ঢাকা, শনিবার   ০৪ মে ২০২৪

ওরা আসবে চুপি চুপি

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ১৬:২১, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২

সুহা, শাহান নানা বাড়ি এসেছে ডিসেম্বরের এক তারিখে। গত পনের দিন নানা-নানির সাথে ওদের সখ্যতা জমে উঠেছে। পরীক্ষা শেষে স্কুল বন্ধ। লেখাপড়ার চাপ নেই, মা-বাবার শাসন নেই। ওরা এখন নানা-নানির কমাণ্ডে। 

রাতের বেলায় লেপ-কম্বল গায়ে নানির মুখে গল্প শোনা, দিনের বেলায় নানার সাথে কখনো লালশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ধনিয়াপাতা তোলা, রান্নার জন্য নানিকে যোগান দেয়া দারুণ লাগছে। নানার সাথে গ্রামের আকাশ দেখে শীতল পাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে, কখনো মাঝ আকাশে চিল-শকুনের ধীরলয়ে ওড়া দেখে। ওদের ঘড়ি নেই, মা-বাবার তাড়া নেই, শুধু সূর্যালোর দিকে তাকিয়ে সময় মাপে। 

বিকেলে পাখ-পাখালির আকাশ পথে দলে দলে ঘরে ফেরা উপভোগ করে। বনবাদাড়ের পাখিগুলোর রঙ দেখে কাছাকাছি থেকে, এক ডাল থেকে অন্য ডালে ওদের এক্কা-দোক্কা খেলা উপভোগ করে। শালিক, শ্যামা, টুনটুনি, দোয়েলের নাচা-নাচি লেজ দোলানো গভীরভাবে দেখে। 

শাহান তো অবাক এতো পাখি ছাড়া পেল কী করে! ও ভেবেছিল এসব শহরের খাঁচার পাখি। নানুই বলেছেন, ‘এগুলো প্রকৃতির অলংকার।’ গাছের পাতায়, ঘাসে লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা-মাকড় ধরে মজা করে খায়। ওদের যেমন আনন্দ তেমনি সুহা, শাহানেরও আনন্দ।

নানা কখনো লাল শাকের খেতে নিড়ানি নিয়ে কখনো পাশের বাড়ির কালুকে নিয়ে পুবের আড়ায় গাছ লাগানো, গাছের গোড়ার সার, পানি সেচ দেয়ায় ব্যস্ত।

‘নানা ব্যস্ত বাইরে, নানি ব্যস্ত ঘরে। সুহা ব্যস্ত, শাহান ব্যস্ত, অন্দরে বাহিরে।’

সুহা ছড়া বানিয়ে আম্মুকে শোনায়, আম্মু বলেন লিখে রাখ খাতায়।

আম্মু বলেছেন প্রতিদিনের দিনলিপি লিখতে। ও ক্লাস সিক্সে উঠবে। শাহান ক’দিন পরে স্কুলে ভর্তি হবে, তার মধ্যে একটা ছাত্র ছাত্র ভাব। আম্মু স্কুল ড্রেস কিনে দিয়েছেন, সাথে স্কুলব্যাগ। ও এসব পরে নানার সাথে এদিক সেদিক যায়। নানা কখনো যায় সুপারি বাগানে, কখনো নারকেল গাছ তলায়। কালু ডাব পাড়ে, ওরা গাছতলে বসে ডাব খায় মজা করে।

বিকেলে খিলপাড়া হাটে নানা শাহানকে নিয়ে লাল-নীল কাগজ, বেলুন, সুতা, কাগজের পতাকা কিনে আনেন। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের ডাকে কালু। নানা তাদের সাথে পরামর্শ করেন কাল ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস। তোমরা বিকেলেই কাগজ কেটে পতাকা বানিয়ে বাড়ির পুবের আড়া থেকে কাচারি পর্যন্ত রশিতে টানিয়ে দিবে। গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিবে কাগজের পতাকা। রাতের জন্য নানা বাজি পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। বাড়িময় উৎসব উৎসব ভাব। সুহার আম্মু কাঁচি নিয়ে কাগজ ত্রিকোণাকৃতি করে কেটে দেন, ওরা গ্লু মেরে সুতোয় গেঁথে দেয়।

নানা দশটি মুরগি এনেছেন, চিকেন-খিচুড়ি হবে বাড়ির সব বাচ্চাদের জন্য। নানা বলেছেন, ‘এবারই প্রথম আমরা নানা-নাতি বিজয় দিবস উদযাপন করবো গ্রামের বাড়িতে। তোমরা সবাই মিলে আনন্দ কর।’

‘কথা হলো’, রাত ১২টা ০১ মিনিটে পতাকা তোলা হবে কাচারির সামনে; সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গাইবে। তারপর আনন্দ মিছিল হবে। তারপর কলাপাতায় খিচুড়ি ভক্ষণ।’

বাড়িতে আসার পর থেকে সুহা-শাহানের দারুণ পরিবর্তন দেখে ওর আম্মু-আব্বু খুব খুশি। ওর আম্মু-আব্বুর মোবাইল টানাটানি করে না, টিভিতে কার্টুন দেখে না। তাদের আম্মুও জি-চ্যানেলের ধারে কাছে যায় না।

এরই মধ্যে সুহা-শাহান ঠাণ্ডা পানি জয় করে ফেলেছে। বাড়ির ছোটদের সাথে সাঁতার শিখে ফেলেছে। নানা কলাগাছ কেটে ভাসিয়ে দিয়েছেন কলাগাছ ধরে ধরে সাঁতার শেখার জন্য। ওগুলো মাঝ পুকুরে ভাসলেও সুহা সাঁতরে কিনারে আনতে পারে।  শাহান মাঝ পুকুরে সাঁতরে যেতে না পারলেও অনেক দূর গিয়ে ফিরে আসতে পারে।

সমস্ত আয়োজন শেষ, নানুর খিচুড়ি রান্নাও শেষ। কালু, ফরিদুল, রাহি, রাহাত, জাহিদ ওরা কলাপাতা কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে ভাঁজে ভাঁজে রেখেছে। খিচুড়ি রান্নার ঘ্রাণ বাতাসে ভাসছে। বাড়ির ছোটরা চুপি চুপি রান্না ঘরের কাছাকাছি এসে ঘ্রাণ টেনে সুখ পাচ্ছে।

রাত দশটা। নানা, নানু, শাহান, সুহা, সুহার আব্বু-আম্মু ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষায় রাত বারোটার। সুহা নানার কাছাকাছি এসে নানাকে আবদার করে, ‘নানা তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা, আজ শোনাবে তোমার যুদ্ধের গল্পকথা।’

নানা একটু থমকে যান। তার কপালের রেখাগুলো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। নিজের মস্তিষ্কের ফিতাগুলোকে যেন রিভিউ করে কিছুক্ষণ পর নানা ফিরে আসেন।

‘শুনবে, মুক্তিযুদ্ধের কথা? আমাদের অভিযানের কথা!’

শাহান-সুহা লাফিয়ে ওঠে- ‘নানা, নানা বলোনা প্লিজ।’

নানা আস্তে করে বলেন, ‘আসলে এসব তোমাদের জানা দরকার। কিভাবে, কাদের ত্যাগী ভূমিকার জন্য তোমরা একটা স্বাধীন দেশে জন্মেছ, তোমাদের দায়িত্ব কি? এসব জানতে হবে।’

‘ডিসেম্বরের এক তারিখ, সন-১৯৭১।’

‘গল্প নয়, সত্যি গল্প।’ নানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর হলেন। আবার চুপ। নানুর পান চিবানো বন্ধ। সুহার আব্বু একটা বইয়ের পাতায় ভাঁজ দিয়ে সামনে রাখলেন। সুহার আম্মু একটা পাতলা কাঁথায় শরীর মুড়িয়ে সোফায় পা তুলে বসলেন।

নানা দম ধরে রইলেন চোখ বুঁজে। হঠাৎ তিনি ঝট করে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘জানালাগুলো খুলে দাও।’
সুহা কু্যঁ ক্যাঁ করে উঠে, ‘নানা বাইরে ভীষণ শীত তো!’

‘তা তো হবেই, এ শীতেই আমরা শুধু গেঞ্জি গায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাসের উপর ‘এইম’ নিয়ে শুয়েছিলাম।’ সুহার আম্মু জানালাগুলো খুলে দিতেই হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকে। তখুনি এক কিলোমিটার দূরে খিলপাড়া বাজার হতে মাইকে গানের সুর ভেসে আসে-

‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না-

ওরা আসবে চুপি চুপি...’

গানটা থেমে যায়। নানা হু হু করে কেঁদে ওঠেন। সবাই চুপ, সময় গড়িয়ে যায়। নিস্তব্ধতার ছায়া ছিটিয়ে আছে সর্বত্র।

নানা শুরু করলেন, ‘বৃহত্তর নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ ছিল আর্মিদের ক্যাম্প। সেখান থেকেই ওরা খিলপাড়া, কড়িহাটি, বাংলাবাজার, মল্লিকা দিঘিরপাড় অপারেশনে যেত। আমরা ছিলাম গেরিলা যুদ্ধের সৈনিক। ‘হিট এন্ড রান।’ মানে-মার এবং সরে পর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দশ-পনেরো জনের গ্রুপ আমাদের। আর পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় একশ সেনার ঘাঁটি চন্দ্রগঞ্জে, তাছাড়াও তাদের রাজাকার বাহিনী কখনো সশস্ত্র কখনো ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতো আমাদের খোঁজে। যার জন্য আমরা বেশিক্ষণ একজায়গায় থাকতে পারতাম না বা ক্যাম্প করে, তাঁবু টাঙ্গিয়ে প্রহরা বসিয়ে দু-চার দিন থাকার সুযোগ ছিল না।’

চন্দ্রগঞ্জ ওদের ছোট ক্যাম্পই বলা যায়। তবু ঐ ক্যাম্পটা ধ্বংস করাটা জরুরি হয়ে পড়ে যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে। আমরা পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধা এবার গোপনে একত্রিত হলাম। আমাদের কমান্ডার বিডিআর সুবেদার আলম ভাই। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আমরা মানসিক দিক থেকে অজেয়।’ 

নানা একটু দম নিয়ে বলেন, ‘আমাদের হাতে ডজনখানকে গ্রেনেড, পনেরটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, দশটি এসএলআর, পাঁচটি স্টেনগান আর তিনটি এলএমজি।’

‘ওরাতো আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে সব সময়ের জন্য প্রস্তুত। পাঁচটি বাঙ্কারে পাঁচটি মেশিনগান তাক করে রয়েছে আমাদের সামনে। মাঝ রাতে আমরা রেকি করে শুয়ে পজিশন নিয়ে নিলাম তাদের মেশিন গানের নলের সামনের মাঠে। সময় গড়ায়, আমরা ভোর রাতের অপেক্ষায়।’

‘রাতের সীমানা ধীরে ধীরে পার হচ্ছে, আমরাও মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি। হানাদারদের বাঙ্কারগুলো আমাদের ধ্বংস করতেই হবে। সময় বেশি পাওয়া যাবে না নিশ্চিত। ফজরের আজানের আগেই আমাদের অপারেশন শুরু করতে হবে।’

নানা কিছুটা উত্তেজিত। সুহা, শাহান অবাক হয়ে আছে, নানু চোখ মুদে আছেন। আব্বু-আম্মুও নিশ্চুপ। সুহার মনে হলো সেও যেন রাতের সেই অভিযানে অংশগ্রহণকারী। হু হু করে বাতাস কেটে যাচ্ছে কিন্তু সুহার শরীরে কাঁপুনী ধরাতে পারছে না।

নানা একটু দম নিয়ে বলেন, ‘কমান্ডারের ইশারায় আমরা একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছি। অমাবশ্যার রাত, গাঢ় আঁধারে দীর্ঘক্ষণ থাকায় নিজেদের অবস্থান ছায়ার মতো বুঝতে পারছি। আমাদের সামনে জীবন আর মৃত্যুর খেলা অপেক্ষমান। সামনে শত্রুর বাংকার। যে কোনো মুহ‚র্তের অসতর্কতা আমাদের জীবন ও জয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

আমার বন্ধু কালু আর আমি পাশাপাশি। আমার এসএলআর মাটিতে শোয়ানো। কুয়াশা ভেজা ঘাসের উপর শুয়ে আছি। গা ভিজে আছে অনেক্ষণ ধরে। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনছি মনে হলো। সে শব্দ ক্রমশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কুয়াশার ঘোর কাটিয়ে দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা দূর করা অসম্ভব। তারপরও মনে হলো দুটি ছায়ামূর্তি আমার আর কালুর দিকে এগিয়ে আসছে।’

কালু আর আমি ভয় পেয়ে যাই। আঁধারের ছায়ায় দেখছি একজন গ্রাম্যমহিলা, তার পেছনে একটা বাচ্চা মেয়ে। পাশে থাকা হাই তোলা মেয়েটিকে মহিলা পেছনে খোঁচা মেরে তাড়া দিচ্ছে। সূর্যওঠার আগেই মেয়েটির বাবা বা স্বামীর বাড়ি পৌঁছানোর তাগাদা যেন। আর কয়েক দম এগোলেই ওরা ঠিক আমাদের গায়ের ওপর এসে পড়বে। তারপর ভয়ে চিৎকার করবে।’

সুহা উঠে গিয়ে নানুর কাছ ঘেঁষে বসে, শাহানকে জড়িয়ে আছেন, নানা।

নানা চুপ হয়ে যান। তার কথা বলার মুড যেন কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে। অতীত খুঁজে পাচ্ছেন না যেন!

নানির তাড়া খেয়ে নানা মুখ খোলেন। আম্মু আঁচল মুখে চেপে আছেন। সুহা লক্ষ্য করে নানি চোখ মুদে থাকলেও চোখের কোণা দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে।

‘পর মুহ‚র্তে আমি আর কালু ঝট্ করে উঠে ওদের দু’জনের গলায়... ছুরি চালিয়ে...’

সুহা আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে। শাহান ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে থাকে।

‘হ্যাঁ সোনামণিরা! আলহামদুলিল্লাহ, সে যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। আমাদের সাথি দশজন মারা গেছে, দশজন প্রচণ্ডভাবে আহত হয়। ভোরের আলো ফুটে ওঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। চার পাশের হাজারও জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে।’

‘গ্রামবাসীর সাথে দীর্ঘক্ষণ আমাদের কোলাকুলি চলে। আমরা তো তখন বীর। বীরদের কে-না দেখতে চায়। গ্রামবাসীদের অনেকেই খাবারসহ এটা ওটা আমাদের জন্য নিয়ে আসে।’

‘নানা চুপ হয়ে যান। নানি আর আম্মু মাথায় আঁচল চেপে আস্তে উঠে রান্না ঘরের দিকে যান। সুহা তাগাদা দেয়-‘নানা, ওদের কি হলো বলোনা?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হঠাৎ ওদের কথা মনে পড়লো। দশ-বারো হাত দূরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ। ওদের চিৎ করতেই আঁতকে উঠি ও যে আমারই বিধবা বোন আলেয়া, আর তার মেয়ে মনি।’

হু হু করে নানা কেঁদে ওঠেন। সুহা, শাহান হাউ মাউ করে কেঁদে নানাকে জড়িয়ে ধরে।

এ সময় দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজার শব্দ শোনা যায়। বাইরে আতশবাজির শব্দে সবাই বেরিয়ে আসে। ওরা ছুটে যায় কাচারি ঘরের সামনে-নানার পরামর্শে ছেলে-মেয়েরা আলো জ্বালিয়ে দেয়।

‘আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালোবাসি...’ জাতীয় সঙ্গীতের সুরে সুরে আরেকটা বিজয় দিবসের সূচনা হলো।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি