ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কোভিড পরবর্তী সময়টা কিভাবে কাটাবে শিশু-কিশোররা

নাজমুশ শাহাদাৎ

প্রকাশিত : ১২:৩৪, ২৯ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১২:৫৯, ২৯ আগস্ট ২০২১

মহামারিকাল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোস্ট-কোভিড ট্রমা বা কোভিড পরবর্তী মনোদৈহিক বিপর্যয়, যা ব্যক্তি থেকে সমষ্টি পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘরবন্দি হয়ে পড়া শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের সঙ্গী হয়েছে রোগভয় ও ডিজিটাল স্ক্রিন আসক্তি। মাদকাসক্তির মতো অনলাইন গেম খেলাতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- কীভাবে এই রাহুমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক-স্বাচ্ছন্দ ও আনন্দময় জীবনে ফিরবে দেশের এই ভবিষ্যৎ কর্ণধাররা।

এ বছর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় ব্যতিক্রমী এক কনসার্টের আয়োজন করা হয়। স্টেজে ব্যান্ডদল এবং গ্যালারিতে দর্শকবৃন্দ—সবার জন্যে ছিল একটি করে বিশাল প্লাস্টিক বাবল। এর উদ্দেশ্য, করোনাভাইরাস যেন না ছড়ায়। কনসার্টের পুরো সময় তারা একেকটা স্বচ্ছ বাবলের মধ্যেই অবস্থান করেন। এর ভেতরে ছিল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, এক বোতল পানি, তোয়ালে এবং ব্যাটারি চালিত ছোট্ট একটি ফ্যান। (বিবিসি, ২৫ জানুয়ারি ২০২১)

এ দৃশ্য যতই অবাস্তব মনে হোক, কোভিডের ভয়-আতঙ্ক ও তথাকথিত আধুনিকতা চারপাশে বহু মানুষকে অদৃশ্য একেকটা বাবলের ভেতরেই যেন বন্দি করে রেখেছে। আর তার সঙ্গী হয়েছে রোগভয় ও ডিজিটাল স্ক্রিন আসক্তি। 

দিন দিন মাদকাসক্তির মতো অনলাইন গেম খেলাতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে দেশের তরুণ-তরুণী। স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া, অনলাইন গেমের সহজলভ্যতা ও গেমগুলোকে আনন্দদায়ক এবং অত্যাধুনিক করে গড়ে তোলার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে শীক্ষার্থীরা।

বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম বলতে গেলে ‘ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি’ নামের দুটি গেম, যা আজকাল মাত্রাতিরিক্তভাবে খেলতে দেখা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ফ্রি ফায়ারের ৫০০ মিলিয়নের বেশি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছে। অন্যদিকে পাবজি গেমটিরও মোবাইল ডাউনলোড প্রায় ২৩৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।

অতীতের ঘটনা থেকে দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনলাইন গেমের আসক্তি থেকে অনেকেই এক সময় অসহিষ্ণু, খুনী ও সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। গেমগুলো এমনভাবে তৈরি তরুণদেরকে নৃশংস, উগ্রবাদী, বর্ণবাদী চিন্তা-ভাবনায় আচ্ছন্ন করে ধীরে ধীরে আসক্ত করে ফেলে। যদিও সম্প্রতি আদালতের এক নির্দেশে গেম দুটিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। 

ভিডিও গেমকে চীনে ‘ডিজিটাল আফিম’ বলা হয়। কারণ চীনে প্রায় আড়াই কোটি তরুণ-তরুণী স্ক্রিনে আসক্ত এবং ৫০ শতাংশ শিশু-কিশোর মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। আর এ জন্য শঙ্কিত চীন সরকার ২০০৮ সালে স্ক্রিন আসক্তিকে ‘মানসিক ব্যাধি’ হিসেবে ঘোষণা করে।

ইতোমধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত মুঠোফোন, কম্পিউটার, ভিডিও গেম বা অনলাইন গেম খেলাকে মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশিষ্ট জনের মতে, ভিডিও গেম, অনলাইন গেম বা ডিজিটাল মাদক থেকে দেশের যুব সমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সচেতনতা। বিশেষ করে পরিবারের সচেতনতা দরকার সবার আগে। 

সম্প্রতি ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১৩-২৯ বছর বয়সী কিশোর-যুবাদের ওপর ইউনিসেফের একটি জরিপে দেখা যায় যে, কোভিড-১৯ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে উদ্বেগ, বিষন্নতা, কাজে মনোযোগহীনতা বা আগ্রহ বোধ না করা, হতাশা, স্ট্রেস অনুভব করা ইত্যাদি প্রধান। 

ঘরবন্দি থাকার কারণে বহু মানুষ আজ ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত, বেড়েছে তাদের বিষন্নতা অসহিষ্ণুতা অবসাদ এমনকি আত্মহত্যা-প্রবণতাও। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিশু-কিশোররা কীভাবে তাদের সময়কে উপভোগ্য করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুতি নিতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজন আমাদের বিশেষ সচেতনতা।

যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ো ক্লিনিকের মতে, কোভিড পরবর্তী সময়ে কারো কারো মাঝে যে উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে, তা হলো অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, কফ, শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা-বেদনা, স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ হ্রাস, ঘুমের সমস্যা, বিষন্নতা, ঝিমুনি, ক্লান্তি ইত্যাদি। এ তালিকার অধিকাংশ রোগই মনোদৈহিক অর্থাৎ রোগের প্রভাব দেহে প্রকাশ পাচ্ছে বটে, কিন্তু উৎস হলো মন।

এ ধরনের রোগগুলোর জন্যে ওষুধ বা প্রচলিত চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন মনের শুশ্রূষা। এ লক্ষ্যে পৃথিবীজুড়ে কার্যকরী যে পথটি বাতলে দিচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা, তা হলো- মেডিটেশন প্রাণায়াম, যোগ ব্যায়াম। সেইসঙ্গে সমমর্মী জীবনদৃষ্টি ও পারস্পরিক একাত্মতার মধ্যেই নিহিত এর কার্যকর সমাধান।

মনো চিকিৎসকেরা বলেছেন, বৃত্তটা ভাঙুন, আপনজনের কাছে যান। সব জড়তা ভেঙে পরিবার-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুদের কাছে যান। দেখা করুন, মন খুলে কথা বলুন। আপনজনদের সান্নিধ্য মন ভালো করে দেয়ার পাশাপাশি আপনার সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে অনেকগুণ। স্বেচ্ছাসেবায় যুক্ত হোন। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্যে কাজ করুন। এতে বাড়বে আপনার পরিচিত বলয় এবং কমবে অপ্রয়োজনীয় দুঃখবোধ। সবকিছুর আগে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি যত্মশীল হোন, সতর্ক হোন। 

জড়তা ও আতঙ্কের এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—ভালো কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হোন। এই ভালো হতে পারে কোনো সেবামূলক কাজ বা ইতিবাচক মানুষের কোনো সঙ্গ। অর্থাৎ যেখানে অনেক মানুষের সংস্পর্শ থাকবে এবং থাকবে বিশ্বাস ও আশা।

নিজের পরিবার অফিস বা বন্ধুরা মিলে মেডিটেশন, প্রাণায়াম চর্চাশুরু করতে পারেন। আপনার এই একটি উদ্যোগ শুধু যে ব্যক্তিজীবন থেকে জড়তা-আতঙ্ক-হতাশা ভাসিয়ে নেবে তা নয়, ব্যক্তি থেকে তা রূপ নেবে সমষ্টির আত্মবিশ্বাসে। স্থবিরতার শেকল ভেঙে সূচিত হবে জাতিগত উত্থান।

নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় এ-কালের একজন নেতৃস্থানীয় ও সুপরিচিত গবেষক স্টিভেন লরিস। গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্রেনকে রি-টিউন করার পাশাপাশি মহামারির সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর নানা প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায় আরো উঠে এসেছে রোগ নিরাময়, অস্থিরতা ও স্ট্রেসমুক্তি, শিশু মনের বিকাশসহ নানা ক্ষেত্রে মেডিটেশনের উপযোগিতার বিষয়টি। 

মেডিটেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- এর চর্চা ব্রেনকে রি-টিউন করে। সহজ ভাষায় মেডিটেশন হলো ব্রেনের ব্যায়াম। যখন কেউ নিয়মিত দৌড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই তার পায়ের পেশি মজবুত হয়; আবার যখন কেউ সাঁতার কাটে, তার হাতের পেশির শক্তি বাড়ে। তেমনি আমরা যখন মেডিটেশন করি, মস্তিষ্কের ভেতরেও আসে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন।

সুতরাং নিজেকে ভালবাসতে শিখুন, শিশুদের ভালবাসুন। তাদের দেহ-মনের যত্ন নিন, সুস্থতার প্রতি মনোযোগী হোন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যের জীবনের ফিল্টারিং অংশ দেখে বা মতামতের মুখাপেক্ষী হলে আপনি কখনো নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন না। প্রশান্তিতে থাকতে পারবেন না। পাছে লোকের কিছু কথা শোনা থেকে যত বিরত থাকবেন, আপনি তত সফল হবেন।

এনএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি