীর : আমার মায়ের অনেক বিখ্যাত গান আছে। শুধু বাবা-মা নয়, আমার দাদাও বিখ্যাত ছিল। আমার নানী একজন লেখক ছিলেন। কবি জুবেদা খাতুন। আমি দুই দিক থেকে একটা সংস্কৃতিময় পরিবার পেয়েছি। এ বিষয়গুলোর কারণে আমি নিজেকে লাকি মনে করি। এই একটি বিষয়ের জন্য মানুষ হিসেবে কিংবা শিল্পী হিসেবে বলেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছি। কারণ একজন ভালো শিল্পী হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হওয়া প্রয়োজন আছে। ভালো মানুষ বলতে বিরাট কিছু বা মহৎ হওয়া লাগে না। মানবিক গুণাবলী থাকাটিই জরুরি। সেগুলো আমাদের ভেতরে আছে। এ জন্য অবশ্যই আমার পরিবারকে থ্যাঙ্কস দিতেই হবে। 

ইটিভি অনলাইন : আপনি বাংলাদেশের একজন খুবই জনপ্রিয় শিল্পী। সুরের যাদু ছড়ান সবখানে। আপনার গানের হাতেখড়ি কার কাছ থেকে?

আঁখি আলমগীর : অবশ্যই অনেকের অবদান আছে। আসলে গান তো গুরুমুখী বিদ্যা। আমারও গুরু ছিলেন। আমি অনেকের কাছেই গান শিখেছি। ওস্তাদ আক্তার সাদমানি, সঞ্জীব দে, শামসুল হুদা তাদের কাছে গান শিখেছি। ওস্তাদজিদের অবদানই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি। এরপর বাবা- মা’র সহযোগিতা উৎসাহ এবং পারিপার্শিক উৎসাহের মাধ্যমে আমি গান শিখেছি।

ইটিভি অনলাইন : গুরুদের কাছ থেকে আপনি গান শিখেছেন। ওই সময়ের এমন কোনো ম্মৃতি কি আপনার আছে যা আমাদের বলা যায় ?

আঁখি আলমগীর : আমি এখনো গান শিখছি। আলাদা করে বলার মত আসলে কিছু নেই। আমার এখনো মনে আছে ওস্তাদজি আক্তার  সাদমানি যখন গান শেখাতে আমাদের বাসায় আসতেন, তখন আমার ছোট বোন পালিয়ে যেত। ওস্তাদ আমাদের দুজনকেই গান শেখাতেন। আর আমরা দুজনই ছোট ছিলাম। সেও আমার বয়সী। অনেক সময় আমি ওস্তাদজির জন্য বসে থাকতাম। আবার ওনি যা যা শিখতে দিতেন আমি শেখার চেষ্টা করতাম। আমার এখনো মনে রেওয়াজ করার জন্য সেই ভোর ৫টায় এলার্ম দিয়ে রাখতাম। তারপর ঘুম থেকে উঠে অনুশীলন শুরু করতাম। সেই চর্চাটা আমার এখনো কাজে লাগছে। কিন্তু এখন আগের মত আর রেওয়াজ করা হয় না।

ইটিভি অনলাইন : বর্তমানে ক্যাসেটের যুগ শেষ। সবাই ইউটিউব যুগে প্রবেশ করেছে। বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন ?

আঁখি আলমগীর : আসলে প্রযুক্তি যখন অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে যায়, হাতের মুঠোয় চলে আসে। তখন সেটার একটা ভাল দিকও আছে আবার মন্দ দিকও আছে। ঠিক একইভাবে গানের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সেটা হলো গানেও প্রযুক্তির ব্যবহার চলে এসেছে। রিলিজ করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার চলে এসেছে। সো যেটা চলে এসেছে সেটার বিষয়ে নেগেটিভ চিন্তা না করাই ভাল। এটার সদ্বব্যবহার করার চেষ্টা করাটাই উত্তম বলে আমি মনে করি। যখন যে মাধ্যমটা সবার মাঝে প্রচলিত সে মাধ্যমকে গ্রহণ করাটা উচিৎ।

ইটিভি অনলাইন : সংগীত শিল্পীদের জন্য কথা বলার কোনো নির্দিষ্ট ফ্লাটফরম নেই, সংগঠন নেই, বলা যায় বিচ্ছিন্ন, কেন ?

আঁখি আলমগীর : শিল্পীদের জন্য সংগঠন যে কখনো হয়নি তা না। কিন্তু সেটার কার্যক্রম বেশিদূর এগোয়নি। আমাদের চেয়ে বড় অনেকেই আছেন। তাদের ওপরতো কিছু করতে পারি না। কাজেই ওভাবে আগায়নি। এটা দুঃখজনক ব্যাপার। হয়ত ভবিষ্যতে সবার ভালোর জন্য একটা পরিবর্তন আসবে। সে জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। আমার মনে হয় সংগঠন করার ক্ষেত্রে হয়ত একতার কমতি ছিল তাই ব্যাপারটা এগোয়নি। তবে অবশ্যই সংগঠনের প্রয়োজন আছে। কারো কোন সমস্যা হলে সেখানে সংগঠনই পাশে এসে দাঁড়াবে।

তবে শিল্পীদের কিছু হলে সংগঠন ছাড়াও শিল্পীরা সবার আগে এগিয়ে আসে। এক্ষেত্রে সংগঠনের সে সময় দরকার হয় না। কারণ আপনি যে মাধ্যমে শিল্পী হন না কেন, শিল্পী মানেই শিল্পী। আপনি তার সঙ্গে রিলেটেড বা কানেকটেড। কিন্তু সংগঠন থাকলে সুবিধাও আছে। কিছু কিছু বিষয় থাকে যেগুলোর ব্যাপারে সংগঠনের মাধ্যমে এগুলো বেশি ভালো হয়।

ইটিভি অনলাইন : বর্তমানে নানা মাধ্যমে শিল্পী তৈরি হচ্ছে। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?

আঁখি আলমগীর : এটাকে আমি নেগেটিভলি দেখতে চাচ্ছি না। কারণ এমনটি শুধু আমাদের দেশে হচ্ছে না। সারা পৃথিবীতেই রিয়েলিটি শো হচ্ছে। এভাবে শিল্পী আসতেই পারে। যার কোন রকম সুযোগ নেই, এমনকি ঢাকায় আসারও সুযোগ নেই। সে কিভাবে শিল্পী হবে। সুতরাং তাদের জন্য এটা একটা ফ্লাটফর্ম। অনেকে খুব কম সময়ে এর মাধ্যমে তারকা খ্যাতিও পেয়ে যাচ্ছে। সো অনেক কিছু সহজ হয়ে গিয়েছে। এটা পজেটিভ বিষয়।

আমি যে চোখে দেখিনা কেন তাদের জন্য এটাতো পজেটিভ। আমার দৃষ্টিতে মনে হয় এভাবে শিল্পী তৈরি হতেই পারে। তবে  তাদেরকে গানের গ্রুমিং এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে একটু গ্রুম করা দরকার। তারাতো ছোট এটা তাদের দায়িত্ব না। তাদেরকে যারা নিয়ে এসেছে এ ফ্লাটফরমে তাদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাদেরকে শুধু শিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করলে হবে না। তাদের চলা-ফেরা, জীবন-যাপন, কথা বলা, কিভাবে মানুষকে ডিল করবে, ছোটদের  সঙ্গে তাদের ব্যবহার কেমন হবে, বড়দের কিভাবে শ্রদ্ধা করবে সব ব্যাপারগুলো তাদেরকে শেখানো ওই ফ্লাটফরমের দায়িত্ব। আসলে এই অঙ্গনে টিকে থাকাটাই তো কঠিন। আর টিকে থাকাটাই হলো যোগ্যতা। তবে টিকে থাকা জরুরি।

ইটিভি অনলাইন : আপনার এমন কোনো কষ্ট কি আছে, যা আমাদের শেয়ার করা যায়।

আঁখি আলমগীর : আসলে শিল্পীরাই বেশি কষ্ট পায়। তারা বেশি ইমোশনাল। যেকোনো অনাকাঙ্খিত বিষয়ে তারা আরো বেশি কষ্ট পায়। কেউ দেখায় কেউ দেখায় না। তবে আমার সেরকম কোনো কষ্ট নেই। আর থাকলেও আমি সেটা কাউকে জানাতে চাই না। আমি আমার কষ্ট নয়, হ্যাপিনেসটা সবার মাঝে শেয়ার করি। কষ্ট শেয়ার করি না। কষ্ট আমারই থাক।

ইটিভি অনলাইন : একজন শিল্পী হিসেবে সমাজের প্রতি কি ধরনের কমিটমেন্ট থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন ? 

আঁখি আলমগীর : সাধারন একজন মানুষ কিছু একটা বললে কয়জন সেটা শুনে। এক্ষেত্রে শিল্পী হিসেবে হয়ত আমার সুযোগটা বেশি। আমি একটা কিছু বললে সেটা মানুষের কাছে তাড়াতাড়ি পৌছাবে। আর সামাজিক কমিটমেন্ট সেটার দায়বদ্ধতো আছেই। দায়বদ্ধতার দৃষ্টি থেকে বলছি, আমাদের প্রথম দায়বদ্ধতা হচ্ছে মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন হওয়া। আর সেই সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আপনার যদি কছু থাকে সেটা একার কখনো হতে পারে না। সেটা শেয়ার করা উচিৎ। আমি মনে করি যার প্রয়োজন তার পাশে থাকা। প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের প্রথম দায়বদ্ধতা।

ইটিভি অনলাইন : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আঁখি আলমগীর : আপনাদেরকে ধন্যবাদ। ইটিভি অনলাইনের প্রতি শুভ কামনা রইল।

 

এসি/ এআর

 

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি