ডিসেম্বরের রণাঙ্গন
বন্ধুরা যুদ্ধ শেষ, ‘আমরা জিতে গেছি’
প্রকাশিত : ১০:৩৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ | আপডেট: ১০:৪৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
 
				
					১৬ ডিসেম্বর। সকাল সাড়ে আটটা। সাভারে হেমায়েতপুর ব্রিজের ওপর ‘ঘ্যাঁ ‘ শব্দ করে দাঁড়াল একটি জিপ। ভেতর থেকে নামলেন জেনারেল নাগরা। গাড়ির বনেটের ওপর এক টুকরো কাগজ রেখে একটানে লিখলেন;
প্রিয় আবদুল্লাহ,
আমরা এসে পড়েছি। তোমার সব বাহাদুরি আর খেলা শেষ। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতো আত্মসমর্পণ করো। না হলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানাচ্ছি, তোমার জীবনের নিরাপত্তা অবশ্যই দেওয়া হবে।
তোমার 
মেজর জেনারেল নাগরা
সকাল ৮টা ৩০ মিনিট
১৬।১২। ১৯৭১
২
নাগরার চিঠি নিয়ে পাঁচ জন ভারতীয় সেনা ছুটে চলল ঢাকার দিকে। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে এই চিঠি পৌঁছে যায় নিয়াজির হাতে। মাথা তেতে উঠল। বাঁ হাত রাখলেন মাথায়। ভেলভেট কাপড়ে মোড়ানো সোফায় বসে পড়লেন। পাশে বসে আছেন মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ। 

তারা সবাই চিঠি দেখলেন। দেখা শেষে রাখা হলো টেবিলের ওপর। রাও ফরমান আলী একজনকে বললেন, চিঠির বাহককে ভেতরে নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ পর বিশেষ বার্তা পেলেন জেনারেল অরোরা।
কলকাতায় সেনাকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। বার্তার প্রেরক জেনারেল নিয়াজি। এতে লেখা, ঢাকার ওপর আজ বিকেল তিনটা পর্যন্ত বোমাবর্ষণ বন্ধ রাখুন। একজন স্টাফ অফিসার পাঠান আত্মসমর্পণের বিষয় চূড়ান্ত করার জন্য। চিৎকার করে উঠলেন অরোরা, ‘বন্ধুরা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আমরা জিতে গেছি। আমরা জিতে গেছি, জিতে গেছি।’
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্র বাহিনীর ঢাকা প্রবেশ। পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের শরীর। বিশেষ বিমানে চেপে অরোরা ঢাকায় চলে আসেন।
এদিকে দুপুর গড়ানোর আগে মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বিষয় চূড়ান্ত করে ফেললেন। আত্মসমর্পণ দলিলে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কথাটির আপত্তি তুললেন রাও ফরমান আলী। তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চান না। টিকল না আপত্তি।
নিয়াজি চাইলেন, আত্মসমর্পণের পর্বটা তার অফিসে হোক। 
জেনারেল জ্যাকব বললেন, না, বিষয়টা খোলা জায়গায় এবং খোলাখুলিভাবেই করতে হবে। অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে; যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
 
 
সারা দেশের মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। সবার কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি।’
৩
চারটা ৫৫ মিনিট। রেসকোর্স ময়দানে কাঠের টেবিল পেতে পাশাপাশি বসলেন জেনারেল অরোরা ও নিয়াজি। মুজিবনগর সরকারের কেউ এলেন না কেন? মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী অভিমান করে বসে থাকলেন। আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করার জন্য গাঢ় কালো কালির ‘শেফারস্’ কলম সঙ্গে নিয়ে এসেছেন অরোরা। ‘বিকেল চারটা পঞ্চান্ন মিনিটে সই হয়ে গেল। নিয়াজি সই করার সময় শেফার কলম দিয়ে কালি বেরোল না। দুবার ঝাঁকি দিয়েও কালি বেরোল না। 
নিয়াজির হাত কাঁপছে। 
মাঘ মাসে পুকুরে গোসল করার পর যেমন হয়।
কাগজের ওপর কলম ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়াল। নিয়াজিকে অন্য একটি কলম দেওয়া হলো। কাঁধ থেকে অধিনায়কের ব্যাজ খুলে রাখলেন নিয়াজি। কোমরের বেল্ট খুলে ‘পয়েন্ট থার্টি এইট’ রিভলবার থেকে সব গুলি বের করে অরোরার হাতে তুলে দিলেন। আত্মসমর্পণের পুরনো নিয়ম। নিয়াজির দুই চোখ ঠেলে বেরোচ্ছে পানি। আটকাতে চেষ্টা করলেন না। চোখের পানির ওপর তিনি এখন বিরক্ত। আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে একশ পাকিস্তানি সেনা অফিসার এবং একশো জোয়ান হাতের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখলেন। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান দিল অনেকে।

‘জয় বাংলা’ আর ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’ ধ্বানি উঠল।
রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় নতুন দেশ, বাংলাদেশ।
এদিকে বিজয়ের দিনেও ধানমন্ডিতে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর পরিবার। একটু পর পর ছোট্ট রাসেল শ্লোাগান দিচ্ছে, ‘জয় বাংলা-আ-আ-আ।
বারবার তাকাচ্ছে দরজার দিকে। এই বুঝি আব্বা বাসায় এসে কোলে তুলে নেবে। মার্চ মাসে আটক হওয়ার সময় রাসেলকে বলেছিলেন, আব্বা, আমি যাই। রাসেলের অটুট বিশ্বাস, আব্বা ফিরে আসবেই। একই বিশ্বাস হাসিনা, রেহানার এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির।’
শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক
 
				        
				    






























































