ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

নিপীড়কের মুখেই খাবার তুলে দেন তিনি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:০৮, ২৩ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৬:২১, ২৩ জুলাই ২০২০

নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়কদের একজন। যিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, তিক্ততা ভুলে বৈরি প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মতো উদারতা এবং তাঁর বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় জীবন কাহিনী—এসব মিলিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। 

বর্ণবাদের অবসানের পর ১৯৯৪ সালের ১০ মে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এর মাত্র এক দশক আগেও সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকায় এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ছিল এক অকল্পনীয় ঘটনা। এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি ভূমিকা রাখেন। যার প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একদিন তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে বললেন- চলো আজ শহর দেখি। চার দেয়ালের ভিতর বন্দি জীবনের দীর্ঘ সময় কাটানোর পর নিজের শহরটি কেমন হয়েছে। নিজ চোখে না দেখলেই নয়।

সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা শহরের অলি-গলি হাঁটলেন। এক পর্যায়ে বেশ ক্ষুধা লাগার পর ম্যান্ডেলা বললেন- সামনের মোড়ে যদি কোনো রেস্তরাঁ থাকে, সেখানেই খেয়ে নিতে চাই। শুনে সহকর্মীরা তো অবাক! বুঝতে পেরে ম্যান্ডেলা বললেন, অবাক হওয়ার কিছুই নাই; ক্ষুধা লেগেছে, খাবো। কয়েদখানার বিভৎস খাবার খেয়েও যেহেতু মরিনি, তাই এতো সহজে মরবো না।

সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসেছেন। অল্পদূরে আরেকজন ভদ্রলোক বসে আছেন, বেশ বয়ষ্ক। হোটেলের ওয়েটারকে ম্যান্ডেলা বললেন- একটা চেয়ার এনে আমার পাশে রাখো এবং ওনাকে বলো- আমার টেবিলে এসে বসে খেতে। অতঃপর ভদ্রলোক আসলেন। এসে ম্যান্ডেলার পাশের চেয়ারটাতেই বসলেন। 

খেতে খেতে সবাই গল্প করছে। কিন্তু পাশে বসা লোকটি কিছুই খেতে পারছেন না। ওনার হাত কাঁপছে। চামচ থেকে খাবার প্লেটে পড়ে যাচ্ছে। তখন ম্যান্ডেলার সহকর্মীদের একজন বললেন- আপনি মনে হয় অসুস্থ। কিন্তু কোনও জবাব না দিয়ে লোকটি চুপচাপ রইলো। কিছুই বললো না।

ম্যান্ডেলা তখন নিজ হাতে ওই বৃদ্ধকে খাবার খাইয়ে দিলেন এবং ওয়েটারকে ডেকে বললেন- ওনার খাবারের বিলটাও আমরা পরিশোধ করবো। খাবার শেষে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু সবাই অবাক চোখে দেখলো- লোকটি ভালো করে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারছেন না। শরীরের কাঁপুনি ক্রমবর্ধমান!

ম্যান্ডেলা নিজ হাতে ওনাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন এবং সহকর্মীদের একজনকে ওনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। সহকর্মীদের মধ্যে আরেকজন বললেন- এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে উনি বাড়ি পৌঁছাতে পারবেন তো! 

এ সময় ম্যান্ডেলা বলতে শুরু করলেন- উনি অসুস্থ নন। আমি জেলের যে সেলে বন্দি ছিলাম উনি ছিলেন সেই সেলের গার্ড। প্রচন্ড মার খেয়ে আমার যখন খুব তৃষ্ণা পেতো। পিপাসায় কাতর আমি যতবার পানি পানি বলে আর্তনাদ করতাম, ততোবারই উনি আমার সমস্ত শরীরে প্রসাব করে দিতেন।

সেই আমি আজ দেশের প্রেসিডেন্ট। সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হওয়ার পর আমি ওনাকে আমার টেবিলে একসাথে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করেছি! তাই সেই সব দিনের কথা মনে করে উনি খুব ভয় পেয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাবান হয়েই ক্ষমতাহীন মানুষকে শাস্তি দেয়া তো আমার আদর্শের পরিপন্থী। এটা আমার জীবনের নীতির অংশ নয়। তাই শাস্তি পাওয়ার পরিবর্তে উনি ভালোবাসা পেয়েছেন।

এসময় ম্যান্ডেলা আরও বলেন, উনি আমার মুখে/শরীরে প্রসাব করেছেন। আর আমি ওনার মুখে খাবার তুলে দিয়েছি। আমি আপনাদের যেমন প্রেসিডেন্ট, তেমনি ওনারও প্রেসিডেন্ট। প্রতিটি নাগরিককে সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব। ম্যান্ডেলা বলেন, তোমরা মনে রেখো- শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতাই একটি তৈরী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আর সহনশীলতার মানসিকতা একটি ধ্বংস রাষ্ট্রকে তৈরী করতে পারে।

কিংবদন্তীর নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন কেপ প্রদেশের থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায় উমতাতার নিকটবর্তী এমভেজো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে ম্যান্ডেলা তিনবার বিয়ে করেন। তার ৬টি সন্তান, ২০ জন নাতি-নাতনি এবং অনেক প্রপৌত্র রয়েছে। থেম্বুর উপজাতীয় নেতা মান্দলা ম্যান্ডেলা হলেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন এই জীবন্ত কিংবদন্তী।

১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাকী জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি দারিদ্র দূরীকরণ এবং এইডস নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রচারণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

নেলসন ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাকে কিভাবে মনে রাখলে খুশী হবেন তিনি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে।”

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি