ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

করোনা প্রতিরোধে মাস্ক কতটা উপকারী?

আজাদুল ইসলাম আদনান 

প্রকাশিত : ১২:৩৭, ১০ মার্চ ২০২০

চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে কাঁপছে বিশ্ব। ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় দ্রুত তা এক দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য অঞ্চলে। ভাইরাসটিতে এখন পর্যন্ত উৎপত্তিস্থল চীনসহ চার হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। 

সবশেষ এর প্রকোপ থেকে রেহাই পায়নি এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত এখানে ৩ জনের দেহে মরণব্যাধিটির সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আশঙ্কায় নতুন করে ভর্তি করা হয়েছে আরও ৩ জনকে। যারা সম্প্রতি ইতালি ও সিঙ্গাপুরফেরত বাংলাদেশি। 

আর আক্রান্তদের মধ্যে একজনের সংস্পর্শে আসা ৪০ জনকে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচতে নেয়া হয়েছে কোয়ারেন্টাইনে। যেখানে ১৪ দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে তাদের। 

গণমাধ্যমের কল্যাণে এসব তথ্য ছড়িয়ে যাওযায় রাজধানীজুড়ে পথেঘাটে, অফিস-আদালতে অনেকেই মাস্ক পরছেন। আবার মাস্ক ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে মতও দিচ্ছেন। 

ইতিমধ্যে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশ সামগ্রীর সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে ফার্মেসি ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য সামগ্রী পাওয়া গেলেও দাম নেয়া হচ্ছে কয়েকগুণ। 

করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকার ও বিশেষজ্ঞরা আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানালেও মানুষের মাঝে অজানা এক ভয় যেন ভর করছে। ফলে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচতে ছুটে যাচ্ছেন মাস্কসহ অন্যান্য সামগ্রীর দোকানে। 

বিশেষ করে মাস্কের দোকানগুলোতে ভির করছেন সবচেয়ে বেশি। আর এটাকে পুঁজি করেই আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সামান্য লাভের আশায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মাস্কসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন আকাশচুম্বি। এমনকি কোথাও কোথাও অতিরিক্ত দামেও মিলছে না এসব পণ্যের। 

তবে প্রশ্ন উঠেছে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কতটা উপকারী এসব ফেস মাস্ক। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ফেস মাস্ক পরলেই নিজেকে নিরাপদ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। পাতলা সার্জিক্যাল মাস্ক সাধারণত দূষণ, ধুলাবালি আটকাতে বেশি ব্যবহৃত হলেও তা পুরোপুরি আমাদের নিরাপত্তা দেয় না। তবে ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির মাস্ক পরা জরুরি। 

এর বাহিরে মাস্কের দুটি উপকার আছে: মাস্ক পরা থাকলে নাকে মুখে হাতের স্পর্শ কম হয় আর একেবারেই মুখে সামনে কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে মাস্ক কিছুটা নিরাপত্তা দেয়। 

তবে আমরা যে সাধারণ মাস্ক ব্যবহার করি তা ফাঁকফোকর গলে ভাইরাস বা বাতাসবাহিত ড্রপলেট সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এমনকি বেশির ভাগ মাস্ক মুখের ভেতর ঠিকমতো ফিটও হয় না। তাহলে এগুলো করোনার মত প্রাণঘাতি ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কতটা কার্যকরি ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।  

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বেসরকারি একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মাস্ক ঢালাওভাবে যেটা আমরা রাস্তাঘাটে ব্যবহার করছি এটার কিন্তু দরকার নেই। শুধু মাত্র যিনি আক্রান্ত উনি ব্যবহার করবেন। তবে একই মাস্ক একবার ব্যবহার করে ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ব্যবহারের পর এক জায়গায় রেখে দিয়ে আবার ব্যবহার করবেন এমন যেন না হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যে মাস্ক পরে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই এর কিন্তু দরকার নেই। এতে খামাখা খালি দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর একটা কথা হলো, কেউ আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দোকানে-দোকানে ভিড় করে একটার দাম ১০ গুণ বেড়ে যাচ্ছে, এটা কিন্তু পরিহার করাই ভালো।’

ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ‘অনেকের মধ্যে ভয় যে আক্রান্ত হলেই বুঝি মারা যাবে, আসলে কিন্তু তা না। এতে আক্রান্ত হলে মেজরিটি রোগী ভালো হয়ে যাবে। ঘরে বসে থাকলেও ভালো হয়ে যাবে, সাধারণ চিকিৎসায়ও ভালো হয়ে যাবে। ভয়ের কোনো কারণই নেই। সুতরাং আমি আবারও সবাইকে বলছি আপনারা ভীত হবেন না, আতঙ্কিত হবেন না। তবে সবাইকে সর্তক থাকতে হবে। এটা কিন্তু খুব জরুরি।’

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রশাসন সতর্ক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা হলো এটা যেহেতু ছোঁয়াচে ভাইরাস। এটা কিন্তু একটা এলাকাতে পাওয়া যাচ্ছে। এটি ফলোআপ করা হচ্ছে। প্রশাসন কিন্তু সর্তক। প্রয়োজনে যদি দরকার মনে করে তাহলে স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ রাখতে হবে কিছু দিনের জন্য। আশেপাশে যদি কোনো বাজার থাকে সেগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করা লাগতে পারে, প্রয়োজন হতে পারে। সে ব্যাপারে সতর্কতামূলকভাবে সবাই পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আমরা সবাই অবজার্ভ করছি, প্রয়োজনে বন্ধ করা লাগতে পারে। শুধু তাই না জনসমাগম, সভা-সমাবেশ এগুলো বন্ধের দরকার পড়তে পারে। আপাতত কিন্তু এখনো এত ব্যাপকহারে ছড়ায় নাই।’

এদিকে রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম মোড় ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে ফার্মেসি ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভির লক্ষ্য করা গেছে। 

কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে মাস্ক বিক্রি করছিলেন রকিবুল হাসান। যেখানে ১০ টাকার মাস্ক বিক্রি করছেন ৩০ টাকায়। আবার ৩০ টাকার মাস্ক কারো কাছ থেকে নিচ্ছেন একশ আবার কখনো ১২০ টাকা। 

জানতে চাইলে এ ক্ষুদে ব্যবসায়ী একুশে টিভি অনলাইনকে জানান, ‘প্রতিটি মাস্ক বেশি দামে কেনায় অতিরিক্ত দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে পুলিশি বাধায় বেশিক্ষণ বিক্রি করতে পারিনি। সাধারণত ৩০ টাকা দরের ৪শ মাস্ক ৫০ টাকা করে কিনেছিলাম কিন্তু বেশি দামে বিক্রি করায় প্রশাসন বাধা দিয়েছে। ভয়ে আর বিক্রি করিনি। উল্টো আমার ৪ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।’ 

ফার্মগেটে এক মাস্ক বিক্রেতা জানান, ‘করোনার কথা শুনে আড়ৎদাররাই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই আমাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে।’ কিন্তু যে মাস্কগুলো বিক্রি করছেন তা তো আপনার অনেক আগেই কেনা, যা কম দামে কিনেছেন। তারপরও বেশি দাম রাখার কারণ কি? এমন প্রশ্নের অবশ্য জবাব দিতে পারেননি এ অসাধু ব্যবসায়ী।

শুধু ফুটপাতের দোকানগুলোই নয় ফার্মেসিগুলোতেও একই অবস্থা। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড ওয়াশ সামগ্রী থেকেও বেশি দামের আশায় বিক্রি করছেন না অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। 

এদিকে রাজধানীসহ গতকাল সোমবার সিলেট ও ময়মনসিংহে অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার ও জেলা প্রশাসন। অতি মুনাফা ও পণ্যের রশিদ সংরক্ষণ না করায় ময়মনসিংহের দূর্গাবাড়ি এলাকায় দুটি ফার্মেসিকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাহিদুর রহমান।

অপরদিকে, ১০ টাকার মাস্ক ২০০ টাকায় বিক্রির দায়ে সিলেট নগরের জিন্দাবাজারস্থ ইদ্রিছ মার্কেটে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদফতর। এ সময় আদিল সায়েন্টিফিক স্টোর নামে একটি দোকানকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও দোকান মালিককে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

মূলত করোনা রোগী সনাক্ত হবার পরপরই বাজারে, মাস্ক ও স্যানিটাইজার সংকট চলছে। একেক জন বেশি বেশি কেনায়, অন্যান্যদের পরতে হচ্ছে বিপদে। যদিও কেউ যাতে সিন্ডিকেট করে এসব অত্যবশ্যকীয় উপকরণের বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, সে জন্যে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। কিন্তু, সাধারণ মানুষ এর অতিরিক্ত সতর্কতায় এসব পণ্যের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। 

এ ব্যাপারে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরও বলে আসছে, ‘নোবেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শিকার রোগীর, চিকিৎসা ও সেবার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা ব্যতীত অন্যদের আপাতত মাস্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। 

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ‘করোনা ভাইরাসের মত সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এই মাস্ক তেমন একটি আপনাকে সুরক্ষা দিবে না। এর থেকে রেহাই পেতে বারবার হাত ধোয়া, নাক-মুখে হাতের স্পর্শ না লাগানো আর যেকোনো ফ্লু আক্রান্ত রোগী থেকে অন্তত ৬ ফুট দূরে অবস্থা করা জরুরি। 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি