ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

পদ্মার ভাঙনে বসতভিটা হারাচ্ছে মানুষ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংবাদদাতা 

প্রকাশিত : ১৪:৪৫, ১৭ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ২১:৪৮, ১৯ আগস্ট ২০২১

রাস্তার পাশে একটি দোকানের মাচায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন ৬০ বছর বয়সী আব্দুর রহিম। দু-দিন আগে সর্বনাশা পদ্মার ভাঙনে বসতভিটা হারিয়েছেন তিনি। এখন তিনি নিঃস্ব, ঠিকানাহীন। স্ত্রী-সন্তান ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের গ্রামে বোনের বাড়িতে। পদ্মার ভয়াল ভাঙনে বসতভিটাহারা আব্দুর রহিমের মতো ৩০টির বেশি পরিবার ঠিকানা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কোথায় আশ্রয় নেবেন তা বলতে পারছেন না তারা। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ঠিকানাহারা পরিবারগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছেন।

পদ্মার ভাঙনে বসতভিটা হারানো আব্দুর রহিম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের গোয়ালডুবী দক্ষিণমাথায় ছিল আমার পৈত্রিক বসতবাড়ি। কত বছর আগে থেকে এখানে আমাদের বসবাস জানি না। তবে আমার জন্ম এখানেই হয়েছে। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও নাতীদের নিয়ে ১৩ সদস্যের বসবাস ছিল এই বাড়িতে। জমি চাষাবাদ করে ভালোই ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই বসতবাড়িটিও পদ্মার করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী গোঠাপাড়া গ্রামে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কোথায় স্থায়ী হওয়া যায় সেটি ঠিক করতে পারিনি। কিছু আবাদী জমি রয়েছে সেগুলো বসবাসের উপযুক্ত নয়। ফসলি জমি বিক্রি করে সুবিধা মতো কোথাও বসত গড়বÑ যোগ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, পদ্মা নদীর ভাঙনে ৩০ বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত আমরা। গত ৩০ বছরে পদ্মা নদীর ভাঙনে আমাদের ২৫ বিঘারও বেশি জমি বিলিন হয়ে গেছে। এখন আমি পুরোপুরি নিঃস্ব।

আব্দুর রহিমের প্রতিবেশী গাজলী রহমানও গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারও চিত্র একই। তিনি বলেন, বাখেরআলী বিজিবি ক্যাম্পের পাশে অন্যের জমিতে টিনের চালা তুলে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছি। কোথায় বসত গড়ব নিশ্চিত বলতে পারছি না। কোন উপায় তো নেই। সামর্থ অনুযায়ী কোথাও স্থায়ী বসত গড়তে হবে। তিনি আরও বলেন, স্ত্রী-সন্তানসহ ১০ সদস্য নিয়ে বসবাস করতাম এই বাড়িটিতে। পদ্মার তীব্র ভাঙনে বাড়িঘর সরানোর সময় পাওয়া যায়নি। তবে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় আসবাবপত্রগুলো সরিয়েছি। এখন স্থাপনা ভেঙে ইটগুলো সরিয়ে নিচ্ছি।

নদী ভাঙনে বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়ছেন আকমাল মাস্টার, কামাল, আশরাফুল, সামজাদ, নজরুল, এহু ও মোখলেসসহ অনেকে। এদের মধ্যে আকমাল মাস্টার, এহু ও মোখলেসের বাড়ি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।

তারা জানান, নদীর ধারে তাদের বসবাস। দাদার আমল থেকে এখানে বসবাস করে আসছেন। তবে প্রতি বছর এই মৌসুমে ভয়াল পদ্মার ভাঙনে তাদের উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করতে হয়। গত কয়েক দিনের ভাঙনে তাদের বসতভিটা নদীতে নেমে গেছে। গ্রামে থাকার মতো অবস্থা নেই। মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই। তাই বাধ্য হয়েই গ্রাম ছাড়ছেন সবাই। করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ।

বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে ধসে পড়েছে বসতভিটা। নদী তীরের মানুষ ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ করছেন। সহায় সম্বল হারা পরিবারগুলো নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। নদীর গতি পরিবর্তন ও বেশ কয়েকটি গোল সৃষ্টি হওয়ার ফলে এ ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। তারা বলছেনÑ ভাঙন রোধে নির্ধারিত সময়ে ব্যবস্থা নিলে এতো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে তাদের পড়তে হতো না।

এদিকে পদ্মার বিধ্বংসী ভাঙনে বাখেরআলী ও চরবাগডাঙ্গা বিজিবি আউটপোস্ট, চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরবাগডাঙ্গা ইউপি কমপ্লেক্স, বেড়িবাঁধ-পাকা সড়ক, তিন শতাধিক আমবাগান, ১১টি গ্রাম, তিনটি বাজার এবং পাকা সড়কের পশ্চিমে সাড়ে চার হাজার বসতভিটা ভাঙনের কয়েকশ’ গজের মধ্যে চলে এসেছে। নদীর আরও নিকটবর্তী তিনটি গ্রামের লোকজন বাড়িঘর সরিয়ে নিয়েছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, এক সপ্তাহের ভাঙনে প্রায় ২০টি ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের গোয়ালডুবী গ্রামের দক্ষিণমাথা একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ভাঙন এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলছে। পরে ব্যাগগুলোও পদ্মার তীব্র স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। তবে জিও ব্যাগ না ফেলে শুকনো মৌসুমে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তা না নিলে ধীরে ধীরে এ ইউনিয়নের অস্তিত্ব থাকবে না।

এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, চলমান ভাঙন ঠেকানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রুত জরুরি কাজ শুরু হবে। ভাঙন এতটা তীব্রতর হবে, আগে কেউ ধারণা করেননি। ভাঙন রোধের জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ভাঙন এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ৫৬৬ কোটি ছাড়াও নতুন করে ভাঙন এলাকায় আরও ১৬৫ কোটি টাকার ঠিকাদার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বন্যার পরপরই সব কাজ শুরু হবে।

আরকে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি