ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

ভোরের প্রিয়...

শায়লা শারমিন শুভ্রা

প্রকাশিত : ২০:৩১, ২৮ অক্টোবর ২০১৯ | আপডেট: ২০:৪৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৯

মানুষ প্রিয় প্রিয় করে হেঁদিয়ে মরে। কেন করে? ইহাই বুঝে আসে না ছোট্ট ভোরের। নির্দিষ্ট একটা কিছু প্রিয় হবে কেন? এই যে বসন্ত কত ফুল নিয়ে আসে। কত্ত ভালো লাগে। হেমন্ত কাঁচা ধানের ম-ম গন্ধ, ভেজা খড়ের মিষ্টি ঘ্রাণ দিয়ে মাতাল করে দেয় পরিবেশ। শীত আসে মায়াবী রঙয়ের কুয়াশা নিয়ে। গ্রীষ্মের কাট ফাটা রোদ, অসহ্য গরম-এদের মাঝে এক তীক্ষ্ণ ব্যাপার আছে। বর্ষা নূপুর পায়ে রুনুঝুনু ছন্দে মেতে উঠে টিনের চালে। কখনো বা সেতার বাজায়। শরৎ সে এক বিশাল মুগ্ধতা। মেঘেদের দল ঘুরে বেড়ায়। স্বচ্ছ শাদা নীল আকাশ। সবই মুগ্ধ করে ভোরকে। তার কাছে যা ভালো লাগে, সবই প্রিয়।

ছোট্ট ভোর প্রকৃতির মাঝে অন্য রকম সৌন্দর্য খুঁজে পায়। যা অন্য কোথাও পায় না। ভোর পড়তে ভালোবাসে।

একবার ক্লাসে শিক্ষক সবার শখ জানতে চাইল। অনেকেই বলল- বই পড়া। তা শুনে ভোর চিন্তিত। বই পড়া কারো শখ হতে পারে? বই পড়া তো অভ্যাস, ভালোবাসা। এক ধরনের মায়া। শখ হয় কিভাবে? না, তার শখ বই পড়া হতে পারে না। তাহলে বাগান করা? ধুরররর..! প্রকৃতি তো আমার প্রাণ।

সব জায়গায় বাগান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওই যে অপরিত্যক্ত কোণটায় কত কত বন্য ফুল ফোটে আছে। ওটাও তো বাগান। কে যেন বলছিল এই ফুলের নাম ভৃঙ্গরাজ। নামটা এমন হলো কেন?এসব ভেবে সে কূল -কিনারা পায় না। একে একে শিক্ষক যখন বলল- ভোর তোমার শখ কি? সে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শখ কি? খুঁজে পাচ্ছে না। সবাই হাসাহাসি শুরু করল। ভাবনার জগতে ডুবে থাকা দরুন মন খারাপ হল না।

৬ষ্ঠ শ্রেণি। মা হাতে তুলে দিলেন, লরা ইঙ্গেলস ওয়াইল্ডারের "তেপান্তরের ছোট্ট শহর"। বইটা পড়ছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। বরফের শহর, খামার বাড়ি এমন ভাবে ঢুকেছে ভোর বই থেকে বের হতে পাচ্ছে না। ভোর মেরিকে নিয়ে খামার বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কল্পনায়। হ্যারি পটার পড়ে সে মুগ্ধ। বাসন ভূত আরো কত কিছু। ভোর খেয়াল করল, সে খুব মুগ্ধ হয়। কাউকে মুগ্ধ হতে দেখলেও মুগ্ধ হয়।

দশম শ্রেণি পড়ুয়া ভোর। চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজাখুজি রেখে সে থমকে দাঁড়াল তার ছোট্ট লাইব্রেরিটার সামনে! এই যে রবী বাবু, শরৎ বাবু কেউ থাকে দখল করতে পারেনি। তা একমাত্র পেরেছে "আরণ্যকের বিভূতিবাবু। মনে মনে হাসল একটু। আরণ্যক পড়ে কতবার সে সত্যচরণ হয়েছে। যোগল প্রসাদ হয়েছে। স্বরস্বতীকুন্ডী ঝর্ণার  কাছে বসে কাটিয়ে দিয়েছে কত রাত। তিন গোয়েন্দা,মাসুদ রানা-সব হজম করেছে উপভোগ্য করে।

কলেজে এসে পরিচয় হল শীর্ষেন্দু, সমরেশ, বুদ্ধদেব বসু, গুহ, ম্যাক্সিম গোর্কি..... কত্ত কত্ত লেখা কারিগরদের সাথে! এই পৃথিবীতে এত্তো ভালো ভালো বই আছে। না পড়তে পেয়ে ভোর নিজেকে অপারাধী ভাবে। এই অর্ধেক জীবন ভোর বই আর প্রকৃতিতেই কাটিয়ে দিল!

শীর্ষেন্দুর পার্থিব বইয়ের জুটি অর্পণা-মনিশ। মনিশের শরৎ প্রীতি দেখে, ভোর শরৎ নিয়ে ভাবছে। ভোর অবাক হয়ে ভাবছে। আরেহ! এ তো শরৎ কাল। শরৎ এর বিকাল এতো সুন্দর। আকাশে দেখি পাখির সমাবেশ। ভোর ভাবছে এই পাখি সমাবেশের প্রধান কে? মেইন থিম কি?

আবির মাখা সন্ধ্যা। রাত এলিয়ে এলো। আকাশ মেঘে ছেঁয়ে গেল। একটা তারা দেখা যাচ্ছে মেঘের ফাঁকে। বইয়ে এসে মুখ লুকালো। শেষ রাতে ভোর আকাশ দেখতে ব্যালকনিতে। আকাশ ভরা তারা। একি! তারাদের সমাবেশ।

সকালে ভোর বিশাল একটা মাঠে বসে আছে। চারপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছ। অসময়েও কয়েকটা কৃষ্ণচচূড়া ফুল ফুটে আছে। জুলাইয়ে এসে কৃষ্ণচূড়া বিদায়ের তোরজোর শুরু করে। এই ফুলটা কে ভোর অবচেতন মনেই একটু বেশি আদিখ্যেতা দেখায়। সে নিজেও তা জানে না।

কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক  নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। বৃক্ষ  জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছ চমৎকার পত্র-পল্লব এবং আগুনলাল কৃষ্ণ  পাপড়িরর জন্য জনপ্রিয়। এটি ফ্যাবেসি পরিবারে অন্তর্গত একটি বৃক্ষ যা গুলমোহর নামেও পরিচিত।

হঠাৎ করেই কৃষ্ণ -রাঁধার ধাঁধাঁ রেখে চোখ বুলালো আকাশে। মুগ্ধ হয়ে ভোর ঘাস ফড়িংয়ের সমাবেশ দেখছে। শরৎকালে এতো কিছুর সমাবেশ। মেঘেদেরও সমাবেশ। তাদের নিজস্ব ভাষা গুলো জানতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ  আকাশ কেঁদে উঠল। ধুত্তুরি। ইচ্ছের ডানায় আগুন লাগুক। ভিজে গেলাম।

ওমা! রোদ। আকাশ হেসে উঠল। চমৎকার তো! হঠাৎ হাসি-হঠাৎ কান্না। "হঠাৎ বৃষ্টি" সিনেমার কথা মনে পরে গেল। কোন এক সময় রাজস্থান যেতে হবে। ভাবনা মাথায় আসতেই হাসি পেল। কত ভাবনা তার। কত ইচ্ছে। কেউ জানে না। জমানো কথা, ভাবনা, ইচ্ছে এই মস্ত আকাশে ভাসিয়ে দেয়। সেই কথারা কখনো গোলাপি রংয়ের হয়, তেজ পাতা রঙেরও হয়.....কত্ত রং!

আপন মনে হাসতে হাসতে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে লাগলো। এই প্রথম সে শরৎ বিলাস করছে অন্য রকম ভাবে। ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে গেল। প্রিয়? তার প্রিয় কিছু নেই। তাহলে কি শরৎ আমার প্রিয় হতে যাচ্ছে? ওমা! এখানে যে কাশফুলদেরও সমাবেশ! এত্তো সমাবেশ। মুগ্ধ হয়ে ভোর আকাশ দেখল। কি আশ্চর্য। আকাশের এক কোণে মেঘেদের রাজ্যের পাশে কাশবন যে!

এই প্রথম ভোর আনমনে বলতে লাগলো, কি শান্তির শরৎ বিলাস। প্রিয় শরৎ!

নিজেই চমকে গেল ভোর। প্রিয়?

মৌন হেসে রায় দিল- উমমমম প্রিয়। একমাত্র এই শরৎ পরিপক্বতার হাসি হাসতে পারে এবং কাঁদতে পারে।

লেখক: শায়লা শারমিন শুভ্রা, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি