ঢাকা, রবিবার   ০৫ মে ২০২৪

নানির বুলবুলি সখা-সখী

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ১৫:১৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

সুহা চিৎকার করে নানাকে ডাকছে, নানার কোন সাড়া নেই এবার নানুকে ডাকছে, ‘নানু নানু দেখে যাও একটা পাখি রান্নাঘরে ঢুকেছে। নানু-নানু ও নানু....’

সুহা ঠাশ্ ঠাশ্ করে রান্নঘরের দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করছে। জানালার সাদা কাঁচ দিয়ে দেখে নানা পুকুরঘাট থেকে ফিরছেন। সুহা মনে মনে খুব খুশি, এবার নানাকে বলবে পাখিটা ধরে দিতে।

দোতালার বাথরুমে খিচ্ খিচ্ আওয়াজ হচ্ছে ও বুঝতে পারে নিশ্চয় নানু কাপড় কাঁচছেন। সুহার আম্মুতো দোতলার বারান্দায় শাহানকে রুটি হালুয়া খাওয়াছেন। সুহার আব্বু সেই সকালে গেছেন মাহমুদ নানার সাথে ভুইয়া বাড়িতে এখনো ফিরেননি। দরজা-জানালা আটকে সুহা পাখিটাকে হুশ হুশ করে তাড়াছে। ওর ইচ্ছা পাখিটা ওড়তে ওড়তে হয়রান হয়ে নিশ্চয়ই ধরা দিবে। আজ ওটাকে ধরতে হবে, তারপর সুতোয় বেঁধে রাখবে।

নানা ঘরের কাছাকাছি আসতেই সুহা ডাকে ‘নানা নানা এদিক আস, রান্নাঘরের দিকে।’ নানার হাতে একটা লম্বা কচু। গত রাতে সুহার আম্মু বলেছেন, টান কচু দিয়ে শুঁটকি রান্না করবে। কচুতে প্রচুর আয়রন আর ভিটামিন আছে। ডাক্তার আম্মুকে কচু, কচুশাক, পালংশাক আরো নানান সবুজ শাক-সবজি খেতে বলেছেন।

গত পরশু নানি কচুপাতার ভর্তা করেছেন। নানু সুহাকে বল্লেন, ‘খেয়ে দেখ দারুণ মজা হয়েছে। খেতে বসে সুহা এক চিমটি চেখে নেয়। পরে মজা পেয়ে বলে, নানু আরেকটু দাও না আমাকে।’

শাহানতো ওসব একদম খেতে চায় না। ওতো শুধু আলু তরকারি খায়, এমনকি শাকও খেতে চায় না। 

আম্মু ভাতের সাথে কচু শাকের ভর্তা একটু মিশিয়ে লালশাকের ঝোল দিয়ে ভাত রাঙিয়ে দেন।

শাহান এক লোকমা মুখে দিয়ে কেমন কেমন করে একবার ওয়াক্ করে, দ্বিতীয়ার ভুলে ভালে খেয়ে ফেলে। আসলে শাহান জানালা দিয়ে দোয়েল পাখিটার ওড়াওড়ি দেখছিল। দোয়েল পাখিটা এ গাছ ও গাছ উড়ে পোকা মাকড় খুঁজছিল। তার সাথিটা এক সময় ফিরে এলো, দুটো পাখিই তুলা গাছের মগডালে গিয়ে বসে। শাহান এবার উঠে গিয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে ওদের খুনসুটি দেখছে আর মজা পাচ্ছে।

সুহা, শাহান প্রায় সপ্তাহ ধরে নানাবাড়ি বেড়াচ্ছে। খুব মজা হচ্ছে ওদের। ঘরের ভেতর নানা-নানির কথায় মজা, নানার সাথে বাইরে বেড়াতে গেলে পাখি দেখে, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি গাছ-গাছালি কত্তোকি। গরুর বাছুরটার লাফালাফি ওর খুব দেখতে হচ্ছে হয়। একবার এদিক ছুটে যায়, আবার ফিরে আসে মার কাছে মা তার লেজ  শুকে শুকে নিজ বাচ্চা চিনে নেয়। আবার বাচ্চার ঘাড়, পিঠ, জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে আরাম দেয়।

সকাল বেলা নানা লালশাক, বরবটি, মূলা তুলতে খেতে নিয়ে যান সুহা শাহানকে। ওরা লালশাক, ধনে পাতা, পালং শাক তুলতে খুব পছন্দ করে। লালশাকের পাতার লাল রঙ হাতে মেখে শাহান আম্মুকে দেখায়। সুহা লালশাকের আলতা রঙে নিজের পা রাঙিয়ে নেয়।

সুহার আম্মু গ্রামে এসে অনেকটা নিশ্চিন্তে আছেন। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোনো টেনশন নেই। ঢাকায় থাকতে লেখা-পড়া, স্কুল ড্রেস, স্কুলে আনা-নেয়া, রাস্তাঘাটে ভিড়, ধুলাবালি সব কিছু এড়িয়ে গ্রামে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নির্ভেজাল জীবনযাপন করছেন।

সুহা-শাহান খোলামেলা জায়গা পেয়ে খেলা-ধুলা ছুটাছুটি করছে মনের আনন্দে। এমনকি পুরান বাড়ির অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। রামিসা, মাওয়া, রিমি, ছাফা ওদের সাথে আমতলায়, জামতলায়, পুকুরঘাটে যাওয়া-আসা, মালা-খোলা নিয়ে মিছেমিছি জোলাভাতি খেলেও আনন্দ পাচ্ছে।

শাহান-সুহা ক’দিন থেকে মা-বাবার মোবাইল নিয়ে টানাটানি করে না, মোটা-পাতলু কার্টুন ছবি দেখাও ভুলে গেছে। ঢাকায় থাকতে মোবাইল গেম, টেলিভিশনে কার্টুন ছবি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতো। মা কত বিরক্ত হতো, বাবা অফিস থেকে ফিরে রাগ করতেন এখন ওসব কিছুই বলতে হয় না। ডাক্তার কতবার বলেছেন ‘মোবাইলে গেমস্ খেলো না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখো না, চোখের দৃষ্টি কমে যাবে, মাথার ব্রেন শূন্য হয়ে যাবে।’ হয়েছেও তাই সুহা এখন চশমা ছাড়া পড়তে পারে না, শাহান প্রায়ই চোখ কচলায়, মাঝে মাঝে বলে ‘মাথা ব্যথা করে,’ খেতে বল্লে বলে খাব না। 

মুখে খাবারের লোকমা না গিলে ফেলে দেয়। এখনতো নানু বলেন, ‘আমার নানুরা মাশাআল্লাহ্ যা দেই তাই খায়, পেট ভরে খায়। মজা করে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।’

এদিকে নানাতো ঘরে ঢুকেই সুহার ডাকডাকি শোনে। ও বলছে নানা, নানা, চোট্টা পাখিটাকে রান্নাঘরে আটকে রেখেছি। তুমি রান্নাঘরে চুপ করে ঢুকে পাখিটা আমাকে ধরে দাও।

নানা টান কচুটা দরজায় আড়ালে খাড়া করে রেখে বলেন, ‘সুহামনি দরজাটা খোল দেখি কি হয়েছে?

‘নানা চোট্টা পাখিটাকে আটকে রেখেছি, দরজা খুল্লে বেরিয়ে যাবে।’

‘দরজাটা যদি না খোল, আমি ঢুকবো কি করে? একটা কাজ করো পাখিটাকে ঐ পাশে তাড়িয়ে দাও-’

‘জান নানা চোট্টা পাখিটা তোমার পাকা পেঁপেটা ফুটো করে খেয়েছে।’

‘তাই বলো সকালে ডাইনিং টেবিলে যে রেখে ছিলাম সেটার কথা বলছ? এখন দরজা চট্ করে খুলে দাওতো, ওটাতো বুলবুলি, লেজের নিচে লালচে দাগ আছে তাইতো?’

‘একদম ঠিক। কিভাবে দরজা খুলবো, ওটা যদি ফুড়ৎ করে পালায়। নানা নানা রেডি, ওটা ঐদিকে মিটসেফের উপর বসেছে। এই যা, আবার চলে এসেছে এ পাশে। দাঁড়াও আবার তাড়িয়ে দিচ্ছি। আমাকে কিন্তু ধরে দিবে। আমি ওটাকে পালবো। বাজার থেকে একটা খাঁচা এনে দিবে হ্যাঁ’।

‘আচ্ছা সে হবে, এখন দরজা খোল।’

সুহা দরজা ফাঁক করতেই নানা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। বুলবুলিটা উড়ে এসে দরজার ওপরে লাইট হোল্ডারের ওপর বসে।

‘এই দেখ তোমার পাকা পেঁপের কি অবস্থা। পেছন দিকের হলুদ অংশটুকু খেয়ে নিয়েছে চোট্টা পাখিটা।’

‘ওটা যে ওর খাদ্য, ওদের বাইরের খাবার কমে গেছে। আগে অনেক জঙ্গল ছিল, গাছ-গাছালিতে ভরা ছিল গ্রাম, কত রকমের গাছ-গাছালি, আশেপাশের আমরা গাছ কেটে ফেলেছি, জঙ্গল সাফ করে ফেলেছি। এখন ওদের খাবার কমে গেছে। জানতো গাছের নানান জাতের ফল হয় কিছু মানুষ খায় কিছু পশু-পাখি খায়। কত কত রকমের পাখ-পাখালি ছিল আমাদের এলাকায়। সে শত জাতের পাখি হারিয়ে গেছে, খাবার আর আশ্রয়ের অভাবে।’

‘হারিয়ে গেছে। মানে কি বল্লে? সুহার প্রশ্নে কাতরতা, মনটা বিষণ’।

‘কোথাও চলে গেছে, আবার হয়তো মরেও গেছে। পাখ-পাখালি আমাদের পরিবেশের বন্ধু। আমাদের একান্ত আপন। ওরা পোকা-মাকড় খায়, কত সুন্দর ওদের ওড়াওড়ি, ওরা বাসা বানায়, ছানা ফোটায় বলতে পার প্রকৃতির অলংকার। ওরা না থাকলে আমাদের পৃথিবী অসুন্দর হয়ে যেতো। ভাবতে পারো?

‘ওকে ছেড়ে দাও নানা ভাই’-

‘না-না ওটা বেশ সুন্দর পাখি আমি ওকে খাঁচার ভরে পালবো। ওকে কথা শিখাবো-আমাকে ডাকবে-’

‘না-না তা-কি হয়? ওটাকে যে পাখি, মুক্ত আকাশে ওড়ার জন্য আল্লাহ্ পাখি সৃষ্টি করেছেন, তাছাড়া ওর পরিবার পরিজন রয়েছে না। এ পাখিতো ওর পরিবারের অংশ।’

‘পরিবার কি বলছ নানা? মানে আব্বু-আম্মু, ভাই-বোন এসব আছে?’

‘আব্বু-আম্মু ছাড়াও ওর নিজের ছানাও থাকতে পারে। ও যদি স্ত্রী জাতীয় পাখি হয় ওর স্বামী আছে। আর যদি পুরুষ জাতীয় হয়, ওর স্ত্রী থাকতে পারে। ওর ভাই-বোন নিশ্চয় রয়েছে। ধর শাহান তোমার ছোট ভাই। ও যদি অনেকক্ষণ বাইরে থাকে বা কোথাও চলে যায় তখন কি করবে!’

‘কি করবো মানে ওকে খুঁজে আনবো।’

‘তাহলে ঐ দেখ জানালা দিয়ে, কদমগাছে একটা বুলবুলি দেখছ? সুহা তাকিয়ে দেখে সত্যিইতো আরেকটা বুলবুলি কদমের ডালে ডালে অস্থিরভাবে লাফাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে-

‘তা হলে এখন কী করবে।’

‘জানালাটা খুলে দেই নানা?’

জানালার এক পাট খুলতেই ফুড়ুৎ করে বুলবুলিটা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে একদম কদম ডালে। সুহা বাইরে এসে লক্ষ্য করছে ওরা একজন আরেকজনকে দেখছে, নড়েচড়ে লাফাচ্ছে, একজন আরেকজনের পালক পরিচর্যা করে দিচ্ছে ঠোঁট দিয়ে। একটু পরেই দু’টি বুলবুলি মনের আনন্দে উড়ে যায় আকাশে। সুহা হায় হায় করে ওঠে। নানাকে বলে, ‘নানা চলে গেল তো!

‘আবার আসবে দেখে নিও।’

‘আচ্ছা নানা, তুমি ওদের ভাষা বোঝ?’

‘না ভাষা বুঝি না, তবে ওদের আচরণ লক্ষ্য করলে অনেক কিছুই বোঝা যায়।’

‘তাই নাকি!’

‘তুমিও বুঝবে। পাখিগুলোর দিকে নজর রাখ এক দুই তিন দিন দেখবে-অনেক কিছু বুঝতে পারবে-’

নানি কাপড় কেচে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখে বন্ধ জানালা এমনকি দরজাও ভেজানো। ওদের দুজনকে রান্নাঘরে দেখে নানিতো অবাক।

নানী পেঁপেটার দিকে তাকিয়ে বলেন ও বুঝেছি; ‘বুলবুলি, আমার বুলবুলিটা এসে খেয়ে গেছে। দরজা জানালা বন্ধ দেখে বলেন, ‘ওটাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলে তাই না?’

‘নানি মজা করে বল্লেন, ‘ও দু’টাকে আমি পালন করি। একটা আমার নারী সই, অন্যটা পুরুষ সখা।’

‘নানা নানির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে অভিমানের সুরে বলেন ‘তাইতো বলি আমার প্রতি এতো অবহেলা কেন!’ ওরা তিনজনেই এক সাথে হেসে ওঠে।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি