ঢাকা, সোমবার   ০৭ জুলাই ২০২৫

ট্রেন দুর্ঘটনা: নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:১৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। এ দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

মা-বাবার সঙ্গে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল আড়াই বছরের আদিবা আক্তার সোহা। কিন্তু হঠাৎ সে মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। ট্রেন দুর্ঘটনার পর আদিবার লাশ পড়ে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাসপাতালে। আর আহত হয়ে মা-বাবা কাঁতরাচ্ছিলেন ঢাকার একটি হাসপাতালে। মেয়ের মৃত্যুর খবরে নিজেদের শরীরের যন্ত্রণা ভুলে যান তারা। বারবারই সন্তানের কথা জানতে চান। দেখার জন্য পাগলের মতো আচরণ করেন।

নিহত আদিবার বাবা বানিয়াচং উপজেলার তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়া জানান, তিনি ও তার স্ত্রী নাজমা বেগম চট্টগ্রামের একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। বৃহস্পতিবার তারা বাড়ি আসেন। 

সোমবার স্ত্রী ও ২ সন্তানকে নিয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় আড়াই বছরের মেয়ে আদিবা আক্তার সোহা মারা যায়। আহত হন তিনি, তার স্ত্রী ও সাড়ে ৪ বছর বয়সী ছেলে নাছির। তারা এখন ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কথা বলতে গিয়ে সোহেল মিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। বারবারই জানতে চান মেয়ে কোথায় আছে। লাশ কোথায়।

শ্রীমঙ্গলের জাহেদা খাতুন (৪৫)। গ্রামের বাড়িতে স্বামীর কুলখানির অনুষ্ঠান শেষে চট্টগ্রামে ফেরার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। 

আহত হন তার মা ও তিন সন্তান। তাদের বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার গাজীপুর এলাকার রামনগর গ্রামে। জাহেদার ননদ হাসিনা খাতুন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি জানান, জাহেদার স্বামী মুসলিম মিয়া পরিবার-পরিজন নিয়ে কর্মসূত্রে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে বসবাস করতেন। সেখানে একটি জাহাজ কাটা শিল্পে কাজ করতেন তিনি। গত ৭ নভেম্বর তিনি কর্মস্থলে জাহাজ কাটার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান। স্বামীর কুলখানির অনুষ্ঠান করতে জাহেদা দুই ছেলে, দুই মেয়ে, মা ও শাশুড়িকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলের বাড়িতে আসেন। 

সোমবার রাতে উদয়ন এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম ফিরছিলেন তারা। কিন্তু কসবায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় জাহেদার। আহত হয় তার বড়ো ছেলে ইমন (১৭), মেয়ে সুমী (১৯) ও মীম (৮) এবং মা সুরাইয়া খাতুন। এদের মধ্যে ইমন ও সুরাইয়া খাতুনের দুই পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এদিকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার মজিবুর রহমান (৫০) সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় কসমেটিক পণ্যের ব্যবসা করতেন। সপরিবারে তিনি সেখানে থাকতেন। অনেকদিন পর গ্রামের বাড়ি হাজীগঞ্জে সস্ত্রীক ফিরছিলেন। কিন্তু তাদের আর ফেরা হল না। মজিবুর ও তার স্ত্রী কুলসুমা বেগম (৪২) সোমবার রাতে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান। এ ঘটনায় আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

পারিবারিক সূত্র জানায়, মজিবুর ও তার স্ত্রী রাতে সিলেট থেকে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেসে লাকসামে আসছিলেন। সেখান থেকে ভিন্ন রুটে চাঁদপুর আসার কথা ছিল তাদের। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনায় তারা মারা যান। মঙ্গলবার দুপুরে মজিবুরের বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, স্ত্রী ও তিন ছেলে নিয়ে মজিবুর সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বসবাস করতেন। সেখানে কসমেটিক পণ্যের ব্যবসা করতেন। তার গ্রামের বাড়ি হাজীগঞ্জ উপজেলার ১নং রাজারগাঁও ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড রাজারগাঁওয়ে।

ঘটনার বর্ণনা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত যাত্রী সুব্রত চক্রবর্তী (৪২)। বাবার নাম সাধন চক্রবর্তী। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে। তিনি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন।

তিনি বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে আঁতকে উঠি। এরপরই দেখি ট্রেন অন্ধকার হয়ে গেছে। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। অন্ধকারে এদিক-ওদিক ছুটছিলাম। কিন্তু বের হওয়ার পথ বা দরজা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় কিছু লোক টর্চ মেরে আমাকে ট্রেনের জানালা দিয়ে টেনে বের করে। তখনও বুঝতে পারেনি কি হয়েছে। চারদিকে শত শত যাত্রীর চিৎকার আর আহাজারি। তখন বুঝলাম ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছে।

প্রসঙ্গত, সোমবার রাত পৌনে ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের লুপলাইনের মুখে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে ১০ এবং হাসপাতালে নেয়ার পর ছয়জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন শতাধিক। 

দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন- চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম রাজারগাঁও গ্রামের মুজিবুর রহমান (৫৫) ও তার স্ত্রী কুলসুম (৪০), সদর উপজেলার উত্তর বালিয়া গ্রামের বিল্লাল মিয়াজির মেয়ে ফারজানা আক্তার (১৫), হাইমচর উপজেলার দক্ষিণ ঈশানপুর গ্রামের মইন উদ্দিনের স্ত্রী কাকলী আক্তার (২০) ও মরিয়ম বেগম (৬), হবিগঞ্জের সৈয়দাবাদ এলাকার আজমত উল্লাহর ছেলে রিপন মিয়া (২৫), সদর উপজেলার বাহুলা গ্রামের ইয়াছিন আরাফাত (১২), চুনারুঘাট উপজেলার তীরেরগাঁও গ্রামের সুজন আহাম্মেদ (২৪), বানিয়াচং উপজেলার মদনমুরক গ্রামের মো. আল-আমিন (৩০), হবিগঞ্জ পৌরসভার আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা ও হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), বানিয়াচং উপজেলার বড়ো বাজারের মো. সোহেল মিয়ার মেয়ে সোহা মনি (৩), চুনারুঘাট উপজেলার আহমাদাবাদ গ্রামের আবদুল ছালামের স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৪১), মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার গাজীপুর গ্রামের জাহেদা খাতুন (৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সোহেল রানার মেয়ে আদিবা আক্তার (২), নোয়াখালীর মাইজদীর শংকর হরিজনের ছেলে রবি হরিজন (২৩) এবং অজ্ঞাত ৪১ বছর বয়সি এক নারী। এই দুর্ঘটনায় শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ১০ জনের মৃত্যু হয়। পরে বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ছয় জন মারা যান। আহতদেরকে কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সকালে মুন্না মিয়া (২৫) ও বিকালে মির্জা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন সৈকত (২৭) নামে দুই জনকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। এছাড়া নিহতদের মরদেহ দাফনে সহযোগিতার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলের কাছে বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প খোলা হয়েছে। কিছুদিন আগে গত ২৩ জুন সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস ব্রিজ ভেঙে খাদে পড়ে পাঁচ জন নিহত হন।

রেলপথ সচিব মোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, ঘটনার পর থেকে তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের চালক, সহকারী চালক ও গার্ড পলাতক রয়েছেন। তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি