ডয়েচে ভেলের বিশেষ প্রতিবেদন
একত্রীকরণের ২৮ বছর পরেও দ্বন্দ্ব কাটেনি দুই জার্মানির
প্রকাশিত : ২২:০৩, ৩ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১৩:০০, ৪ অক্টোবর ২০১৮

দুই জার্মানি অর্থ্যাত পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি একত্রিত হয়েছে প্রায় ২৮ বছর আগে। পুনরেকত্রীকরণের এত সময় পরেও দ্বন্দ্ব কাটেনি এই দুই এর মধ্যে। নিজেদের বিরোধপূর্ণ ইতিহাসের কার্যত এখনও সমাধান পায়নি তারা।
নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানির পূর্বাঞ্চলে একটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। তখনো পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নতির এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছিল৷ মনে হচ্ছিল, জার্মানির দুই অংশের মধ্যে বিভাজন যেন দ্রুত দূর হচ্ছে। তবে বাস্তব ঘটনা হলো, মানুষের ‘মাথার মধ্যে প্রাচীর` অত সহজে দূর হবার নয়। জার্মানির পূর্ব ও পশ্চিমের অনেক মানুষ এখনো দেশের অন্য প্রান্তে পা রাখেননি। পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়ার সময় ঠাট্টা করে পশ্চিমের মানুষদের ‘ভেসি` ও পূর্বের মানুষদের ‘অসি` বলা হতো। আজও সেই সংজ্ঞা লোকমুখে থেকে গেছে। এমনকি টুইটারেও জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ হিসেবে এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অতীতের দিকে ফিরে তাকালে মানতে হবে যে, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের শরণার্থী সংকট জার্মানির দুই অংশের মধ্যে ভঙ্গুর মিলের জায়গায় আঘাত করেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্কের ক্ষেত্রে জার্মানির পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে আবছা পার্থক্য আবার প্রকট করে তুলেছে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমনের ফলে পূর্বাঞ্চলের মানুষের মনে আবার স্থিতিশীলতা হারানোর ভয় এবং পুরানো ক্ষত জেগে উঠেছিল।
এই মুহূর্তে ঠিক সেই ভীতিরই ফায়দা তুলছে চরম দক্ষিণপন্থি পপুলিস্ট শিবির। এএফডি, অর্থাৎ ‘জার্মানির জন্য বিকল্প` রাজনৈতিক দল এবং পেগিডা`র মতো আন্দোলন জার্মানির দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য আবার তুলে ধরছে৷ সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী, এএফডি জার্মানির পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে। এমনকি ‘পুনরেকত্রীকরণের চ্যান্সেলর` হিসেবে পরিচিত হেলমুট কোল ও জার্মানির পূর্বাঞ্চলের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী সিডিইউ দল ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও সেখানে পিছিয়ে পড়েছে।
ব়্যাডিকাল পরিবর্তন: আঙ্গেলা ম্যার্কেল
এমন এক প্রেক্ষাপটে এ বছর ৩ অক্টোবর ‘জার্মান ঐক্য দিবসে` যে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে অন্য ধরনের বিতর্ক দেখা যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই। অতীত বছরগুলিতে দুই অংশের বেতন, বিষয়-সম্পত্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হতো। নাগরিকদের অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত নগণ্য বিষয়। আজও পূর্বের মানুষ পশ্চিমের জীবনযাত্রার মানের সবে ৭৩ শতাংশ ছুঁতে পেরেছে। পূর্বের হাতে গোনা কয়েকটি অঞ্চলের সাফল্য গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের সার্বিক মানের হ্রাস ও শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অভাব পূরণ করতে পারেনি।
বর্তমানে সেই আলোচনায় আরো আবেগ যোগ হয়েছে৷ বিভিন্ন দলের রাজনীতিক, এমনকি খোদ চ্যান্সেলর ম্যার্কেলও তাতে সুর মিলিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ ‘ব়্যাডিকাল পরিবর্তন` ঘটিয়েছে। ৯০-এর দশকের শুরুতে যা ঘটেছে, তার অনেক অংশ আবার মানুষের সামনে ফিরে আসছে। ম্যার্কেল বলেন, ‘‘সে ছিল এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। অনেকে সে সময়ে চাকরি হারিয়েছিলেন, একেবারে নতুন করে তাঁদের জীবন শুরু করতে হয়েছিল। স্বাস্থ্য পরিষেবা, অবসর ভাতার কাঠামোসহ সবকিছু বদলে গিয়েছিল।`` তবে এমন পরিবর্তন সত্ত্বেও ঘৃণা ও হিংসার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না বলে ম্যার্কেল মনে করেন। তবে তাঁর মতে, পূর্বের মানুষের জীবনের প্রবাহ বুঝতে এই প্রেক্ষাপট সাহায্য করতে পারে।
জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান হিয়র্টেও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। জার্মান ঐক্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর বাৎসরিক রিপোর্ট অনুযায়ী পূবের অনেক মানুষ এখনো নিজেদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক` মনে করেন। তাঁদের মতে, পূবের মানুষের কথায় যথেষ্ট কান দেওয়া হয় না। এএফডি দলের প্রতি পূবের মানুষের সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এত মানুষ রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতি আস্থা হারালে বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন থাকলে চলবে না।
কী ভুল হয়েছে?
অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা আরো গভীরভাবে এই বিভাজনের কারণ অনুসন্ধান করছেন। বিশেষ করে পুনরেকত্রীকরণের ঠিক পরে ‘ত্রয়হান্ড` নামের যে কর্তৃপক্ষ পূর্ব জার্মানির সরকারি মালিকানার কল-কারখানা বেসরকারি হাতে তুলে দেবার দায়িত্ব পেয়েছিল, তার ভূমিকা নিয়ে জোরালো তর্ক-বিতর্ক চলছে। প্রায় আট হাজার প্রতিষ্ঠান ও সেখানে কর্মরত প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ স্থির করার দায়িত্ব ছিল এই কর্তৃপক্ষের হাতে। হয় প্রতিষ্ঠানগুলির বেসরকারীকরণ অথবা তা সম্ভব না হলে সেগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল কর্মকর্তাদের। এর পরিণাম দাঁড়ালো ব্যাপক হারে বেকারত্ব। ঐতিহাসিক মারকুস ব্যোইক বলেন, ‘‘জার্মানির পূর্বাংশের অনেক মানুষ মনে করেন যে, সেই অঞ্চলকে ছারখার করে দিতেই ত্রয়হান্ড সৃষ্টি করা হয়েছিল।`` অনেক মানুষের সারা জীবনের পেশাগত অর্জন আচমকা মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। ব্যোইক আরো মনে করেন, তার উপর এ নিয়ে কখনো খোলামেলা আলোচনা না হওয়ায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। পশ্চিমে এই অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভূতি দেখা যায়নি।
অন্য আরেকটি বিষয় নিয়েও ক্ষোভ দূর হয়নি। পুনরেকত্রীকরণের পর জার্মানির পশ্চিমাঞ্চল থেকে হাজার হাজার সরকারি কর্মীকে পূর্বে পাঠানো হয়েছিল। ২৮ বছর পরেও অনেক মানুষ সেই সিদ্ধান্ত হজম করতে পারেননি। উচ্চ পদে পশ্চিমের মানুষের আধিপত্যকে ‘সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ’ হিসেবে গণ্য করেন পূর্বের মানুষ। এমন অবস্থা অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এমনকি পশ্চিমের মানুষ শুধু ‘স্বজনদের` চাকরি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পূর্ব জার্মানি সম্পর্কে নতুন নীতি?
এত বিশ্লেষণ সত্ত্বেও জার্মানির পূর্বাঞ্চল সংক্রান্ত বিশেষ সরকারি নীতির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কয়েকজন সংসদ সদস্য ত্রয়হান্ডের কার্যকলাপ তদন্ত করার দাবি তুলেছেন, অন্য কয়েকজন এক ‘রিকনসিলিয়েশন কমিশন` গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ৩ অক্টোবর উদযাপনের পর সেই সব প্রস্তাব কতটা কার্যকর করা হবে, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তার চেয়ে বরং বর্তমানে বহুল চর্চিত জার্মান শব্দ ‘হাইমাট` অর্থাৎ স্বভূমির পরিচয় বিকল্প হয়ে উঠতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফেডারেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম বদলেও ‘স্বভূমি মন্ত্রণালয়` করা হয়েছে। ফলে আঞ্চলিক নীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এর আওতায় শহরকেন্দ্রিক বিশাল জনপদগুলি থেকে মনোযোগ সরিয়ে গ্রামাঞ্চলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, যেখানে এখনো জার্মানির বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করেন। কয়েকদিন আগে এই বিভাজন ঘোঁচানোর লক্ষ্যে এক কমিশন কাজ শুরু করেছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন ও ঋণভার কমানোর বিষয় থেকে শুরু করে জমির ব্যবহার সংক্রান্ত নীতির আমূল পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মোটকথা, কোনো অঞ্চলের উন্নয়নের দায় শুধু সেই অঞ্চলের হাতে না রেখে রাষ্ট্রও নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তা চালনা করবে। ‘সমাজে পারস্পরিক ঐক্য` মজবুত করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য। কৃষিমন্ত্রী ইয়ুলিয়া ক্ল্যোকনার বলেছেন, কোনো মানুষই যাতে নিজেকে অবহেলিত মনে না করেন, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
অর্থাৎ জার্মানির পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে দ্বন্দ্বের বদলে সবার জন্য স্বভূমি? এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাম্যকে আর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হবে না বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বেতন অথবা বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থার সদর দপ্তরের ক্ষেত্রে পূব ও পশ্চিমের মধ্যে বৈষম্য দ্রুত অথবা আদৌ দূর করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান হিয়র্টে।
সূত্রঃ ডাচ উইলি
//এস এইচ এস//
আরও পড়ুন