ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

আমার ‘চশমা’ সমাচার

আব্দুল কাইয়ুম

প্রকাশিত : ১৮:৩৪, ১১ মার্চ ২০২২ | আপডেট: ১৮:৩৭, ১১ মার্চ ২০২২

লেখকের চশমা

লেখকের চশমা

'চশমা' বর্তমান সময়ে অতি পরিচিত একটি নাম। চশমার সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ খুব কমই আছে। কেউ চোখের সমস্যার জন্য চশমা ব্যবহার করেন, আবার কেউ করেন ফ্যাশনের জন্য। চশমা হল মূলত কাচের তৈরী দুটি গ্লাস, যা একটি ফ্রেমের সঙ্গে লাগিয়ে দুই কানের সংযোগে ব্যবহার করা হয়। 

আমাদের চারপাশে চশমা ব্যবহার করা মানুষের অভাব নেই। ছোট-বড় কিংবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন। যারা চশমা ব্যবহার করেন তাদের জীবনে ঘটে চশমাকে ঘিরে নানান ঘটনা। যা স্বরণীয় করে রাখার মতো। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।

আমার চশমা ব্যবহার বেশি দিনের নয়। এইতো, ২০১৫ সালের শুরুর দিকের কথা। চোখের সমস্যা নিয়ে গেলাম চক্ষু ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সাহেব আমার চোখ দেখার পর বললেন, একটু সমস্যা আছে। তাই কিছু ঔষধ, চোখের ড্রপ এবং চশমা ব্যবহারের নির্দেশ দেন তিনি। কথাটা শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকেও চশমা ব্যবহার করতে হবে! কিন্তু কিছুই করার ছিল না! ডাক্তারের পরামর্শক্রমে চশমা নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। 

গ্রামে গিয়ে চশমা পরে যখন বাইরে বের হলাম, তখন দেখলাম, সবাই আমার দিকে কেমন যেন ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার গ্রামে আমি কোনো নতুন অতিথি! নয়তো ভিন গ্রহের কোনো প্রাণি! তা আমি নিজেও অনুমান করতে পারছি না। 

যাইহোক, সকলের তাকানো সহ্য করেই চলতে লাগলাম। কিন্তু এবার বন্ধুদের থামায় কে? আমাকে দেখার সাথে সাথেই তারা কা-না, কা-না বলে হাসাহাসি করতে করতে একাকার। কে থামায় তাদের? আমি শত বলেও তাদের বুঝাতে পারছিনা যে, আমার চোখের সমস্যার জন্য চশমা ব্যবহার শুরু করেছি। যাইহোক, তাদের কথার অত্যাচার সহ্য করতে হলো।

তখন সবেমাত্র একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই কলেজে। থাকতাম কলেজ হোস্টেলেই। এক ছুটিতে বাড়ি ফিরছিলাম বাসে করে। যখন বাস থেকে নামলাম, আমি আর আমার বন্ধু, তখন দেখি আমার কেমন যেন লাগছে। বাঁ-দিকে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছি আমি! কেন এমনটা হচ্ছে বুঝতেই পারছি না। মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। পাশেই ছিল এক থাবলা কাদা, আমি গিয়ে পড়লাম সে কাদায়। আমার জুতা ও প্যান্টে কাদা লেগে একাকার হয়ে গেছে। চশমায় হাত দিয়ে দেখি আমার বাম পাশের গ্লাসটা উধাও। 

ও.ও.ও.হ..হো, এই তাহলে কাহিনী! খুজতে লাগলাম আশেপাশে, কিন্তু পাচ্ছিনা। না পেয়ে দৌড়ে গিয়ে উঠলাম বাসে। বাস প্রায় চলে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে নাগাল পেলাম। বাসে উঠে দেখি, আমি যে সিটে বসে ছিলাম চশমার গ্লাসটা সেখানেই পড়ে আছে। গ্লাস নিয়ে চশমায় লাগিয়ে কাদা মাখা জুতা ও প্যান্ট কিছুটা ধুয়ে ফিরলাম বাড়ির দিকে।

এছাড়াও যারা চশমা ব্যবহার করেন, তারাই বলতে পারবেন- চশমার ওপর দিয়ে যে কত রকমের ধকল যায়। এখনই একজন এসে বলবে, দেখি চশমায় কেমন লাগে আমায়। কেউ আবার জিজ্ঞেস করবে, পাওয়ার কত? আবার কেউ  চশমা লুকিয়ে রেখে বলবে, কিছু না খাওয়ালে চশমা দেয়া যাবে না। আর চশমা ভেঙ্গে যাবার ঘটনা তো আছেই। 

যখন ছোট বাচ্চাদের কোলে নিই, তখন তাদের সর্বপ্রথম চোখ পড়ে আমাদের চশমার দিকে। চশমা হাতে নিতে কত যে জোরাজুরি- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনোক্রমে হাতে নিতে পারলেই ব্যস! ডাঁটি দুটি ধরে টান দিবে, ফলে হয় চশমা বাঁকা হয়ে যাবে, নয় তো ভেঙ্গে যাবে।

আপনারা সবাই জানেন, ছাত্রদের হাফ পাশ নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। দেখা গেছে, ছাত্রদের কাছ থেকে সহজে হাফ ভাড়া নিতে চাইতো না। আবার নিলেও সঙ্গে স্টুডেন্ট আইডি কার্ড না থাকলে কোনোক্রমেই হাফ পাশ নিতো না। সেই ঝামেলার মুহূর্তে আমি অনেকবারই চড়েছি বাসে। কিন্তু কখনো আমার কাছে হাফ পাশের জন্য ঝামেলা করেনি। তার প্রধান কারণ হল- আমার চোখের চশমা! আমার চোখে চশমা মানে হলো, আমি একজন ছাত্র। যার ফলে আমি যখনই হাফ ভাড়া দিয়েছি, সাথে সাথেই নিয়েছে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বরং মামা বলে হাসি মুখে ভাড়া নিয়ে গেছে। তার মানে বুঝা যাচ্ছে, চোখে চশমা থাকলে আলাদা একটা পরিচয় বহন করে।

চোখে চশমা থাকলে সমাজে একটু বেশি মূল্যায়ন পাওয়া যায়। কারণ, চশমাওয়ালা লোকদেরকে সবাই মনে করেন অনেক ভদ্র ও শিক্ষিত। চশমার ফলে অনেকে যেমন মূল্যায়ন করেন, তেমনি আবার অনেকে মনে করেন, সে চশমা পড়ে তার মানে তার চোখে সমস্যা আছে। তার মানে সে চোখে কম দেখতে পায়, অর্থাৎ অনেকে অন্ধও বলে থাকেন। তাছাড়া চশমা ব্যবহার একটি বিরক্তিকর বিষয়। যারা ব্যবহার করেন শুধু তারাই বিষয়টি বুঝতে পারবেন।

আমরা যে চশমা ব্যবহার করি, তার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ইতিহাসবিদরা প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার চিত্রিত প্রমাণ হায়ারোগ্লিফিকসে মানুষের চশমার ব্যবহারের আবিষ্কার করেছেন। সাধারণত কোনো জিনিসকে পরিষ্কার দেখার জন্য ওই সময় বিভিন্ন ধরণের কাঁচের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য চোখে কাঁচের ব্যবহারের লিখিত প্রমাণ রয়েছে। রোমান সম্রাট নিরোর একজন শিক্ষক ওই সময়ের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনার সঙ্গে দূরের জিনিস পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য জলমিশ্রিত এক ধরণের কাঁচ চোখে লাগানোর কথা বলেছেন। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করতে গিয়ে নিজের আসনে বসে রোমান সম্রাট নিরো বিশেষ এই কাঁচ চোখে লাগাতেন।

সত্যিকারের চশমা বলতে যা বোঝায়, তা প্রথম প্রচলিত হয় ইতালিতে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ওই সময় চোখে আতশী কাচ লাগিয়ে ছোট জিনিসকে দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসার জন্য চোখে চশমা ব্যবহার করার নজির রয়েছে ইতিহাসে। ১২৮৬ সালের দিকে ইতালিতে প্রথম চশমা তৈরি হয়েছিল। জিওর্দানো দ্য পিসা নামের এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চশমা তৈরি করেছিলেন। দ্য পিসার তৈরি চশমার উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার প্রতিকার।

আধুনিক চশমার উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে গিরোলামো সাভোনারোলা নামের এক ইতালীয়কে। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেন। তার আগে দুই চোখের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা এড়াতে চোখের সামনে কাচ ধরা হতো। সাভেনারোলার নকশাটিকে স্থির রেখে এরপর চশমার নকশা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এটি পায় আধুনিক রূপ।

লেখক- শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি