ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ঐতিহ্যবাহী ‘সাকরাইন’ উৎসবের আদি কথা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:২৩, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বয়ে চলছে আমাদের ঢাকা। সাকরাইন বা ঘুড়ি উৎসব তেমনই একটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব।

পঞ্জিকামতে বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন উদযাপন করা হয় পৌষসংক্রান্তি। বর্তমানে ‘পৌষসংক্রান্তি’ শুধু ‘সংক্রান্তি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আর পুরান ঢাকার মানুষ একে বলে ‘সাকরাইন’। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘সাকরাইন’ উৎসবে পৌষসংক্রান্তি ও মাঘ মাসের শুরুর দিনটিতে আগুন নিয়ে খেলা ও আতশবাজির মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম প্রহর। 

সেই হিসেবে ১৪ জানুয়ারি, শনিবার পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়াও চলবে নানা আয়োজন।

ছোট বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত হবে প্রতিটি বাড়ির ছাদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে আকাশে ঘুড়ির সংখ্যা ও উৎসবের মুখরতা। সাকরাইন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় পুরান ঢাকার নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের। সাকরাইন উপলক্ষে পুরান ঢাকার আকাশে শোভা পায় নানা রঙ আর বাহারি আকৃতির ঘুড়ি। এ ছাড়াও আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি ফোটানো এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে সকালের তুলনায় বিকেলে এ উৎসব বেশি মুখরিত হয়। সাকরাইন উৎসবকে পৌষসংক্রান্তি বা ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়। এ উৎসবে অংশ নেন সব ধর্ম, পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ।

সাকরাইনের আদি কথা
ঢাকায় পৌষসংক্রান্তির এ দিনকে বলা হয় সাকরাইন। ঢাকাই ভাষায় ‘হাকরাইন’। আদি ঢাকাই লোকদের পিঠাপুলি খাবার উপলক্ষ আর সাথে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতার দিন। সাকরাইন একান্তই ঢাকার, যুগের পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব উৎসব। এটা বাংলাদেশের কোথাও পালিত হয় না। যা ঢাকার জনপ্রিয় ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল।

সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্রাণ থেকে এসেছে। আভিধানিক অর্থ : বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন। এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। এই উৎসবের দুটো দিক আছে। একটি ধর্মীয় অপরটি সাংস্কৃতিক।

সংক্রান্তির এই উদযাপন কবে থেকে চলে আসছে তা সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। হতে পারে হাজার বা তারও আগের পুরনো এ মকর সংক্রান্তির মহাতিথি।

মকর সংক্রান্তি বা পৌষ মাসের শেষ দিন হিন্দু জমিদারেরা তাদের জমিদারিতে ব্রাহ্মণ ও প্রজাদের আতিথেয়তা দেন। উন্মুক্ত মাঠে ভোজ উৎসব হয়। বিতরণ করা হয় চাল, গুড়, তেলের তৈরি পিঠা ও ডাবের পানি। এটি বাস্তু পূজা নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে বিক্রমপুরে কুস্তি, লম্বদান ইত্যাদি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এই হলো সংক্রান্তির ধর্মীয় দিক।

সাকরাইন ঢাকার বিশেষ ঘুড়ি উৎসব। আদিকাল থেকেই এ শহরের মানুষ ঘুড়িবাজ হিসেবে পরিচিত। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। এখানে ঘুড়ি উড়ানোর পেশাদারিত্ব কারুকাজ ও কলাকৌশলে অবাক হয়ে ঐতিহাসিকেরাও এর মুগ্ধতা প্রকাশ করে গেছেন। ঢাকায় ঘুড়ির আগমনের ইতিহাস জানতে আপনাকে যেতে হবে বেশি দূরে নয় ভারতের নবাবি শহর লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত। জানেন কি? লক্ষ্ণৌ মোগল ও নবাবী খানাপিনা ছাড়াও আর কী দুটোর জিনিসের জন্য বিখ্যাত ছিল? একটি সুর-সঙ্গীত আরেকটি ঘুড়ি। ঢাকার নায়েব নাজিম ও নবাবেরা ছিলেন এই কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক। একসময় স্থানীয় নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় লক্ষ্ণৌর আকাশ রঙবেরঙের ঘুড়ি আর আতশবাজির আলোকসজ্জায় পূর্ণ থাকত। ধনীরা স্বর্ণ ও রুপার ঝালর ও কারচুপি খচিত নাটাই এবং ঘুড়ি উড়াতেন। এ উৎসবকে পাতাংবাজি বলা হতো। নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর সময় এই নামে দেখা যায়। আর ঘুড়ি উড়ানো উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নবাব আসাফউদ্দৌলার সময় থেকে। হিন্দু শাসিত শহরে তারা পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সব সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন, যা সর্বজনীন ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু মুসলিম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। ঢাকার শেষ নবাব গাজিউদ্দিন, যিনি পাগলা নবাব নামে পরিচিত ছিলেন, তার ঘুড়ি উড়ানোর নেশা আর আহসান মঞ্জিলের নবাববাড়ীর ঘুড়িপ্রীতি শহরের সবার জানা। শীত মওসুমের তিন মাস ঢাকার লোকদের বার্ষিক ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। ছিল না নিদিষ্ট কোনো দিন। পৌষের শেষ দিনটাকেই তারা বেছে নিতেন ঘুড়ি উড়ানোর শেষ মওসুমি উপলক্ষ হিসেবে।

ঢাকার ঘুড়িবাজেরা নেমে পড়ত খোলা মাঠ ও মহল্লার ছাদগুলোতে। এই প্রতিযোগিতাকে বলা হতো হারিফি বা হারিফ। বিভিন্ন উপলক্ষেই তারা নামত হারিফ খেলায়। ঢাকার নবাবেরা ছিলেন এর মূল পৃষ্ঠপোষক। চকবাজার, শাহবাগ, পল্টন ময়দান (দিলকুশা), আরমানিটোলা মাঠসহ সব উন্মুক্ত স্থানেই চলত এই আয়োজন।

সাকরাইনে একটা ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হলেই ভোঁ-দৌড়। যে আগে পৌঁছাতে পারবে, ঘুড্ডিটা তার। একসময় পৌষের শেষে পুরান ঢাকার জামাইরা শ্বশুরবাড়ি এলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো ঘুড়ি ও নাটাই। সব বাড়ির জামাই ঘুড়ি উড়ালে ঘটা করে সেসব দেখতেন গ্রামবাসী। এমনটা এখন আর হয় না। কিন্তু উৎসবটা রয়ে গেছে। এবার পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে ঘুড়ি উড়ানো ছাড়াও ছিল নানা আয়োজন। খাওয়ার জন্য থাকে খিচুড়ি, গরুর গোশত। সন্ধ্যার পর শুরু হয় মুখে কেরোসিন-আগুনের খেলা, ফানুস উড়ানো।

কালের ধারাবহিকতায় উৎসবে অনুষঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনও প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই। শত বছরের নানা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত উত্তেজনার মাঝেও পৌষসংক্রান্তি এই শহরে হিন্দু মুসলিম সবার সর্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে আজো টিকে আছে।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি