ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ জুলাই ২০২৫

গত ৪ বছরে স্বামীর হাতে খুন ৭৯৪ নারী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪০, ৪ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১১:১০, ৪ নভেম্বর ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

চার বছরেরও কম সময়ে দেশে প্রায় ৮ শত নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌতুকের জন্য তারা সহিংসতা বা হত্যার শিকার হন। অধিকাংশ ঘটনারই কোনো মামলাও হয় না। 

চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সারাদেশে ১৫২ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। আগের বছর ১২ মাসে এ সংখ্যা ছিল ১৯৩, ২০১৭ সালে খুন হয়েছেন ২১৩ জন, আর ২০১৬ সালে ১৯১ জন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)৷ তারা বলছে বাস্তবে সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। খবর ডয়চে ভেলে’র।

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মামলা করা হয় না। ২০১৬ সাল থেকে হিসাব করলে এখন পর্যন্ত ৭৯৪ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে মামলা হয়েছে মাত্র ৩৪৭টি। অর্থাৎ ৪৪৭টি ঘটনার মামলাই হয়নি।

আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, ‘হত্যা মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। এর নিষ্পত্তি একমাত্র আদালতের এখতিয়ার। তাই এইসব ক্ষেত্রে আদালত বা থানায় যেখানেই মামলা হোক তা প্রত্যাহার হয় সেটা বলা যাচ্ছে না। আর হত্যা মামলা আপসযোগ্যও নয়।’

তিনি বলেন, ‘যেটা ঘটে তা হলো, অনেক সময়ই অপরাধীরা থাকে শক্তিশালী। তারা প্রভাব বিস্তার করেন, শক্তি প্রয়োগ করে মামলা করতে দেন না। থানায় গেলেও অনেক সময় পুলিশ মামলা নেয় না। পুলিশ অবৈধভাবে প্রভাবিত হয়ে এ কাজটি করে। এছাড়া প্রভাবশালীরা চাপের মুখে ও অর্থের বিনিময়ে আপোষ করে ফেলে। কিন্তু এখানে পুলিশের ভূমিকা আছে। তারা তা পালন করছে না। কারণ হত্যার মত ঘটনা তো আর চাপা থাকে না। তাই পুলিশ নিজেই মামলা করতে পারে। পুলিশ অবৈধ সুবিধা নিয়ে তা করা থেকে বিরত থাকে। মনে রাখতে হবে হত্যা মামলার বাদী রাষ্ট্র।’

নারীরা সহিংসতা ও হত্যার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে স্বামীর পাশাপাশি তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভূমিকা থাকে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে হত্যাসহ পরিবারে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৯৭ জন। স্বামীর হাতে ১৫২ জন নিহত হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে ১৪৫ জন বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন খুন হয়েছেন স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে।

বাকিরা পরিবারের সদস্য এবং স্বামীর হাতে নানা ধরনের সহিংসতা শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৪২ জন। আগের বছরগুলোর হিসাব দেখলেও একই ধরণের চিত্র পাওয়া যায়।

স্ত্রী হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে যৌতুকের জন্যে। চলতি বছর ৭০ জন নারী এই কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন ৪৪ জন। তিনজন আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছেন। এর বাইরেও বনিবনা না হওয়া, পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কঠোর আইন থাকলেও আমাদের সমাজে ধর্মান্ধতা এখনো আছে। শুধু তাই নয়, সরকার তার রাজনৈতিক কারণে নারীর অধিকার নিয়ে নানা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করেছে নানা সময়ে। এখনো করছে। ফলে যৌতুকের মত বিষয়গুলো সমাজ থেকে দূর হয়নি। যার কারণে স্ত্রী হত্যার ঘটনা কমছে না।’

তিনি বলেন, ‘নারী এখন স্বাবলম্বী হচ্ছে, শিক্ষিত হচ্ছে৷ তার ভিতরে এখন স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে উঠছে। এটা অনেক পুরুষই মেনে নিতে পারছেন না। তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসেনি। তারা অন্ধ চিন্তার মধ্যেই আছেন। তাই তারা স্বাধীন নারীকে আঘাত করেন।’

তাঁর মতে, ‘স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা বা নারীর প্রতি ঘরে সহিংসতা আমাদের পশ্চাদপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোরই ফল। পরিবারের লোকজনও অপরাধে সহযোগী হয়। আমরা এর থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে পারব না।’

নারীরা বাড়িতেই সবচেয়ে কম নিরাপদ বলে জানান গবেষকরা। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনওডিসি’র একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছেঅ এর ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার হত্যাই সংগঠিত হয়েছে মৃত নারীদের পরিবারের কোনো সদস্যের দ্বারা। ২০১৭ সালে মোট ৩০ হাজার নারী খুন হয়েছেন তাদের সঙ্গী বা ভালোবাসার মানুষের হাতে৷ জাতিসংঘের তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রতি ঘন্টায় ছয়জন নারী নিজের পরিচিত মানুষের হাতে খুন হন।

শুধু নারী মৃত্যুর হার বা কারণই নয়, এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। পরিবারের ভেতরে নারী সব সময় পুরুষের তুলনায় কম ক্ষমতার অধিকারী হবার কারণেই বেশি অত্যাচারিত হয়। এর কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে লিঙ্গবৈষম্যকে। 

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয় আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলিতে। পরিবারের সদস্যদের হাতে নারীদের নিহত হবার সংখ্যাও এই দুই মহাদেশে সর্বোচ্চ।

প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, ‘নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রুখতে কঠোর আইন ও নীতি থাকা সত্ত্বেও তা পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।’ তবুও ইউরোপের দেশগুলিতে তুলনামূলকভাবে এই প্রবণতা সবচেয়ে কম।

নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়েছে এই প্রতিবেদন৷ পাশাপাশি, নারীর সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দ্রুত বিচার করতেও পরামর্শ দেয় এই প্রতিবেদন। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে পরামর্শ হিসাবে বলা হয়েছে, উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক নীতি-বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কথা। এই সব ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলাফল পেতে হলে পুরুষদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে প্রতিবেদনটি জানায়।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি