ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

আমার বঙ্গবন্ধু ও মুজিববর্ষ

ড. মুহাম্মদ সামাদ

প্রকাশিত : ০০:১৪, ১ ডিসেম্বর ২০২১

তখন ষাটের দশকের মাঝামাঝি। সরিষাবাড়ী রানী দিনমনি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আর জেলের তালা ভাঙবো/শেখ মুজিবকে আনবো এই স্লোগানগুলো আমাদের কচিকণ্ঠে তুলে নিয়েছিলাম। 

ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে পূর্ববাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সর্বস্তরের মানুষ স্লোগান তুলেছিল- আমার নেতা তোমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব/জেলের তালা ভাঙবো/শেখ মুজিবকে আনবো। আমাদের স্কুলের বড় ভাইয়েরা বাঁশের কঞ্চি বা গাছের চিকন ডাল হাতে এসে আমাদের ক্লাস থেকে তাড়িয়ে বের করে মিছিলে নিয়ে যেত। মিছিল শিমলাবাজার ঘুরে আবার স্কুলে ফিরে এসে শেষ হতো। সে সময়ের কাঁচা রাস্তার ধুলোর সমুদ্রে মিছিল করে আমাদের বই-খাতা-পোশাক আর মাথার চুল সাদা হয়ে যেত। আমাদের শিক্ষকদেরও মনে মনে সমর্থন ছিল শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে। ফলে, আর ক্লাস করতে হতো না বলে আমরা খুশি মনে বাড়ি ফিরতাম। আগে-ভাগে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দ আমাদের মিছিলে যাবার বাড়তি উৎসাহ যোগাত। আমার পরম সৌভাগ্য যে, তৎকালীন পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষের প্রিয়নেতা শেখ সাহেবকে ১৯৭০ সালে আর ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালে দেখার সুযোগ হয়েছিল।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। সত্তর সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি একদিন বিদ্যুৎগতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল আগামীকাল ফাইভ-আপ ট্রেনে শেখ সাহেব সরিষাবাড়ী আসছেন এবং জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে জনসভায় ভাষণ দেবেন। ফাইভ-আপ ট্রেনটি ময়মনসিংহ জংশনে ঢাকা-চট্টগ্রামের বগি সংযুক্ত করে লম্বা হয়ে অজগরের মতো হেলেদুলে ছুটে আসতো আমাদের স্টেশনে। রেল স্টেশনের ওপর দিয়ে আমরা স্কুলে যেতাম। শীতের সকাল। আমি ক্লাস এইটের ছাত্র। বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম। ট্রেন এসে থামলো সরিষাবাড়ী স্টেশনে। রেল স্টেশনে গিজগিজ করছে মানুষ। কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। “জেলের তালা ভেঙেছি/শেখ মুজিবকে এনেছি” স্লোগানে স্লোগানে স্টেশন চত্বর আর আশপাশ মুখরিত। প্রিয়নেতা শেখ সাহেব রেলগাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে হাত তুলতেই মানুষের সে কী উল্লাস! “জেলের তালা ভেঙেছি/শেখ মুজিবকে এনেছি” উচ্ছ্বসিত জনতার হাজারো কণ্ঠে শেখ মুজিবের জয়ধ্বনি! না দেখলে সে দৃশ্য কল্পনা করাও অসাধ্য। তারপর ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে হ্যান্ডমাইকে বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। 

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সদ্য কারামুক্ত রোগা-শ্যামলা-ক্লান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সেই আমার প্রথম দেখা! সারা বাংলার মানুষ যাঁকে এক নামে চেনেদ যাঁর মুক্তির জন্যে আমরা মিছিল করেছি, স্লোগানে স্লোগানে কচিকণ্ঠে রাজপথ মুখরিত করেছি; সেই স্বপ্নের শেখ মুজিবকে আমাদের রেল স্টেশনে এভাবে দেখবো ভাবতেও পারিনি। এই তো বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ সাহেব-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! আবেগাপ্লুত ও স্তম্ভিত হয়ে প্লাটফরমে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ ঢং-ঢং করে ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা বাজলো। আমাদের চেনা-অচেনা সবাই হুড়মুড় করে জগন্নাথগঞ্জমুখী ট্রেনে উঠে পড়ছিলো। আমিও সবার দেখাদেখি সেদিন বই-খাতা নিয়েই ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা ছিলো না। রেললাইনের দুই পাশেও শত-সহস্র মানুষ হাত নেড়ে স্লোগান দিয়ে তাঁদের প্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। ধীর গতির ট্রেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে পৌঁছলাম।

জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যমুনা নদীর তীরে অনেক উঁচু ও বড় মঞ্চ করা হয়েছিল। এখানে মঞ্চে এসে বঙ্গবন্ধু দুহাত তুলে শুভেচ্ছা জানালেন জনতাকে। অসংখ্য ফুলের মালায় তাঁকে বরণ করে নেয়া হলো। গোলাপ আর গাঁদা ফুলের লাল-হলুদ পাঁপড়িতে ভরে গেলো তার শালপ্রাংশু ঋজু-দীর্ঘ-কান্তিমান দেহ। জগন্নাথগঞ্জ ঘাট লোকে লোকারণ্য। কে নেই এখানে? মাথায় গামছাবাঁধা কৃষক, মাঠের রাখাল, লালশার্টপরা ঘাটের কুলি, বই-খাতা বুকে চেপে স্কুলের অবোধ বালক-বালিকা, নৌকার মাঝি, ছাত্র-যুবক, শিক্ষক-কর্মচারী, ঘোমটা মাথায় গৃহবধূ-মা-বোন সবাই এসেছে এখানে; সবাই হাজির। সকলের উত্তেজিত বাহুতে ও ঘর্মাক্ত মুখে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো স্লোগান: জেলের তালা ভেঙেছি/শেখ মুজিবকে এনেছি/আমার নেতা তোমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব। মুহুর্মূহু করতালি আর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে মাইকে বক্তৃতা করলেন। ভোরের কুয়াশা ভেঙে জেগে ওঠা যমুনার তীর জুড়ে মানুষ আর মানুষ; প্রবল বন্যার মতোন সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিলো। তারপর, স্লোগানে মুখরিত জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে, মুগ্ধ হয়ে দুপুরের দিকে সদলবলে স্টিমারে চড়লেন সকলের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব। যমুনার অথৈ জল তাঁকে পরম আদরে বুকে তুলে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। 

বলা দরকার যে, সরিষাবাড়ী রেল স্টেশনে এবং জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণ যেমন মানুষের ভিড়ে পেছন থেকে ভালো করে শুনতে পাইনি, তেমনি আমার মতো এক গাঁয়ের কিশোরের পক্ষে রাজনীতির ভাষা বোঝাও ছিল কষ্ট-কঠিন। কারণ, সব মানুষের লক্ষ্য ছিল তাদের প্রিয়নেতা শেখ সাহেবকে এক নজর দেখা। টিকিটের বালাই নেই। পকেটে কোন পয়সা ছিল না। পরে সারাদিন না খেয়ে ক্লান্ত দেহে বিকেলের ট্রেনে বাড়ি ফিরে আসি। আমার মা-বাবা ধরেই নিয়েছিল যে, আমি নিশ্চয়ই সকলের সঙ্গে জগন্নাথগঞ্জে চলে গেছি। মনে আছে, মা দুশ্চিন্তা করলেও আমার আওয়ামী লীগার বাবার চোখে-মুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখার অভিযানে তার শীর্ণকায় রোগা ছেলের ওপর বরং তিনি খুশিই হয়েছিলেন। বাড়ি এসে জানলাম- বাবাও সরিষাবাড়ী স্টেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসা দেখে সেদিন থেকে আমার মধ্যেও তৈরি হয় মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ!

অতপর, সত্তরের নির্বাচনে বিশাল বিজয়, ৭ মার্চের রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’; ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা; সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ; ১৬ই ডিসেম্বর রক্তমূল্যে অর্জিত প্রিয় স্বাধীনতা; ১০ জানুয়ারি বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

তারপর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার দেখি ১৯৭৩ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনে। তখন আমি কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং সরিষাবাড়ী থানা ছাত্রলীগের গ্রন্থণা ও প্রকাশনা সম্পাদক। যা হোক, সম্মেলনের আগের দিন এসে ঢাকা কলেজের দক্ষিণ হোস্টেলে উঠলাম। আমাদের স্কুলের এক সময়ের উপরের ক্লাসের ছাত্রলীগ নেতা বাদল ভাই এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন (বাদল ভাই ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার হয়ে প্রয়াত হয়েছেন)। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ঢাকা কলেজের উল্টোদিকে ‘অন্তরঙ্গ’ হোটেলে নাস্তা করে আমরা মিছিল করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলাম। এত বড় প্যান্ডেল আর মঞ্চ জীবনে এই প্রথম দেখলাম। ছাত্রলীগের সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধু। সবুজ ঘাসে আবৃত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তখন অনেক চারাগাছ বাতাসে দুলছিলো। চতুর্দিক থেকে ছাত্রলীগের মিছিল এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভরে দিচ্ছিলো। 

বেলা সাড়ে এগারটা-কি-বারোটা নাগাদ বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসে মঞ্চে উঠলেন। সমস্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রকম্পিত করে আমরা স্লোগান তুললাম- তোমার নেতা আামার নেতা/ শেখ মুজিব শেখ মুজিব/এক নেতা এক দেশ/বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। মঞ্চে বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার অন্যতম পথিকৃত সাদা ফুলশার্ট আর পায়জামা পরা লেখক-সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন। আমার মনে আছে বিকেলে তিনি ‘আবহমান বাংলার সংস্কৃতি’ শীর্ষক বক্তৃতা করেছিলেন। প্রসঙ্গত ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ভারতে চলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। জনান্তিকে বলি- ১৯৯২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি জীবনানন্দ সভাগৃহে ভাষা শহীদ দিবসের আলোচনা সভায় অন্নদা শংকর রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও রণেশদার সঙ্গে আমার বক্তৃতা দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।

যা হোক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে আমাদের স্কুলের আরেক বড়ভাই আউয়াল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো (পরে নিউইর্য়ক প্রবাসী ও প্রয়াত)। তাঁর পরনে বেল্টবটম নামক বেঢপ প্যান্ট দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি আমাদের ফুচকা খাইয়েছিলেন। জীবনে ফুচকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম! ছোটো থেকেই লেখাপড়া ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে আউয়াল ভাইয়ের আগ্রহ ছিল প্রবল। দেখলাম অনেক নেতার সাথে তাঁর পরিচয়। আউয়াল ভাই তাঁর পরিচিত ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো কারো সঙ্গে আমাদের হ্যান্ডশেক করিয়ে দিচ্ছিলেন আর মঞ্চের পাশ থেকে বড় বড় নেতাদের চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। সেদিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে প্রথম দেখলাম ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেই সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস। তখন ছাত্রদের মধ্যে ঘরে-বাইরে, গাছতলায়-ট্রেনের কামরায় তাস খেলার খুব প্রচলন ছিলো। সেদিনের ভাষণে জাতির জনক দুই হাতে তাস ভাঁজ করে ছড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে মজা করে ছাত্রদের এই বদ অভ্যাস ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন; সারাদেশের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পড়াশোনার অবসরে বাবা-মা’র কাজে সাহায্য করা ও দেশের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন আমার মনে পড়েছিলো কবিতার পঙ্ক্তি: তাস খেলে কত ছেলে পড়া নষ্ট করে/পরীক্ষা আসিলে তাদের চোখে জল পড়ে। সেদিনের সেই ভাষণের ছবি আমার চোখে ও হৃদয়ে সদা চলমান। আমি জীবনে আর তাস খেলা শিখিনি। জাতির পিতার সেই অতুলনীয় ভঙ্গিমায় প্রদত্ত নির্দেশ পালন করেই অজপাড়াগাঁ থেকে হয়তো আজ আমি এখানে! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিয়ে চলে যাবার সময় বঙ্গবন্ধুকে আরেক নজর দেখার জন্যে দৌড়ে তাঁর গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াই আমরা। তিন বছর পূর্বে রেলগাড়ির দরোজায় দেখা রোগা-শ্যামলা-ক্লান্ত বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের‘৭ই মার্চের রেসকোর্স’ এ আজ খুব আনন্দিত ও উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। ভিড়ের মধ্যে হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু তাঁর কাঁচখোলা গাড়ির দরোজা নিজ হাতে টেনে বন্ধ করে চলে গেলেন। জাতির পিতার সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ আজও আমাকে আপ্লুত করে; আমাকে অশ্রুসজল করে! 

উনিশশ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিকেলে সুন্দরবন এক্সপেসে আমাদের ঢাকা যাবার কথা ছিলো। প্যান্ট-শার্ট ইস্ত্রি করানোর জন্যে সকালে বাজারে যাচ্ছিলাম। তখন কয়লার ইস্ত্রিতে দুই আনায় একটা শার্ট বা প্যান্ট ইস্ত্রি করা যেতো। একটু দূর থেকে দেখলাম রাস্তার তেমাথায় জটলার মধ্যে একজন লোক একটা রেডিও হাতে বসা আর সবাই খবর শুনছে। পরিচিত একজন দৌড়ে এসে খবর দিলো শেখ সাহেবকে মেরে ফেলা  হয়েছে। হতবিহ্বল ও স্তব্দ হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। অনেকক্ষণ উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। একটু পরে রেডিওর কাছে এগিয়ে গেলাম। রেডিও থেকে খুনী মেজর ডালিমের কণ্ঠে বাঙালির হাজার বছরের আদরের ধন; অমৃতের সন্তান বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে অসাড় দেহে বাড়ি ফিরে গেলাম। অতপর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কর্মী এবং একজন কবি-সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন ও আংশিক রায় কার্যকর করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সকৃতজ্ঞ অভিবাদন জানাই।

ভেবে আরও অবাক হই- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ-মুজিববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে যুক্ত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেদিনের সেই স্কুল বালককে চিরকৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ ও প্রণত করেছেন। এখানেও একটি ঘটনা আমার জীবনে আনন্দস্মৃতি হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর ‘মাতৃসমা’ কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সযত্ন তত্ত্বাবধানে এবং বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপিত হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী-মুজিববর্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই বছরের ২০ মার্চ ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রথম সভায় মুজিববর্ষের কার্যক্রম প্রণয়নে অসংখ্য প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়। সভায় একশ বছরের ইতিহাসে যে ছাত্রের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ গর্বিত বোধ করে, সেই ছাত্র বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মরণোত্তর সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের একটি প্রস্তাব করার সৌভাগ্য আমার হয়। পরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিষদের সভায় প্রস্তাবটি আামি উত্থাপন করি এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। মুজিববর্ষে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতির পিতাকে মরণোত্তর সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবান্বিত হয়।

আমি দেশের বিরল সৌভাগ্যবান কবিদের একজন যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উনিশশ তিরাশির মার্চে রচিত আমার মুজিব কবিতার একটি পঙক্তি ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ হয়েছে; পোস্টারে মুদ্রিত হয়েছে। প্রায় চার দশক জুড়ে মুজিবভক্তদের মুখে মুখে এই পঙক্তিটি উচ্চারিত হয়েছে; কবিতাটিতে সুরারোপ করে প্রথমে চয়ন ইসলাম; পরে, বিশেষ করে ফকির আলমগীর মুজিব সঙ্গীত হিসেবে সারা দুনিয়ায় বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছেন। মুজিববর্ষে এই পঙক্তিটিকে চৌত্রিশতম জাতীয় কবিতা উৎসব ২০২০-এর মর্মবাণী এবং কবিতাটিকে উৎসব সঙ্গীত করা হয়েছে। 

প্রসঙ্গত আমি আরও গর্বিত যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ থেকে প্রকাশিত পোস্টারেও খচিত হয়েছে তাঁকে নিয়ে রচিত আমার “তুমি ভূমিকন্যা” কবিতার দুই পঙক্তি: “অগ্নিস্নানে শুচি হয়ে বারবার আসো/তুমি ভূমিকন্যা- তুমি প্রিয় মাতৃভূমি’। এইই তো জাতির পিতার যোগ্য পরম্পরা; এইই তো আমার মুজিববর্ষ।

লেখক: প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ

এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি