ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

ম্যাট হ্যানককের ‘চুমু’ আর হানিফের ‘চোমু’

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১৩:৪৮, ৩ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৫:৪৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক ও তার সেই সহকর্মী জিনা

ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক ও তার সেই সহকর্মী জিনা

ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্যটা ভালো গেল না গত সপ্তাহে। নিজ সহকর্মী জিনাকে করোনা বিধি ভঙ্গ করে চুমু খাওয়ার বিব্রতকর কাণ্ডে বেচারা চাকরী হারিয়েছেন। শুধু চাকরী নয়, তিন সন্তানের এই জনক এখন ডিভোর্সের সম্মুখীন।

না না, ও তো আর মধ্যরাতে কোনও বোট ক্লাবে গিয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদাকে ব্যবহার করে চুমু খায়নি। অফিসের প্রাঙ্গণে সারাদিনের কর্ম ক্লান্ত শরীরে একটু উষ্ণতা আনতে ব্যক্তি স্বাধীনতা ব্যবহার করে জিনাকে চুম্বনের লকডাউনে আলিঙ্গন করেছেন। লিপস টু লিপস-এর এই মুহূর্তটি বাংলা ছবির রহিমা খালা ‘সিসি টিভি’র চোখে আটকে যাওয়াতেই বিপত্তিটা ঘটলো।

দু’জন নর-নারী পরস্পরের সম্মতিতে একটু ওষ্ঠিয় উষ্ণতা ভাগাভাগি করে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনবেন, তাতে কার পাকা ধানে মই পড়লো রে বাপু! বলি, মানুষ এতটা হিংসুটে হয় কি করে! ব্রিটিশরা কি চুমু খায় না তাদের বান্ধবীদের!

কই মনিকা লিউনেস্কি কাণ্ডে ক্লিনটনের তো কিছুই হয়নি। সে তো দিব্যি তার মেয়াদ পুরো করে তবেই না হোয়াইট হাউস ছেড়েছে। এতে হোয়াইট হাউসের শ্বেত রং এতটুকুও ম্লান হয়নি। যদিও আমরা জানি না যে, হিলারীর নরম হাতের চড় খেয়ে ক্লিনটনের গাল কতটুকু লাল হয়েছিলো! 

সে না হয় বড়দের ব্যাপার, তারা জানেন- কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক। তবে ব্রিটিশরা খেপেছে আদতে চুমু’র ব্যাপারটির জন্য নয়, বিষয়টি স্থান-কাল-পাত্রের বিষয় বলে। কেননা, করোনা স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করেছেন মন্ত্রী মহাশয়। উনি সবাইকে বলছেন, ‘মাস্ক পরুন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন, এটা করুন, সেটা করবেন না...’ ইত্যাদি, আর নিজেই কিনা টুক করে চুমু দিলেন লজ্জার মাথা খেয়ে।

নিয়মনীতির ব্যাপারে খুঁত খুঁতে ব্রিটিশ জাত খেপেছে ওই ‘নিয়ম’ ধর্ম লংঘন হয়েছে বলে। তুমি মন্ত্রী বলে নিয়মকে তো আর জামালপুরের ডিসির খাস কামরায় ঢুকিয়ে দিতে পারো না। তুমি তো আর প্রাচ্য দেশের কর্পোরাল হানিফ নও যে, কাস্টমস এন্ড ইটিকেট সম্পর্কে ধারণা থাকবে না!

পাঠকদের এ পর্যায়ে একটু হানিফের কাছে নিয়ে যাই। ১৯৯৩ সালের গল্প এটা। আফ্রিকার মোজাম্বিক মিশনে নিয়োজিত আমাদের ইউনিট। তখনকার আমাদের সাধারণ জ্ঞানের যে অবস্থা, তাতে মোজাম্বিক নামে যে একটা দেশ পৃথিবীতে আছে- এটাই তো জানতো না অধিকাংশ সৈনিক।

সাবেক পর্তুগীজ এই কলোনীর ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা খুবই সীমিত। ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী দেশটার সর্বত্র ছোট বড় নানা নামের চার্চ বা গীর্জা। যাইহোক, আমাদের ইউনিটের একটি টহল দল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ব্যাটালিয়ন সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে একটা চার্চের সামনে বিশ্রামের জন্য বিরতি দিলো। লাঞ্চটাও সেরে নিয়ে যাত্রা করবে আবার। 

প্রাচীন একটা চার্চ। চার্চের মূল ভবনটা, মানে যেখানে রোববারের সমাবেশটা হয়, তা প্রায় শত ফিট লম্বা। চার্চের এক পাশে এবং পেছনে লাল টালীর ঘর। এগুলো চার্চের যাজক, নান, সেবা কর্মীদের আবাস স্থল।

পুরো প্রাঙ্গণটা লাল সুরকির মতো ছোট ছোট নূড়ি পাথরে ঢাকা। মূল ভবনের সামনে একটা বেদীর ওপর মেরীর একটা প্রস্তর মূর্তি। বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে কাজুবাদাম গাছের বাগান চারপাশে। বেশ ছোট জাতের গাছ এগুলো। নীচটা অনেক শীতল, বিশ্রামের জন্য আদর্শ জায়গা। তিনটে গাড়ীতে জনা বিশেক শান্তিরক্ষীর দল বিশ্রামের জন্য এ স্থানটিকেই বেছে নিলো।

কর্পোরাল হানিফ এই দলেরই একজন সদস্য। বিশ্রামরত সৈনিকদের কেউ কেউ এদিক সেদিক ঘুরে ছবি তুলতে লাগলো। হানিফ বেটাও ছিলো চার্চের পিছন দিকটায়। হঠাৎ তার সামনে পড়লো এক তরুণী নান। ধুসর রংয়ের আজানু লম্বা স্কার্ট। কোমরে সাদা চওড়া বন্ধনী, মাথাটা সাদা কাপড়ে আবৃত। গলায় ঝোলানো  ক্রুশবিদ্ধ যিশুর লকেট দৃশ্যমান।

দূর থেকে তাকে দেখে কৌতুহলভরে এগিয়ে গেল হানিফ। কাছাকাছি আসতেই নানের নজরে পড়লো সে। তাকে দেখে তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। নানরা তো হাসবেই- শান্তি আর ঈশ্বরের ভালোবাসার বাণী তো আর গোমড়া মুখে হয় না।

দীর্ঘ দিন স্ত্রী-সংসর্গ বিবর্জিত হানিফের মধ্যে তরুণী নানের সেই হাসি একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটালো। কুষ্টিয়ার হানিফ করলো তার উল্টো অর্থ। নান তার সামনে আসতেই হানিফ তাকে ‘গুড মর্নিং’ বলে সম্ভাষণ করলো। যদিও সকাল অনেক আগেই গত হয়েছে। কিছুটা কৌতুহল নিয়ে নানও মুচকি হেসে জবাব দিলো, ‘গুড আফটার নুন স্যার’।

উনি বুঝলেন, ঈশ্বরের এই নাদান সন্তানটির ভালো করে ব্যাপটাইজম হয়নি। নান তার দিকে হাত বাড়াতেই হানিফ তার হাতে করমর্দন করলো। নানের ফর্সা ও তুলনামূলক নরম হাতটি হাতে নিয়ে সদ্য শেখা পুর্তগীজ ভাষা প্রয়োগ করলো সে, ‘আমিগো কমোস্তা’? (বন্ধু, কেমন আছো?)

সেইসঙ্গে হাতটি ঈষৎ দোলাতে দোলাতে কব্জির উল্টো পিঠে চুম্বন করে বসলো হানিফ। নান ভাবলেন, এসবই বুঝি দূর প্রাচ্যের সৌজন্যতা! আর হানিফ বুঝলো, সিনেমা-টিভিতে দেখা বৃটিশ সৌজন্য প্রদর্শন আরও বাকি আছে। বিমানবন্দরে দেখা রাষ্ট্র প্রধানের অতিথি বরণের মতো করে তার ডান গাল দিয়ে নানের ডান গাল স্পর্শ করলো। একইভাবে বাম টু বাম।

তখনও নানের মুখে কষ্টকর শুভেচ্ছার হাসি স্পষ্ট। কিন্তু এরপরই ঘটলো সেই হ্যানকক কাণ্ড! নানের পরিচিত পৃথিবীকে উল্টে দিয়ে হানিফ টুক করে নানের পাতলা দু’ঠোঁটে একে দিলো এক মহা কেলেঙ্কারির চুমু!

এই মহা কেলেঙ্কারি চুমুর সুনামি ঢেউ আছড়ে পরলো UNUMOZ' র নর্দার্ন রিজিয়ন হেডকোয়াটারে- অতঃপর ব্যাটালিয়ন সদরে। তদন্ত দলের সামনে হানিফ সকল দোষ স্বীকার করলো লিখিতভাবেই- ‘আমি কর্পোরাল হানিফ গত ... তারিখে টহলে যাই এবং টহল থেকে ফেরার পথে খৃষ্টানদের গীর্জায় বিশ্রাম করি। ... আমি একজন সিস্টারের দেখা পাই ... আমি তাকে ‘হাই হেলু’ বলি, তার সাথে ‘হেন্ডসোক’ করি এবং তার ‘মোখে চোমু’ দেই।

চুমু দেবার এই নিয়ম সে কোথা থেকে পেলো- তদন্ত দলের এমন প্রশ্নে হানিফের সরল জবাব- ‘যে দেশি যেরাম সিস্টিাম আমি সেরাম করেছি’।

ইউনিটে হানিফের নামের শেষে ‘স্ক্রু ঢিলা’ টাইপ একটি ট্যাগ আগে থেকেই চালু থাকায় এবং স্থানীয় আচারণ বিধি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় কর্পোরাল হানিফ শাস্তি স্বরূপ ব্রিটিশ মন্ত্রীর মতো পদবী হারিয়ে ‘শুধু হানিফে’ পরিণত হয়। তবুও সে জাতিসংঘ মিশনে টিকে থাকে।

ব্রিটিশ মন্ত্রী হ্যানকক ‘চুমু’ খেয়েছে from the position of power and authority থেকে। আর প্রাচ্যের হানিফ ‘চোমু’ খেয়েছে  from the platform of ignorance থেকে। তবে ম্যাট হ্যানককদের লজ্জা আছে তাই পদত্যাগ করেছে, কিন্তু আমাদেরগুলারে তো জুতা দিয়া পিটাইলেও জুতার অসম্মান হবে! 

লেখক- অব. সেনা কর্মকর্তা

এনএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি