ইরানের চোখে ইসরায়েল যেভাবে `জালিম রাষ্ট্র`
প্রকাশিত : ১৯:৫০, ১৫ জুন ২০২৫ | আপডেট: ২০:১২, ১৫ জুন ২০২৫

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম উত্তপ্ত দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক। এই দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা এখন যেমন তীব্র, তা সবসময় ছিল না। ১৯৭৯ সালের ইরানি ইসলামি বিপ্লবের আগে পর্যন্ত ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব আজ রূপ নিয়েছে ভয়াবহ শত্রুতায়।
বন্ধুত্ব থেকে বৈরিতা
ইসরায়েল রাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, একে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া মুসলিম দেশের নাম ইরান। তৎকালীন ইরান (পহলভি শাসনামলে) ইসরায়েলের কৃষি প্রশিক্ষণ, সেনা গঠন, প্রযুক্তি সহায়তা গ্রহণ করত। বিনিময়ে তেহরান জ্বালানি সরবরাহ করত তেলআবিবকে। ইসরায়েলি প্রযুক্তিবিদরা পর্যন্ত তেহরানে কাজ করতেন।
১৯৭৯: সম্পর্কের মোড় ঘোরা
ইরানে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব ঘটে। রাজতন্ত্র উৎখাত করে ক্ষমতায় আসা খোমেনি ইসরায়েলকে ‘জালিম ও অবৈধ রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেন। ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদারিত্বের জন্য ইসরায়েলকে আক্রমণাত্মক ভাষায় নিন্দা করেন এবং সব ধরনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাতিল করেন।
এরপর থেকেই ইরান নিজেকে ফিলিস্তিন ইস্যুর প্রধান রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করতে থাকে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল যখন লেবাননে অভিযান চালায়, তখন ইরান লেবাননে শিয়া মিলিশিয়া হিজবুল্লাহ গঠনে সহায়তা করে। এখন সেই হিজবুল্লাহ ইরানের প্রভাববাহী ‘প্রক্সি ফোর্স’ হিসেবে পরিচিত।
সমকালীন বাস্তবতা ও মতপার্থক্য
বর্তমানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান আরও কঠোরভাবে অনুসরণ করেন। সরকারিভাবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয় এবং অনেক সময় সরাসরি হুমকিও দেওয়া হয়। তবে, দেশের ভেতরে এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফসানজানির মেয়ে ফায়েজেহ হাশেমি রাফসানজানি ২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘ইরানের উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা, কারণ এই অবস্থান সময়োপযোগী নয়।’
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক সাদেগ জিবাকালম বলেন, ‘এই অবস্থান ইরানকে আন্তর্জাতিক সমাজে একঘরে করে দিচ্ছে।’
ভবিষ্যৎ কোথায়?
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের চেয়ে ইরানের বাস্তব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও বৈদেশিক কৌশলের ভারসাম্য রক্ষা। মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নে ইরান নিজেও জটিলতা ও চাপে রয়েছে।
বার্লিনভিত্তিক বিশ্লেষক আলি ফাথোল্লাহ-নেজাদ বলেন, ‘সরাসরি ইসরায়েলকে জবাব না দেওয়ার কারণে ইরানের প্রতি অনেকের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে, এমনকি এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্সের অভ্যন্তরেও।’
ইরানের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলা অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক অসন্তোষ দেশটির শাসকগোষ্ঠীকে চাপে রেখেছে। অন্যদিকে বৈদেশিক কৌশলে হিজবুল্লাহ, হামাসসহ একাধিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন বজায় রাখা ইরানের জন্য কৌশলগত হলেও অর্থনৈতিকভাবে তা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ইরানের জনগণের একটি অংশ প্রশ্ন তুলছে—দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা উপেক্ষা করে কতদিন আর পররাষ্ট্র নীতিকে কৌশলগত শত্রুতার ভিত্তিতে পরিচালনা করা সম্ভব?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতের ইরানের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে এই দ্বিধার সমাধান- একদিকে বিপ্লবী আদর্শ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার, অন্যদিকে আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কূটনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করা।
ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান রাজনৈতিকভাবে কার্যকর হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানকে এই সংঘাত ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এমন অবস্থায় দেশটির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে নেতৃত্বের বাস্তবমুখি চ্যালেঞ্জ গ্রহনের সিদ্ধান্ত ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ওপর।
তবে এই দ্বন্দ্বে ইসরায়েলও স্বস্তিতে নেই। ইরানের হিজবুল্লাহ, হামাস, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীসহ একাধিক অঞ্চলে ‘প্রক্সি শক্তি’ তৈরি করার ফলে ইসরায়েলের নিরাপত্তা হুমকি বহু গুণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গাজা, লেবানন ও সিরিয়া সীমান্তজুড়ে একযোগে বহু ফ্রন্টে সংঘাতের আশঙ্কা দেশটির সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উদ্বেগে রেখেছে। এছাড়া অভ্যন্তরেও বিচার সংস্কার ইস্যু, রাজনৈতিক বিভাজন এবং নেতানিয়াহুর বিতর্কিত নেতৃত্ব ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও ঐক্যকে দুর্বল করছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ফলে দ্বিপক্ষীয় এই সংঘাত ক্রমেই একটি বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে কোনো পক্ষই ‘পুরোপুরি জিতবে’ না, বরং উভয়ের ভেতরের দুর্বলতাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভবিষ্যতের জন্য ইরান ও ইসরায়েল—উভয়েরই দরকার নতুন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, কারণ সামরিক লড়াইয়ে নয়, কূটনৈতিক কৌশলেই টিকে থাকার লড়াইটা সবচেয়ে কঠিন হবে।
এসএস//
আরও পড়ুন