ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

হ্যান্ড স্যানিটাইজার কতটুকু কার্যকর?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:১২, ২২ জুলাই ২০২০

বিশ্বজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া সংক্রামক ভাইরাস কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে ক্ষারজাতীয় সাবান কিংবা অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মতো ভাইরাস প্রতিরোধী উপকরণ দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়া অত্যাবশ্যক। দেশে যখন ভাইরাসটির মারাত্মক সংক্রমণ শুরু হয়, সর্বস্তরের সচেতন নাগরিক তখন স্বতস্ফুর্তভাবেই দ্রুত বাধ্যতামূলকভাবে ভাইরাস প্রতিরোধী এসব উপকরণ ব্যবহারে সাড়া দিয়েছেন।

ফলে বেশ কয়েকটি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্র্যান্ডের চাহিদা দ্রুতই বেড়ে যায়। কয়েক মাস আগেও এসব হ্যান্ড স্যানিটাইজার শুধুমাত্র চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কাটতি হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে। ফলে মুনাফার লোভে নড়েচড়ে বসে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সীমাহীন চাহিদার কারণে দ্রুতই ব্যাঙের ছাতার মতো নকল, নিম্নমানের স্যানিটাইজারে বাজার সয়লাব হয়ে যায়।

এমন প্রেক্ষাপটে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভেজাল হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতকারীরা ধরা পড়ার পর দেশের মানুষ জনপ্রিয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্র্যান্ডগুলোর গুণমান নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়েন। এই উদ্বেগ ও সন্দেহকে আমলে নিয়ে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের হ্যান্ড স্যানিটাইজার, যেমন- সেপনিল, হেক্সিসল, স্যানিটাইজা, স্যাভলন, লাইফবয়, হেক্সিয়ন এবং কেয়ার অন -এই সাতটি পণ্যের নমুনা নিয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (বিসিএসআইআর) ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।

বিসিএসআইআর-এর রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরবরাহ করা সাতটি নমুনার মধ্যে ছয়টি নমুনায় অ্যালকোহলের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারণ করে দেওয়া মাত্রার চেয়ে ঢের বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রা অনুযায়ী- জীবাণু ধ্বংসের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল বা  'নির্দিষ্ট অ্যান্টিসেপটিক' থাকা উচিত। বিসিএসআইআর-এর বিশ্লেষণে- স্কয়ার টয়লেট্রিজের সেপনিলে ৫০ মিলিগ্রামে পাওয়া গেছে ৭০.০৭ শতাংশ অ্যালকোহল। 

২০১৩ সাল থেকে সেপনিল ইনস্ট্যান্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন করে আসছে স্কয়ার। সেপনিলের প্রচারে স্কয়ার দাবি করছে যে- সেপনিল ব্যবহারে ৯৯.৯ শতাংশ জীবাণু ধ্বংস হয়। এ বিষয়ে স্কয়ার টয়লেট্রিজের হেড অফ অপারেশনস মালিক মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, সেপনিলকে জীবাণুনাশে আরও বেশি কার্যকর করার জন্য তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়েও বেশি অ্যালকোহল ব্যবহার করছেন পণ্যটিতে। 

মালিক আরও দাবি করেন, সেপনিল একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। দেশে করোনভাইরাসের সংক্রমণের অনেক আগে থেকেই মানুষ এ পণ্যটি ব্যবহার করে আসছে।

এদিকে, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ১০০ মিলি'র স্যানিটাইজায় ৭০ শতাংশ আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল-বি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আরও রয়েছে ০.৫ শতাংশ ক্লোরহেক্সিডিন গ্লুকোনেট। এ বিষয়ে বিসিএসআইআর জানাচ্ছে- ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের স্যানিটাইজায় ৭১.৫৭ শতাংশ আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল রয়েছে।

অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের হেক্সিসলে আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল পাওয়া গেছে ৭১.১৩ শতাংশ। এই কোম্পানির স্যাভলন স্যানিটাইসার জেলে ৭০.৫০ শতাংশ ইথানল রয়েছে। ইউনিলিভার বাংলাদেশের লাইফবয়-এ আছে ৭১.০১ শতাংশ আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল। 

জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালসের কেয়ার-অনেও রয়েছে ৫৯.৫৭ শতাংশ অ্যালকোহল। এ বিষয়ে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, এ বছরের এপ্রিলে তারা কেয়ার-অন বাজারে এনেছেন। তিনি বলেন, 'শুরু থেকেই গ্রাহকরা, কেয়ার-অনে অতিরিক্ত অ্যালকোহল থাকায় একে ব্যবহার-বান্ধব বলে গ্রহণ করেছে। কারণ অতিরিক্ত অ্যালকোহল থাকায় এটা আঠালো না। আর আমরা সব সময় আমাদের পণ্যের সর্বোচ্চ মান ধরে রাখার চেষ্টা করি।'

এছড়াও ওরিয়ন ফার্মার জনপ্রিয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার হেক্সিয়নেও পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। যা তারা অধিক কার্যকর করার জন্য ব্যবহার করছেন বলে অভিমত দিয়েছেন।

এদিকে, সংক্রমণের ভয়ে আমরা অনেকেই ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। যদিও হাতের জীবাণু দূর করতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বেশ কার্যকরী, তবে এর অত্যধিক ব্যবহার ক্ষতির কারণও হতে পারে। কেননা, অতিরিক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ত্বকের উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও মেরে ফেলতে পারে, যেগুলো আমাদের ত্বক এবং শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

সুতরাং হিতে বিপরীত যাতে না হয়, সেজন্য জেনে নিন হ্যান্ড স্যানিটাইজার কখন ব্যবহার করা জরুরি নয়-

সাবান-পানির ব্যবস্থা থাকলে
যদি সাবান-পানিতে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে তা-ই ব্যবহার করা উচিত। ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এর মতে, জীবাণু থেকে মুক্তি পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো সাবান এবং পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা। সাবান ও পানি দিয়ে হাত রগড়ে, ওতপ্রোতভাবে ধোয়ার ফলে জীবাণু দূর হয়। সম্ভব হলে সব পরিস্থিতিতে আপনার হাত পরিষ্কার করার জন্য সাবান এবং পানি ব্যবহার করাই শ্রেয়।

আপনার হাত দৃশ্যমান নোংরা হলে
আপনি যদি স্যানিটাইজার দিয়ে ময়লা হাত পরিষ্কার করার চেষ্টা করে থাকেন তবে জেনে রাখুন- এটি কেবল ঝামেলাই বাড়াবে। অ্যালকোহল ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ময়লা অপসারণ করে না। হাত ময়লা বা নোংরা থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া মারার ক্ষেত্রে কম কার্যকর। ময়লা হাত পরিষ্কার করার জন্য সাবান এবং পানি ব্যবহার করুন। উদাহরণস্বরূপ- বাগান করা, খেলাধুলা, বাইরে খেলা করার পরে আপনাকে অবশ্যই হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার এড়াতে হবে।

যখন কেউ আপনার পাশে হাঁচি দেয়
আপনার কাছাকাছি কেউ যদি কাশি বা হাঁচি দেয়, আপনি নিঃশ্বাস নেয়ার সময় বাতাসের ফোঁটা থেকে সংক্রমণটি আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। দূষিত হাত সংক্রমণে ধরার একমাত্র উপায় নয়। আপনার কাছে যখন কেউ কাশি বা হাঁচি দিচ্ছেন, তখন বারবার আপনার হাত স্যানিটাইজ করবেন না।

কাউকে বা কিছুই স্পর্শ না করলে
এই সময়ে আমাদের মধ্যে অনেকেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন অভ্যাসের বাইরে। তবে একটি নতুন গবেষণা বলছে, ঘন ঘন এর ব্যবহার প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অতিরিক্ত ব্যবহারের সাথে সাথে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। আমরা যত বেশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করি ততই অ্যালকোহল সহ্য করতে পারা জীবাণু হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। সুতরাং, স্যানিটাইজার কেবল প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যই সংরক্ষণ করুন।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের সঠিক উপায়:
সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধোয়ার সময়, সমস্ত জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলার জন্য আমাদের কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে দুই হাত ওলটপালট করে ঘষতে হবে। তবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার সময় আপনাকে সেই সময়ের চেয়ে বেশি সময় আপনার হাত ঘষতে হবে।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) জানাচ্ছে, স্যানিটাইজার জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়া মারতে প্রায় ৩০ সেকেন্ড সময় নেয়। সুতরাং, সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে আপনাকে অবশ্যই দীর্ঘ সময় ধরে আপনার হাত ঘষতে হবে।

সংক্রমণের ঝুঁকি
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ইমার্জিং সংক্রামক রোগ জার্নালে একটি নতুন সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল, যাতে তারা উল্লেখ করেছিল- মানুষ সময়ের বিষয়টিতে ঠিকভাবে নজর দেয় না। যার অর্থ তারা না জেনে সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়েছে। অর্থাৎ যখন আপনি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন, এটি আপনার হাতের চারপাশে মাখিয়েই কাজ শেষ মনে করবেন না। পুরো ৩০ সেকেন্ডের জন্য এটি সঠিকভাবে হাতে ঘষুন।

কয়েকটি বিষয় মনে রাখা উচিত:
* যদি সাবান এবং পানি না পাওয়া যায়, তবে আপনি ৩০ সেকেন্ডের জন্য ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন।

* এটিকে আপনার তালু, হাতের পিঠ, আঙুলের মাঝে এবং নখের নিচে সঠিকভাবে ঘষুন।

* শিশুদের হাত পরিষ্কার করতে হাতের স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন না।

* শিশুরা এটি ব্যবহার করতে পারে তবে তাদের এটি আপনার সামনেই করতে বলুন।

* আপনার হাত পুরোপুরি না শুকানো পর্যন্ত ঘষুন।

* হ্যান্ড স্যানিটাইজার শিশু এবং পোষা প্রাণির নাগালের বাইরে সংরক্ষণ করুন।

* হ্যান্ড সানাইটিজার লাগানোর পরে আপনার হাত বা মুখে স্পর্শ করবেন না।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি