ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৮ মে ২০২৫

পাকিস্তানে হামলা 

ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ : মাইকেল কুগেলম্যান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:০৪, ৮ মে ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক পদক্ষেপ না নেয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হতো বলে মন্তব্য করে কুগেলম্যান বলেন, গত বুধবার (৭ মে) ভারতের হামলাটি ছিল একটি উচ্চমাত্রার শক্তি প্রয়োগ, যা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সামরিক পদক্ষেপ।

পাকিস্তানের প্রচলিত সামরিক শক্তির প্রেক্ষাপটে ভারতের সামরিক বিকল্পগুলো তুলনামূলকভাবে সীমিত’ বলে মন্তব্য করে কুগেলম্যান আরো বলেন, ভারতের এই হামলাগুলো ‘দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে শেষপর্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বলে প্রমাণ হতে পারে, কারণ এর ফলে ভারতের বিরুদ্ধে ‘অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে পারে’’। 

গতকাল বুধবার (৭ মে)  ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের ‘উইকলি সাউথ এশিয়া ব্রিফিং’-এ নিজের লেখায় এমন মন্তব্য করেন বিগত দুই দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির মার্কিন গবেষক মাইকেল কুগেলম্যান।  

গুরুত্ব বিবেচনায় লেখাটি একুশে টেলিভিশনের অনলাইন পাঠকের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো-

পেহেলগামের কাছে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের হাতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়, কারণ ভারত মনে করে এই হামলাকারীদের পেছনে পাকিস্তানের মদদ রয়েছে। ইসলামাবাদ এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

স্থানীয় সময় বুধবার ভোরে ভারত সরকারের এক বিবৃতি অনুযায়ী, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর এবং পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাব প্রদেশে নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালানো হয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই হামলাগুলোতে সামরিক লক্ষ্যে আঘাত হানা হয়নি এবং এগুলো উত্তেজনা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে করা হয়নি।

পাকিস্তান ভারতীয় এই হামলাকে যুদ্ধের পদক্ষেপ বলে নিন্দা জানায় এবং দাবি করে যে, এসব হামলায় একটি মসজিদসহ বেসামরিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু ছিল এবং অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এর পরপরই পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে এবং দাবি করে যে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। নয়াদিল্লি স্বীকার করেছে যে, তাদের দু’টি বিমান ভেঙে পড়েছে, তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

সামরিক পদক্ষেপ না নেয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হতো, কারণ তার সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত এবং পেহেলগাম হামলার নিষ্ঠুরতার কারণে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে ছিল। ভারত তার শক্তি প্রদর্শনের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল এবং সম্প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সিভিল ডিফেন্স মহড়া দিয়েছে।

আগামী দিনগুলোতে সঙ্কটের সামরিক দিকগুলোর ওপর নজর থাকবে সবার। ভারতের এই হামলা ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক উচ্চমাত্রার শক্তি প্রয়োগ—যা সম্ভবত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সামরিক পদক্ষেপ। তবে এই হামলাগুলোকে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখা উচিত, যার লক্ষ্য হল সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের সমূলে নির্মূল।

পেহেলগাম হামলার পর থেকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অসামরিক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, যেগুলোর কিছু ছিল নজিরবিহীন। নয়াদিল্লি ইসলামাবাদ থেকে সব ধরনের আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে, এমনকি তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আসা বাণিজ্যও বন্ধ করেছে; দুই দেশের একমাত্র স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং প্রথমবারের মতো সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, যা একটি আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনা চুক্তি।

ভারত পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক অর্থদাতাদের কাছ থেকেও চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে যাতে তারা পাকিস্তানের প্রতি সহায়তা কমিয়ে আনে এবং সম্ভবত একটি প্রভাবশালী বৈশ্বিক সন্ত্রাস অর্থায়ন পর্যবেক্ষক সংস্থার মাধ্যমে ইসলামাবাদের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবে। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে লক্ষ্য করে পানির ঘাটতিকে কাজে লাগিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মহলে তাকে একঘরে করে নয়াদিল্লি দীর্ঘমেয়াদী খেলায় নামছে—যার লক্ষ্য হল ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ার মূল্য ইসলামাবাদকে চুকাতে বাধ্য করা।

ভারতের এই বহুমুখী চাপ প্রয়োগের কৌশল সম্ভবত এই উপলব্ধি থেকে এসেছে যে পূর্বের সীমিত সামরিক প্রতিক্রিয়াগুলো সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের লাগাম টানতে যথেষ্ট ছিল না। উপরন্তু, পারমাণবিক প্রতিরোধ এবং পাকিস্তানের প্রচলিত সামরিক শক্তির প্রেক্ষাপটে, ভারতের সামরিক বিকল্পগুলো তুলনামূলকভাবে সীমিত—যা বুধবারের পদক্ষেপের মতো নির্দিষ্ট এবং নিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

তবে শেষপর্যন্ত এই দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্য এমনিতেই সীমিত ছিল, তাই সেটি বন্ধ করলেও বড় অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে না এবং পাকিস্তানকে একঘরে করাও সহজ হবে না, কারণ চীন ও সৌদি আরব তার ঘনিষ্ঠ মিত্র, আর যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুরস্কের মতো প্রভাবশালী বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গেও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তান এমন বহু বহুপাক্ষিক ফোরামে অংশ নেয় যারা তার পক্ষে দাঁড়ায়।

যেসব ক্ষেত্রে ভারত সত্যিই ক্ষতি করতে পারে—যেমন দীর্ঘমেয়াদী পানি নিয়ন্ত্রণমূলক অবকাঠামো নির্মাণ—তা ইসলামাবাদকে আরও ক্ষুব্ধ করতে পারে এবং সে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ সরাসরি সন্ত্রাসীদেরও উস্কে দিতে পারে। পাকিস্তানভিত্তিক আতঙ্কের কারণ হিসেবে পরিচিত লস্কর-ই-তৈয়বা অতীতে ভারতের ‘পানি চুরি’র অভিযোগ তুলে ভারতের বিরুদ্ধে হামলার হুমকি দিয়েছে।

মূল বিষয়টি হল, চার বছরের আপাত শান্তির পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন এক গভীর শীতলতায় প্রবেশ করছে।

দুই দেশের মধ্যে এখনই সীমিত সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি রয়েছে—তবে এর বাইরে ভারতের এক বহুমুখী প্রেসার ক্যাম্পেইনের মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছে পাকিস্তান, যার লক্ষ্য হল এমন এক সন্ত্রাসী হুমকিকে দমন করা, যা ভারত এতদিনেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

এসএস//
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি