ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

শহীদ মিনার রক্ষায় এক সাংবাদিকের যুদ্ধ

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৩:৫০, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

একটি বিশেষ দিনেই কেবল ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘শহীদ মিনার’ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়ে থাকে। এরপর সারা বছর পবিত্র স্থানটি থাকে অবহেলায় অরক্ষিত এবং অপরিচ্ছন্ন। দেশের অধিকাংশ শহীদ মিনারের এমন অবস্থা থাকলেও মহান শহীদদের রক্তের পবিত্রতা রক্ষায় ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের জন্মভূমি এলাকা সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার গোপিনাথপুরে নির্মিত শহীদ মিনারটি একেবারেই ব্যতিক্রম।

একটি গণমাধ্যমের সাধারণ কর্মী মানবতাবাদী ভূমিহীন স্বপন মির্জার এই শহীদ মিনারটি দৃষ্টিনন্দন পরিচ্ছন্ন। এলাকার সকলকে ভালো কাজে উৎসাহিত ও মানবিক কল্যাণে কাজ করা স্বপন মির্জাসহ গ্রামবাসী এর পবিত্রতা রক্ষা করেন পরম ভালবাসায়। তাই শহীদ মিনারটি দেখলে যে কেউ অবাক হবেন।

এদিকে এ শহীদ মিনার দেখভালের জন্য রয়েছে আলাদা রক্ষণাবেক্ষন কমিটি। তাদের তত্বাবধানে শহীদ মিনারটি প্রতিদিন ২ বার ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে সপ্তাহে অন্তত ৩ বার পানি দিয়ে ধৌত করা হয়। ফুলের সমারহ ঘেরা এই শহীদ মিনারটি এখন পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অন্যদের জন্য হতে পারে অনূকরণীয়।     

স্বপন মির্জা পেশায় একজন সাধারণ সংবাদ কর্মী। একুশে টেলিভিশনের সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে টেলিভিশনে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে কাজ করছেন। জেলার এনায়েতপুর থানার গোপিনাথপুর গ্রামে অভাব কষ্টে বড় হওয়া স্বপন মির্জা (৩৮) ছোট বেলা থেকেই মানবতার কল্যানে ভালো কাজ নিয়ে নিবেদিত রয়েছেন। ২০০২ সালে সাংবাদিকতা শুরুর পর টেলিভিশন ও পত্রিকায় তার প্রকাশিত সংবাদ আলোচিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এ জন্য সেরা প্রতিবেদক হিসেবে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে পুরস্কারও পেয়েছেন।

তবে এই মানুষটি এনায়েতপুর থানা জুড়ে নানা ভাল কাজের উদ্যোক্তা হলেও নিজের নেই ঘটি-বাটি। সাংবাদিকতার মহান আদর্শকে বুকে লালন করা স্বপন মির্জা বিবাহিত জীবনে ৬ বছরের একটি ছেলে সন্তানের জনক। থাকার জন্য নিজের নেই কোন ঘর-বাড়ি। থাকেন এক বাড়ির আশ্রিতা হয়ে দীর্ঘ দিন ধরে। তার বাবা দরিদ্র একজন কৃষক। ছোট ভাই সুজন মির্জা টিউশনী করে মাস্টার্স পাশ করেও বেকার। কোন রকমে চলে সংসার। সাংবাদিকতার চাকুরিতে যে সম্মানী পান তাই দিয়ে কোন রকমে সংসার চালানোর পাশাপাশি মানবিক কল্যানে রাখেন ভূমিকা। 


শহীদ মিনার পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করছেন স্বপন মির্জা

এছাড়া অতটা আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও এলাকার কবরস্থান, ঈদগাহ মাঠ নির্মাণসহ ধর্মীয় নানা কাজে উদ্যোক্তা হয়ে পাশে থাকেন। কোন-কোন সময় রাস্তা নির্মাণে নিজেই মাথায় নেন টুকড়ি বোঝাই মাটি। পাশাপাশি দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা বিতরণেও এলাকার ভিখারী, সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করে শীত বস্ত্র বিতরণ, বন্যায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, ঈদে দুঃস্থদের পোশাক ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণে ভূমিকা রাখছেন। এলাকায় অসহায় ভিখারী ও শ্রমজীবিদের সামাজিক ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করেও তিনি সম্মানিত করছেন।

সমাজকর্মী স্বপন মির্জার অন্যতম উদ্যোগ গোপিনাথপুর গ্রামে শহীদ মিনার নির্মাণ। ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই বাঁশ ও কলাগাছের ক্ষণিকের শহীদ মিনারই শহীদদের স্মরণে ভরসা ছিল এলাকার মানুষের। ২০১৩ সালে এখানে ফুল দিতে গিয়ে সবাই দাবি করে বললেন, একটি শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য। সামর্থ না থাকলেও ভালো কাজে হা বলতে পারা স্বপন মির্জা স্বীকার করেন। পরে ২০১৪ সালের জুনের দিকে থাকার ঘর করার জন্য গচ্ছিত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন এ কাজ। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে একুশে ফোরাম সিরাজগঞ্জের সভাপতি ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান তালুকদার তার হাতে তুলে দেন ৩০ হাজার টাকা, ঢাকার বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না ৫ হাজার, এলাকার ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন দেন ১৫ হাজার টাকা। 

আরো কিছু টাকা যোগ করে তিনি প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন স্বপ্নের শহীদ মিনার। যা এলাকার কৃতি সন্তান ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পুরোধা ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু ৪ অক্টোবর হঠাৎ তার মৃত্যু হলে ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর ভাষা সৈনিক মতিনের স্ত্রী গুলবদন নেছা মনিকাসহ  স্থানীয় ২ জন এমপি এ শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। এসএস পাইপের মিনার ও মূল্যবান টাইলস দিয়ে বেদী মোড়ানো কাঠামোর শহীদ মিনারটি দেশের মধ্যে আসলেই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। ১২ ফুট প্রস্থ ও ১৪ ফুট লম্বা এ শহীদ মিনারটি ছোট হলেও এর অনন্য স্থাপত্য শৈলী যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। 

এছাড়া গত ২ বছর আগে আরও সাড়ে ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে শহীদ মিনারটির নিরাপত্তা প্রাচীর ও পাশে মাটি ভরাট করে গড়া হয়েছে একটি বাগান। এজন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ২ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। রাতেও আলোকিত রাখতে শহীদ মিনার ও তার আশপাশ ঘিরে আম, বট, মেহগনি, কড়ই গাছে লাগানো হয়েছে রং বেরংগের ৮টি ফানুষ বাতি ও আরও ৪টি লাইট। তাতে বিভিন্ন ধরনের আলো সারারাত আলোকিত রাখে পুরো শহীদ মিনার তথা আশপাশ। নানা আলোর এমন দৃশ্য সারা বছর দেশের আর কোন গ্রামে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এ সবই স্বপন মির্জার উদ্যোগে স্থাপিত।

এদিকে সারা দেশেই শহীদ মিনার রয়েছে। তবে পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন রাখে কয়জন। এমন ধারণা থেকে শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষায় গঠন করা হয়েছে এখানে একটি কমিটি। ‘গোপিনাথপুর শহীদ মিনার রক্ষণা-বেক্ষন কমিটি’ নামে স্কুল-কলেজের ছাত্র, তাঁত শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দপ্তরীসহ ১১ সদস্য বিশিষ্ট এ সংগঠনের সভাপতি স্বপন মির্জা ও কাপড় ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন সাধারণ সম্পাদক। যাদের নিবেদিত দেখভালে সারা বছর পরিচ্ছন্ন ও সৌন্দর্য থাকে পবিত্র মিনারটি।

বর্তমানে এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করেই সকল ভালো কাজের সূচনা একুশে ফোরাম ও ওই সংগঠনটির। এতেও স্বপন মির্জা পালন করেন সকল দায়িত্ব। প্রতিদিন ভোরে ছেলেকে স্কুলে দিয়েই তিনি ছুটে যান প্রিয় শহীদ মিনারে। ঝাড়ু দেয়া, ধোঁয়া-মোছা করে শুরু হয় তার দিনের কাজ। এ জন্য পাশে থাকেন এলাকার খুদেরা। প্রতিদিন অন্তত ২ বার শহীদ মিনারটি ঝাড়ু দেয়া এবং সপ্তাহে ৩ বার পানি দিয়ে ধৌত করা হয়। ত্রুটি হলে মাঝে-মাঝে সারাদিন ও গভীর রাত পর্যন্ত কাটান রাতে আলোক সজ্জা ঠিক রাখতে।

বকুল, টগর, হাসনাহেনা, বেলী, শিউলী, গন্ধরাজ, গাদা, গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ অন্তত ২০টি গাছের ফুলের সমারহ শহীদ মিনারটি বলা চলে একটি পরিচ্ছন্ন উদ্যান। এছাড়া এক পাশে ভাষা আন্দোলনের আহ্বায়ক ভাষা মতিনের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। এতে আরো মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে শহীদ মিনারটির। অনেকেই অবাক হয় সুন্দর শহীদ মিনারটি দেখে। দূর থেকে আসা দর্শনার্থীরা অকপটে স্বীকার করেন, পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে দেশ সেরা গোপিনাথপুর শহীদ মিনার।

শহীদ মিনারটি পরিদর্শনে আশা প্রবীন আইনজীবী অ্যাড. আনোয়ার হোসেন, ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের ছোট ভাই গোলাম কিবরিয়া হান্নান ও ভাষা সৈনিক আলী আজমল বুলবুলের ছেলে অ্যাড. কবীর আজমল বিপুল জানান, সারা দেশেই অনেক শহীদ মিনারে গিয়েছি। তবে এই শহীদ মিনারের মত সারা বছর যথাযথ পবিত্রতা কোথাও রক্ষা হয় কিনা বলতে পারবো না। স্বপন মির্জারা গোপিনাথপুর শহীদ মিনারটি প্রকৃতপক্ষে হৃদয় দিয়ে লালন করে বলেই এতো পরিচ্ছন্ন। আসলেই শহীদ মিনারটি দেখে আমরা অভিভূত। আমরা চাই সারা দেশের শহীদ মিনারগুলো যেন তাদের মত পরিস্কার রাখা হয়।

এদিকে পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনারের উদ্যোক্তা স্বপন মির্জা জানান, দেশের জন্য শহীদদের রক্তের ঋণ কখনো শোধ হবে না। চেষ্টা করি তাদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর। বিশেষ করে যেখানে যাই শহীদ মিনারগুলোর কাছে দাঁড়াই। বেদীতে ময়লা, অপরিস্কার এবং পাশে যখন প্রসাব করা দেখি তখন খুব কষ্ট পাই। পবিত্রতা রক্ষার জন্য বলেও আসি যাকে পাই। কাজের চাপে অন্যটার অতটা সময় দিতে না পারলেও অন্তত আমি একটির দায়িত্ব নিয়েছি পবিত্রতা রক্ষার জন্য।

তিনি বলেন, দূর থেকে অনেকেই পরিদর্শনে এসে আমাদের শহীদ মিনার দেখে অবাক হয়, প্রশংসা করে। তখন ভাল লাগে। আমি চাই ৫২, ৭১-এ যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা মায়ের ভাষা ও দেশ পেয়েছি তাদের যেন যথাযথ মর্যাদায় সম্মান দেয়া হয়। একটি সাধারণ উদ্যোগ নিলেই পরিচ্ছন্ন থাকে আমাদের প্রাণের মিনারগুলো। সেদিকে সবাইকে সচেতন হবার আকুতি আমার।

এলাকার দরিদ্র তাঁত ব্যবসায়ী নুরু সরকার ও হজরত আলী মোল্লা জানান, স্বপন মির্জা সব কাজ ফেলে অন্তত প্রতিদিন একবার করে এসে শহীদ মিনারটি পরিস্কার করে বলে আমাদের সন্তানরাও তার কাছ থেকে শিখে ওরাও প্রতিদিন কাজে হাত বাড়ায়। তাই আমরা গর্ব করি আমাদের পবিত্র পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনার নিয়ে।

শহীদ মিনারটির নির্মাণে উদ্যোক্তা একুশে ফোরাম সিরাজগঞ্জের সভাপতি আখতারুজ্জামান তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক ডনু, শাহজাদপুর সরকারী কলেজের প্রভাষক মোরশেদুর রহমান মাসুদ জানান, একটি ভাল কাজ মানেই স্বপন মির্জা। মানবতা আর দেশের জন্য মমত্ববোধ থাকলে অর্থহীনরাও যে অবদান রাখতে পারে স্বপন মির্জা তার উদাহরণ। পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনার গড়তে তার উদ্যোগ আমাদের জেলায় বিরল।

এমবি/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি