ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

শশ্মানবাসী থেকে ‘মাদার অব থাউজেন্ড অরফানস’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:২৪, ১০ মে ২০২০ | আপডেট: ১৭:৫৩, ১০ মে ২০২০

সিন্ধুতাই শেপকাল

সিন্ধুতাই শেপকাল

দিকশূন্য জীবনে একদিন এক মরণাপন্ন এক ভিখারিকে জল পান করিয়েছিলেন। সে সময় নিজেও ছিলেন একই পরিচয়ের ভাগীদার। ঘুরে যায় জীবনের চাকা। সেদিন সমাজসেবাকেই বেছে নিলেন জীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে। যা বিশ্বে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলো ‘মাদার অব থাউজেন্ড অরফানস’ হিসেবে।

চার ক্লাসের পর আর স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি তার। যে নরম হাতে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর কথা, দিন যেতো সেই হাতেই গরু-মহিষ চরিয়ে। মাত্র দশ বছর বয়সে বিয়ে হলো ত্রিশ বছরের যুবকের সাথে। ১৯ বছর বয়সে হলেন তিন সন্তানের জননী। আর এ সময়েই ঘটলো জীবনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা। 

যৌতুকের পণ দিতে না পারায় স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হলেন তিনি। হলেন দুশ্চিরিত্রা হিসাবে বদনামের ভাগীও। নির্মম প্রহারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মূর্ছা গেলে- মারা গেছেন বলেই মনে করেছিলো স্বামী। গোয়ালঘরে যখন তাকে টেনে-হিঁচড়ে আনা হলো তখনও তিনি সন্তানসম্ভবা। অতঃপর সেই গোয়ালঘরেই প্রসব হয় তাঁর কন্যা সন্তান। নিজের নাড়ী নিজেই কাটেন।

স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হলেন। বাপের ঘরে আশ্রয় মিললোনা। সমাজে ঠাঁই হলোনা। আশ্রয় নিলেন শশ্মানে। খাবার জুটতো শশ্মানে। শবদেহ পোড়ানোর পর যা কিছু খাবার ছিটিয়ে দেয়া হতো, সেসব খেয়েই ক্ষুধা নিবৃত হতো। সমাজে বের হতে চাইলে ‘শশ্মানের ভূত’ বলে মানুষ মা আর মেয়েকে তাড়িয়ে দিতো।

ডাক্তার মেয়ে ও সেই ছেলের সঙ্গে সিন্ধুতাই শেপকাল

জীবন থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করার জন্য রেললাইনে শুয়ে থাকলেন। রেল এলোনা। তিনি জানতেন না- সেদিন রেল ধর্মঘট। শ্মশানে ফিরে আসলেন। মেয়ে বুঝতে পারে- মা তাকে নিয়ে মরতে চাচ্ছে। সে পালাতে চায়। পরের সপ্তাহে আবার মেয়েকে আঁচলের সাথে বেঁধে শুয়ে পড়লেন রেললাইনের ওপর। এমন সময় শুনতে পান প্রচণ্ড কান্নার শব্দ। কী যেন মনে করে মাথা তুলে দেখেন, গাছের নীচে বসা একটা শিশু আর্তনাদ করে কাঁদছে।

তিনি দেখেন, গাছের একটি ডাল কোনো রকমে ভেঙে পড়তে পড়তে গাছের সাথে লেগে আছে। সেই ভাঙ্গা ডালেই আবার পাতা হয়েছে। ফুল ফুটেছে। সেই ভাঙ্গা ডালের ছায়ায় বসে ছেলেটি কাঁদছে। তিনি ভাবলেন, ভেঙ্গে যেতে যেতেও টিকে থাকা গাছে যদি পাতা গজায়, ফুল ফোটে, সেই ভাঙ্গা ডাল আবার ছায়া দিয়ে মানুষকে আশ্রয় দেয়, তবে তার এই জীবনটা কি শুধুই অর্থহীন। এগুলো কী বিশেষ কোনো ইংগিত!

এক হাতে সেই ছেলে আরেক হাতে মেয়েকে নিয়ে তিনি রেলস্টেশনে ফিরে এলেন। ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খাওয়ালেন। অনেক খুঁজেও কাজ পেলেন না। স্টেশনে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করা শুরু করলেন। তা দিয়ে যত টাকা আয় হতো সেগুলো দিয়ে খাবার কিনে রাতে রান্না করেন, শিশুদুটোকে নিয়ে খান। রেলস্টেশনে ঘুমিয়ে থাকা অন্যান্য শিশুদের নিয়ে এসেও খাওয়ান, ঘুম পাড়ান। দীঘীতে নিয়ে গিয়ে গোসল করান। পিতামাতাহীন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিশুগুলোও যেন- খুঁজে পায় মাকে। মাতৃত্বের চির শ্বাসত রুপ- তাকে আরো মানবীয় করে তোলে।

এর মাঝে ঘটে আরেক ঘটনা। একটি ব্রিফকেস খুঁজে পেয়ে স্টেশন মাস্টারের অফিসে জমা দেন। লোকটি ভালো মানুষ ছিলো। কয়েক সপ্তাহ পর- এক লোক দেখা করতে এসে তাকে উপহার দিতে চায়। তিনি বলেন, কোনো উপহার চাইনা। শুধু আমার শিশুদের নিয়ে থাকার জন্য একটা ঘর বেঁধে দেন। শুরু হলো তার জীবনের আরেকটি অধ্যায়। এতিমদের নিয়ে থাকার একটা ঘর পেলেন। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শিশুদের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা দেখে অন্যান্য মানুষও এগিয়ে এলো। ঘর বড় হলো। যাদের পৃথিবীতে আর কেউ নেই, সেইসব শিশুরা তাঁর কাছে আশ্রয় পেলো। এতিম শিশুরা খুঁজে পেলো নতুন এক মা। এভাবেই কেটে গেছে অনেকদিন। প্রায় হাজার খানেক এতিমের ঠিকানা হলো তাঁর এতিমখানায়।

একদিন দেখেন একজন বৃদ্ধ, জীর্ণ শীর্ণ লোক- তার কাছে এসে আশ্রয় চাইছে। ভাত, রুটি যাই থাকুক না কেন একটু খাবার চাইছে। বৃদ্ধ লোকটিকে তিনি আশ্রয় দিলেন। গোসল করালেন। গায়ের জামা বদলে দিলেন। খাবার খাওয়ালেন। একটা মেয়ে ডাক্তার এসে তার শরীর চেক করে ঔষধ খাইয়ে গেলো। বৃদ্ধ লোকটি তাকে চিনলোনা। কিন্তু তিনি নিজে চিনতে পেরে বললেন, একদিন তুমি এক সন্তানসম্ভবা মেয়েকে মেরে গোয়ালঘরে ফেলে রেখেছিলে। কিন্তু বিধাতার কি নিয়ম দেখো- আজকে তুমি সেই মেয়ের কাছেই আশ্রয়ের জন্য এসেছো। শশ্মানে শবের অপেক্ষায় থেকে দুমুঠো খাবারের জন্য যার জীবনে কেটেছে- সে জানে ক্ষুধার দুঃখ কি। সে জানে- মাথার উপর একটু আশ্রয় প্রাপ্তির সুখ কি। তাই তুমি সব কিছুই এখানে আমার কাছে পাবে। কোনো অবহেলা পাবেনা। তবে তুমি আর আমার স্বামী হিসাবে না, বরং আমার সন্তান হিসাবেই এখানে থাকবে।

নানা পুরস্কারে ভূষিতও হন সিন্ধুতাই শেপকাল

তিনি সিন্ধুতাই শেপকাল। এখন ২৪৩ জন ছেলে-মেয়ের শাশুড়ি। তাঁর নাতি নাতনির সংখ্যাও ১০৫০। ‘মি সিন্ধুতাই শেপকাল’, আমি সিন্ধুতাই শেপকাল নামে তাঁর জীবনী নিয়ে মারাঠি ছবি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। পুরো বিশ্ব থেকে তিনি নানা সম্মান, খ্যাতি এবং প্রায় ৭৫০টি নানা রকমের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ‘মাদার অব থাউজেন্ড অরফানস’ লিখে সার্চ করলে- এই মহীয়সী নারী সিন্ধুতাই শেপকালকে নিয়ে লেখা অসংখ্য আর্টিকেল উঠে আসে। 

গোয়াল ঘরে জন্ম নেয়া তাঁর মেয়েটি চিকিৎসক হয়ে এখন সব এতিমের চিকিৎসা সেবা দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। তাঁর এতিমখানা থেকে শত শত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে শুধু ভারতে না, বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। 

এবার করোনার এই ডিজেস্টারের সময় যাতে একজন মানুষও তার এলাকায় অভুক্ত না থাকেন- তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন এই মহীয়সী নারী। বিবিসির সাংবাদিককে বলেন- বড় চিকিৎসক, বড় প্রযুক্তিবিদ হওয়া অবশ্যই ভালো। কিন্তু এসব না হলে যে মানুষের সেবা করা যায়না- তা ঠিক নয়। চারপাশ থেকে যা পেলাম তা শুধু নিজের করেই নিলাম- এরকম মানুষ যতবড় বিত্তশালী হোক না কেন, তাতে সমাজের কোনো লাভ হয়না। মানুষের সেবা করার জন্য সুন্দর একটা ত্যাগের মন থাকাটাই যথেষ্ঠ। গহনা, অলংকার, পোষাক পরিচ্ছেদের কথা বলতে গিয়ে হেসে বলেন- মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে বড় অলংকার আর কিছুই নেই। সততার চেয়ে দামি পরিচ্ছদও আর নাই।

১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা-র এক মেষপালকের ঘরে জন্ম এই মহীয়সী নারীর। আজও বিশ্বাস করেন, ত্যাগের একটা ছোট মুহূর্তও জীবনের বড়ো সঞ্চয় হতে পারে। এক গাল চওড়া হাসিতেই তিনি ট্রেন্ডি। সুন্দর জামাকাপড় বা অলঙ্কার বলতে তাঁর কাছে জায়গা পায় মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুন্দর মনটা, এই জগৎ-এর এক অনন্য সৃষ্টি। এতো সুন্দর চিন্তা, ভাবনাকে সালাম। হাজার এতিমের জননী আপনাকে হাজারো সালাম।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি