ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কুখ্যাত দুদু রাজাকারের মৃত্যু ও দেশের প্রথম গণ-আদালত

বিকুল চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ১৪:২২, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বছরে মৌলভীবাজার জেলা হানাদার মুক্ত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে একটা ঐতিহাসিক মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হওয়া গণ-আদালত হয় মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায়।

গণ-আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় রাজাকার শিরোমণি দুদু মিয়ার। আর এই রায়ের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী বিভিন্ন গণ-আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণ-আদালতের রায় ঘোষণা, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন প্রভৃতি। যেগুলোতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। 

প্রয়োজনে স্বাধীনতার সুফল রক্ষায় বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লড়াইয়ে ভবিষ্যতেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তির আধার হবে ঐতিহাসিক এ রায়, এমনটাই অভিমত স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।

রাজনগরের গণআদালত ও রায়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও এ নিয়ে তেমন আলোচনা বা বিশ্লেষণ জনসম্মুখে প্রকাশ পায়নি। ফলে নতুন প্রজন্মের নিকট আজও অজানা রয়ে গেছে দেশের অন্যতম একটি গণআদালতের রায়ের ইতিহাস। সেই রায় ঘোষণার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, আজও বেঁচে আছেন এই রায়ে অংশ নেয়া অনেক গুণীজন। 

সম্প্রতি এই রায়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ করলে উঠে আসে কালের বিবর্তনে চাপা পড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক সমুজ্জ্বল ইতিহাস।  

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর (তারিখ নিয়ে কারো কারো মতান্তর রয়েছে) গণ-আদালতে দুদুর মৃত্যুদণ্ডের ঐতিহাসিক এ জনরায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ঘোষিত হয় রাজনগর উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের মুন্সিবাজারের দক্ষিণ পাশে (বর্তমান খলাগাঁও করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও খলাগাও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে)। 

যে কারণে দুদু আসামি:
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে মুন্সিবাজার ও খলাগ্রাম এলাকায় বহু মানুষকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে পাকবাহিনী। আর তাদের সাহায্য করে স্থানীয় কিছু চিহ্নিত রাজাকার। মুন্সিবাজার এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বারিক মিয়ার অন্যতম সহযোগী ছিলো দুদু রাজাকার। 

৯ মাস প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডব চালিয়ে দুদু রাজাকার মুন্সিবাজারের বনেদী হিন্দু পরিবার যা বর্তমানে ‘ধরের বাড়ি’ নামে পরিচিত, (সে সময় রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ি বলে পরিচিত ছিলো) সে বাড়িতে গণহত্যা চালায়। খলাগ্রামের বহু মানুষকে ধরে তুলে দেয় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে। 

পাক হানাদারবাহিনীর এদেশীয় দোসররা মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে যায়, স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে আর সন্তানের সামনে থেকে বাবাকে নিয়ে লোহাউনি পাহাড়, ধরের বাড়ি, লঙ্গুর পুল এবং মৌলভীবাজার চাঁদনী ঘাটের ব্রিজে লাইন ধরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে, শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি এ যুদ্ধাপরাধীর দল। নিজে ও পাক আর্মি দ্বারা বহু মা ও বোনকে ধর্ষণ- নির্যাতন করায়। যে ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এই দুদু রাজাকার।

বালিগাঁও যুদ্ধ ও দানুমিয়াকে হত্যা:
৭১’ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি ছিলো রাজনগরের বালিগাঁওয়ের শহীদ দানু মিয়ার বাড়ি। দানু মিয়া লন্ডনে অবস্থান করে জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে আসেন দেশে। সবাইকে সংগঠিত করে যুদ্ধে পাঠান এবং মধ্যবর্তী সময়ে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা দেশে এসে তার বাড়িতেই আশ্রয় নেন। 

খবর পেয়ে দুদু রাজাকার হানাদার বাহিনীকে নিয়ে যায় দানু মিয়ার বাড়িতে। সেদিন অপারেশন করতে দেশে আশা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গেরিলা যোদ্ধা প্রয়াত সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীও দানু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুই গাড়ি পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ে দুদুসহ অনান্য রাজাকাররা তার বাড়ির দিকে আসছে দেখে দানু মিয়া পাকবাহিনীকে গুলি করে প্রতিহত করে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। 

দানু মিয়া একাই অন্যদের বাঁচাতে যে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দানু মিয়া যখন পাকবাহিনীকে প্রতিহত করে সময় ক্ষেপন করেন তখন আত্মরক্ষার্থে তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলী ( প্রয়াত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী) পালিয়ে দানু মিয়ার পুকুরে নেমে আত্মগোপন করেছিলেন। 

কিন্তু সবাইকে পালাতে সাহায্য করলেও দুদু রাজাকারসহ অন্যরা ধরে ফেলে দানু মিয়াকে এবং হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পরবর্তীতে নিয়তিতে যা ছিলো তাই হয়। দানু মিয়া পাকবাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হন। সেদিন দানু মিয়াকে ধরে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা,তারি বাড়িঘর লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় রাজাকার দুদু ও তার সঙ্গীয়রা। 

এভাবে দুদু রাজাকার ও সঙ্গীয়রা ধরে নিয়ে যায় একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের, চালায় নারকীয় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। তারা অসংখ্য নারীর উপর চালায় পৈশাচিক নির্যাতন।


দানু মিয়ার বাড়ি ও পুকুর যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় ও আত্মগোপন করেছিলেন। 

ধরের বাড়ি হত্যাযজ্ঞ:
রাজনগর উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের জমিদার বাড়ি। অনেকে ধরের বাড়ি বলেও জানেন। ১৯৭১ সালে দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে চারিদিকে। অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিলেও এলাকার মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসায় ও মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হওয়া ধরের বাড়ির (জমিদার বাড়ির) লোকজন খুব একটা দেশ ছাড়েননি।

পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে এমন খবরও বাড়ির লোকজনের কাছে প্রতিনিয়ত আসছে। তদুপরি তারা সে দিন ধারনা করেছিলেন আসলে তারা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবেন। এভাবেই কেটে যায় নয় মাস। 

কিন্তু বিধিবাম এলাকার কুখ্যাত রাজাকার দুদু মিয়া তাদের দিকে যে পৈশাচিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, সেই দৃষ্টি আর সরাতে পারেনি। বিজয়ের আলো দেখতে আর বাকী ছিলো ১৮ দিন। ১৯৭১ এর ২৯ নভেম্বর দুদু রাজাকার সকালে বাড়ির বড়কর্তা সুরীতি মোহন ধরকে গিয়ে জানায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আসবে এই এলাকায় আপনারা-তো জমিদার। আপনাদের বাড়িতে তাদের একটু চা পানের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। 

সরলমনা ধরবাবু তাতে সম্মত হন। বিকেল বেলা রাজাকার বারিক মিয়া, দুদু মিয়া পাকবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে ধরের বাড়িতে। সবাইকে বাড়িতে ডাকে। সবাই যখন বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেন তখন প্রকাশ পায় তাদের আসল রুপ। নিমিষেই বিভীষিকা রুপ ধারণ করে পাকবাহিনী। অকাতরে গুলি করে হত্যা করে এ জমিদারবাড়ির সকল পুরুষদের। 

মহিলারা তখন শিশু-কিশোরদের নিয়ে আত্মরক্ষার্থে পেছন দিয়ে পালান। পরে রাজাকাররা ধরের বাড়িতে চালায় লুটপাট। লুটপাট শেষে বাড়িতে আগুন দিয়ে চলে যায় তারা। 

রাজাকার দুদু ও তার সঙ্গীয় রাজাকারদের দ্বারা মুন্সিবাজার ইউনিয়নে ধরের বাড়িতে গণহত্যায় নিহতরা হলেন, সুরীতি মোহন ধর, সুশীতল, শ্যামল, শতদল, শ্যামল ধর চৌধুরী, সজল, সুকেশ রঞ্জন, অরবিন্দ, অখিল ধর চৌধুরী, প্রতাপ পুরকায়স্থ, যতীন্দ্র মোহন ঘোষ, পরিমল দাস, বিজয় দাস, নরেন্দ্র দেব ও ক্ষিরোদ দেব।

এ ছাড়াও মুন্সিবাজার ও উত্তরভাগ ইউনিয়নে গণহত্যায় বাকী নিহতরা হলেন, সনথ চক্রবর্তী, রফিকুল ইসলাম, নবজাত আলী, বাদশাহ মিয়া, ছানা শীল, বাবুল দেব, ভবতোষ দাশ, মহিতোষ, বনমালী, নগর কান্তি দাশ, নরেশ সুত্রধর, খোকা সুত্রধর, অসিত দেব, বটুল পাটনী, ডা. জামিনী মোহন দেব, তারা মিয়া, কুরবান আলী ও দানু মিয়াসহ অজ্ঞাত আরো কয়েকজন। যে কারণে মানুষ দুদুসহ রাজনগরের রাজাকার আলবদর আল- শামসদের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা লাভের মহানায়ক ও মহান স্বাধীনতার ঘোষক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশকে শত্রুমুক্ত করার শপথে বলীয়ান মুক্তিকামী বাংলার জনগণ যুদ্ধের একপর্যায়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তা নিয়ে নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম ও বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনে বিজয়। 

৭১’ সালের ৫-৮ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর তোপের মুখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার জেলার সবগুলো এলাকা ছেড়ে পিছু হটতে থাকে সিলেটের দিকে। এদিকে ৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে রাজনগর হানাদারমুক্ত হলে স্বজনহারা মানুষেরা রাজাকারদের ধরতে মরিয়া হয়ে উঠেন। 

ধরের বাড়ি ও গণকবর স্থানের 

যেভাবে ধরা পড়ে দুদু:
মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের সাব সেক্টর - ৪ এর কোম্পানি কমান্ডার মুহিবুর রহমান চৌধুরী জানান, দুদু রাজাকার আত্মগোপন করে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষ তাকে যেভাবে খুঁজছিলো তার পক্ষে এলাকায় লুকিয়ে থাকা সম্ভব ছিলো না, এ ব্যাপারটি বুঝতে পেরে রাজাকার দুদু সিদ্ধান্ত নেয় জীবন বাঁচাতে মৌলভীবাজারে গিয়ে আত্মসমর্পন করবে। 

তিনি জানান, একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর দুদু রাজাকার একটি বোরকা পড়ে মৌলভীবাজারের দিকে রওয়ানা হয়। গ্রামের ভেতরের মেঠোপথ ধরে মৌলভীবাজার যাওয়ার পূর্বে মহল্লাল এলাকায়  লোকজন তার পায়ে পুরুষ মানুষের জুতো দেখে সন্দেহ করেন। এ সময় বোরকা খোলে দেখেন পুরুষ মানুষ, সাথে আশপাশের লোক জড়ো হলে অনেকেই তাকে চিনে ফেলেন। তখন সে জানায় আত্মসমর্পন করতে যাচ্ছে। লোকজন তাকে ধরে মৌলভীবাজার জেল হাজতে প্রেরণ করে। 

মতান্তরে মুন্সিবাজার নোয়া টিলার গণহত্যায় শহীদ নজাবত আলীর ভাই  বর্তমান এন আর বি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফারাসাত আলী জানান, ‘দুদু একটি রিকশায় করে পালিয়ে যাচ্ছিল, মহল্লাল এলাকায় তার চাচা নোয়া টিলার বাবুল মিয়া পর্দা টাঙ্গানো একটি রিক্সায় পুরুষ মানুষের পা দেখতে পান। তখন সন্দেহ হলে তার চাচা উপস্থিত লোকজনদের নিয়ে রিকশার পর্দা খুলে দেখেন দুদু রাজাকার, তখন তারা দুদুকে ধরে ফেলেন।’

খলাগ্রামের প্রখ্যাত আইজীবী অ্যাডভোকেট শান্তিপদ ঘোষ মতি জানান, দুদু আটকের এ খবর দ্রুত চলে যায় তার অত্যাচারের দুঃস্মৃতি বিজড়িত মুন্সিবাজারে, সাথে সাথেই খলাগ্রাম, বালিগাঁও, মুন্সিবাজারসহ আশপাশের গ্রামের হাজার হাজার মানুষ বের হয়ে পড়েন রাস্তায় এবং দুদুকে ধরে এনে প্রকাশ্যে জনতার বিচার ও রায়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। 

এ সময় কোম্পানী কমান্ডার মুহিবুর রহমান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তার বাহিনী নিয়ে সিলেটে যাওয়ার জন্য মুন্সিবাজার এলাকায় অস্ত্র সংগ্রহ ও সাথী যোদ্ধাদের জড়ো করছিলেন। অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধারা যখন ওই জায়গাটি অতিক্রম করছিলেন তখন জনতা তাদের পথ রোধ করেন। 

মুহিবুর রহমান জানান, উপস্থিত হাজারো জনতা দুদু মিয়াকে ধরে এনে জনতার আদালতে বিচারের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন তাকে ও তার পুরো বাহিনীকে।  কোনোভাবেই তারা লোকজনকে বুঝিয়ে সিলেটের দিকে রওয়ানা দিতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে মুহিবুর রহমান ওয়ারলেসযোগে মৌলভীবাজারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাব সেক্টরের দায়িত্বে থাকা কে. হামিদ  (মিত্র বাহিনীর অফিসার) ও বাংলাদেশের লে. ওয়াছিউর জামানকে (ফাস্ট আর্মি কমিশন) অবগত করেন।

তারা প্রথমে শুনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে ফের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান। কিছুক্ষন পর ওয়ারলেসযোগে ফিরতি মেসেজ আসে। সেখান থেকে মৌলভীবাজারে লোক পাঠিয়ে রাজাকার দুদুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই বিষয়টি সহজ করেন প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান ও মীর্জা আজিজ বেগসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। 

বর্তমান মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান জানান, সে সময় গণদাবিকে মূল্যায়ন করে একজন সুবেদারের সাথে কয়েকজন ফোর্সসহ দুদুকে মুন্সিবাজারে প্রেরণের সিদ্ধান্ত দেন। সেই মোতাবেক মুন্সিবাজার থেকে মো. ইলিয়াছ আলী, বাদশা মিয়া, সিরাজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন মৌলভীবাজার এসে এক সেকশন ফোর্সসহ হাবিলদার মতিউর রহমানের নের্তৃত্বে জেল থেকে দুদুকে নিয়ে যান মুন্সিবাজারের দক্ষিণ পাশে (বর্তমান খলাগাঁও করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে)। 

যেভাবে রায় কার্যকর হয়:
সেখানে পূর্ব থেকেই লোকজন অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সবার উপস্থিতিতে শুরু হয় বিচারকার্য। হাবিলদার মতিউর রহমান জনতাকে বলেন, দুদু রাজাকারের বিচার আপনারা যেভাবে চান সেভাবেই হবে। গ্রামের মুরব্বিদের নিয়ে শুরু হয় বিচারিক কাজ।
 
মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মুহিবুর রহমান চৌধুরী জানান, সেদিন বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক লন্ডন প্রবাসী ফিরোজ মিয়া, শহীদ ইয়াছিন আলীর পিতা ডা. সিকান্দর আলী, নোয়া টিলার হানিফ খাঁ, কবির বক্স, শহীদ রফিকের বড়ভাই রইছ মিয়া, গুলিবিদ্ধ সোহরাব আলীর বড়ভাই সামাদ আলী, গয়াস পুরের কটু মিয়া, ছাত্রনেতা পানু সোম, মুসুরিয়ার সিরাজুল ইসলাম ও হীরা মিয়া, তেলী জুড়ির আতাউর রহমান চৌধুরী, দক্ষিন বালিগাঁও এর আজাদ আলী চৌধুরী, আব্দুল করিম শশাংক বাবু  প্রমুখ। 

নিজ দেশের সাথে বেইমানি ও এদেশের মানুষকে নির্যাতনের হোতা পাকবাহিনীর এ চরকে খলাগ্রামে নিয়ে আসার পরপরই জনতা উত্তেজিত হয়ে লাথি থাপ্পর মারা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তার পশ্চাৎদেশে (মলদ্বার) বাঁশের চোখা লাঠি (সিলেটি ভাষায় ‘বেড়ার গড়ছি’) প্রবেশ করান মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া। 

মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া জানান, তিনি পাশের একটি বেড়া থেকে ‘গড়ছি’ এনে তার পশ্চাৎদেশে প্রবেশ করান, পরে বিচারকদের নির্দেশে তা আবার বের করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে বিচারকরা শুরু করেন বিচার কার্য। 

দুদুর সহায়তায় হত্যার শিকার পরিবারগুলোর কাছ থেকে উপযুক্ত সাক্ষ্য নিয়ে সবাই ঐক্যমত্যে পৌঁছে মিলে একত্রে রায় প্রদান করেন যে, ‘স্কুলের দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশে কোমড় পর্যন্ত মাটি চাপা দিয়ে পাথর ছুড়ে এ গণশত্রুর মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে। আর সেখানেই কবর রচিত হবে এবং কবরের উপর লেখা থাকবে কুখ্যাত রাজাকার দুদুর কবর।’

এ সময় গণ-আদালত স্থলে উপস্থিত দুদুর মা ও ভাই বিচারকদের বার বার অনুরোধ করেন, তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ তাদের দিয়ে দিতে।

তখন গণ-আদালতের বিচারকরা জনগণের কাছে আপনারা কি চান জানতে চাইলে, শিক্ষিত জনতা ‘কিল হিম’ বলে চিৎকার দিতে থাকেন আর অধিকাংশ জনতা ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই বলে স্লোগান দিতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ফারাসাত আলী জানান, ‘তখন পরিবারের আবেদনে পুনরায় বিচার শুরু করে রায় হয় গুলি করে হত্যা করার। আর গুলি করবে যে বাড়িতে সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ হয়েছে সে বাড়ির সবার ছোট ছেলে। সে মোতাবেক মুন্সিবাজার খলাগ্রামের ‘ধরের বাড়ি’তে সবচাইতে বেশি হত্যাকাণ্ড হয়, আর ধরের বাড়ির জীবিত পুরুষদের মধ্যে কিশোর সুভাষ ধর (বর্তমানে আমেরিকান প্রবাসী) সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিচারকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সুভাষ ধর তাকে গুলি করবেন।’ 

রায় অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা সুভাষ ধরের হাতে তুলে দেন রাইফেল। সুভাষ ধর তাকে গুলি করতে গিয়ে গুলি টার্গেট ঠিক না হওয়ায় সে যাত্রায় সে বেঁচে যায়। পরে সিদ্ধান্ত হয় হাবিলদার মতিউর রহমানের সাথে আসা ৭ সদস্যের মধ্যে একজন গুলি করে হত্যা করবে। সে মোতাবেক ওই সেকশনের সদস্য কমলগঞ্জ উপজেলা নিবাসী আলতাফুর রহমান ব্রাশফায়ার করে তাকে হত্যা করেন। রায় কার্যকর হওয়ার পর দুদুর পরিবারের লোকজন লাশ নিয়ে তাদের বাড়িতে দাফন করেন। 
  
কালের পরিক্রমায় এই গণরায়ের ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু আজও এই ইতিহাস সংরক্ষিত হয়নি। সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সেই গণ-আদালতে রায়ের স্থানটিও। স্থানীয়দের দাবি, যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের বিচারের রায় কার্যকর হওয়া (সম্ভবত) সর্বপ্রথম গণ-আদালতের এই স্থানটি সংরক্ষণ করে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসা এ ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে রাখার।

রাজনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সজল চক্রবর্তী জানান, ‘রাজনগরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় কোনো স্থানই এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ হয়নি। ধরের বাড়ি ও পাঁচগাঁও বধ্যভূমির জন্য বরাদ্দ আসলেও ভূমি জটিলতায় তা বিলম্ব হচ্ছে।’

তিনি জানান, মুন্সিবাজারের গণ-আদালত মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম দলিল। এই গণ-আদালতের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম গণ-আদালত গঠন করে প্রতীকি ফাঁসি দেন একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধী গোলাম আজমসহ অনান্য রাজাকারদের। তৎপর তরুণ প্রজন্মরা তৈরী করে গণজাগরণ মঞ্চ।

এআই/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি