ছয় দশক পূর্ণ করলেন সৈয়দ আজিজুল হক
প্রকাশিত : ২২:০৯, ২৯ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ০০:০৮, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকলাবিষয়ক গবেষণায় সৈয়দ আজিজুল হক নামটি স্বমহিমায় ভাস্বর। সাহিত্য ও শিল্পকলার তিনি একজন একাগ্রচিত্ত পাঠক, অনুসন্ধানী বিশ্লেষক, সর্বোপরি একজন ‘যথার্থ’ গবেষক। গবেষণার বন্ধুর পথে তিনি ইতোমধ্যেই পাড়ি দিয়েছেন তিন দশকের বেশি সময়। ৩০ এপ্রিল জীবন-পরিক্রমায় তার পূর্ণ হবে ছয় দশক। ছয় দশকের এ জীবন-পরিক্রমাকে সামনে রেখে তাঁর গবেষণাগ্রন্থসমূহ থেকে কেবল ছয়টি গবেষণাগ্রন্থের অতি-সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার মধ্যে এ নিবন্ধটি সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। গ্রন্থগুলো হচ্ছে : ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প : সমাজচেতনা ও জীবনের রূপায়ণ’ (১৯৯৮), ‘ময়মনসিংহের গীতিকা : জীবনধর্ম ও কাব্যমূল্য’ (১৯৯০), ‘জয়নুল আবেদিন : সৃষ্টিশীল জীবনসমগ্র’ (২০১৫), ‘কামরুল হাসান : জীবন ও কর্ম’ (১৯৯৮), সফিউদ্দীন আহমদ’ (২০১৩) এবং ‘কাইয়ুম চৌধুরী : শিল্পীর একান্ত জীবনকথা’ (২০১৫)।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-৫৬) সমগ্র বাংলা সাহিত্যের সেই বিশিষ্ট শিল্পপ্রতিভা, সাহিত্যাঙ্গনে যাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে। বাজিটা সাহিত্যিক হওয়ার জন্য ধরেননি; ধরেছিলেন সেই সময়ের (১৯২৮) খ্যাতনামা পত্রিকা ‘বিচিত্রা’য় নিজের লেখা গল্প ছাপাবেন বলে। সেই সময় বড় বড় লেখকদেরই বিচিত্রা পত্রিকায় লেখা ছাপাতে বেশ বেগ পোহাতে হতো। অথচ, তখন মানিক ছিলেন বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ থেকে সদ্য আইএসসি পাশ করা প্রেসিডেন্সি কলেজের অঙ্কের (বিএসসি অনার্স) ছাত্র। যা-ই হোক, বাজির শর্ত মেনে ‘অতসীমামী’ নামে একটি গল্প লিখে পাঠিয়ে দিলেন বিচিত্রার ঠিকানায়। এমনকি নিজের পিতৃদত্ত ‘প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামটিও গোপন রেখে লেখকনাম হিসেবে ব্যবহার করলেন ডাকনাম ‘মানিক’। ফলশ্রুতিতে দেখা গেল তাঁর লেখা গল্পটি কেবল বিচিত্রায় ছাপা-ই হলো না, মুদ্রিত গল্প ও তার পারিশ্রমিকসহ স্বয়ং পত্রিকা-সম্পাদক বাড়ি এসে মানিকের কাছে নতুন গল্প দাবি করে বসলেন। মানিকও সাড়া দিলেন সেই দাবিতে। একের পর এক গল্প-উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যে নিজের স্থায়ী আসন পাকাপোক্ত করে নিলেন তিনি। কীভাবে ‘মানিক’ ডাকনামের ছেলেটি বাংলার পাঠকসমাজের কাছে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন, কীভাবে তিনি লেখনীর মধ্য দিয়ে মানবমনের গহন-গভীর রহস্য-উন্মোচন করেছেন, কীভাবে সমাজচৈতন্যের মূলে প্রোথিত রহস্যাবৃত বাস্তবতাকে শিল্পভাষায় প্রকাশ করে নিজের সাহিত্যভুবন বিনির্মাণ করেছেন, তার চুলচেলা বিশ্লেষণে সৈয়দ আজিজুল হকের মানিকবিষয়ক গবেষণাসমূহ সমৃদ্ধতা লাভ করেছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প বিষয়ে তিনি ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প : সমাজচেতনা ও জীবনের রূপায়ণ’ (১৯৯৮) শীর্ষক যে গবেষণাগ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও দুর্লভ গবেষণাগ্রন্থসমূহের অন্যতম। মানব জীবনের দর্পণ হিসেবে খ্যাত সাহিত্যমাধ্যকে কতোটা গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়, এ গবেষণাগ্রন্থ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উল্লিখিত গবেষণাগ্রন্থ এবং মানিক-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গবেষণাকর্মের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানিকগবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
বাঙালির স্বকীয় সাহিত্যধারার প্রাকৃত ও প্রকৃত সাহিত্যরূপ ময়মনসিংহ গীতিকার একজন শেকড়সন্ধানী বিশ্লেষক হিসেবেও সৈয়দ আজিজুল হকের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন গীতিকবি তথা পালাকারদের রচিত প্রত্যেকটি পালাগানে বিধৃত লোকজ জীবনাখ্যানকে কতোটা শিল্পসুষমামণ্ডিত ভাষায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়, তার দালিলিক প্রমাণ গবেষক সৈয়দ আজিজুল হকের গবেষণাগ্রন্থ ‘ময়মনসিংহের গীতিকা : জীবনধর্ম ও কাব্যমূল্য’ (১৯৯০)।
বাংলাদেশের শিল্পকলাবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রেও সৈয়দ আজিজুল হকের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। বাংলাদেশের শিল্পকলা যে সৃজন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং যাঁদের হাত ধরে শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তার প্রকৃত ইতিহাস ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ অনুধাবন করার জন্য তাঁর গবেষণাকর্মের কাছে দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গতি নেই। বাংলাদেশের শিল্পকলা তথা পুরো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রধান পুরুষ, বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পুরোধা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের (১৯১৪-৭৬) জীবন ও শিল্পকর্মের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ঋদ্ধ তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘জয়নুল আবেদিন : সৃষ্টিশীল জীবনসমগ্র’ (২০১৫)। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের লালিত্যে নদী ও অবারিত প্রকৃতির মাঝে বাল্য-কৈশোর অতিক্রম করা জয়নুল আবেদিন কীভাবে শিল্পসমুদ্রে অবগাহনের মধ্য দিয়ে শিল্পের জন্য আত্মোৎসর্গের করলেন; তাঁর হয়ে ওঠার বিস্তৃত ইতিহাস ও তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনাখ্যানকে সামগ্রিকভাবে বিবৃত করে সৈয়দ আজিজুল হক রচনা করেছেন তাঁর এই শ্রমসাধ্য গবেষণাগ্রন্থ। জয়নুল আবেদিনের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এ গ্রন্থের মর্যাদা তুলনারহিত।
‘পটুয়া’ হিসেবে পরিচয়দানকারী, বাংলাদেশের চিত্রকলার অমর শিল্পী কামরুল হাসানের (১৯২১-৮৮) জীবন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে প্রণীত তাঁর অপর গবেষণাগ্রন্থ ‘কামরুল হাসান : জীবন ও কর্ম’ (১৯৯৮)। ঢাকায় চিত্রকলার চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ (১৯৪৮) বাংলাদেশের চিত্রকলার বিকাশে কামরুল হাসানের ভূমিকা অতুলনীয়। এই মহান চিত্রশিল্পীর জন্ম ও পারিবারিক বৃত্তান্ত, শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে বেড়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায় ও চিত্রকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অভাবনীয় দক্ষতায় উল্লিখিত গবেষণাগ্রন্থটি সাজিয়েছেন গবেষক সৈয়দ আজিজুল হক।
বাংলাদেশের পথিকৃৎ শিল্পীদের অন্যতম, বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের (১৯২২-২০১২) জীবন ও সৃষ্টিকর্মের এক বিশ্লেষণধর্মী জীবনাখ্যান সৈয়দ আজিজুল হকের গ্রন্থ ‘সফিউদ্দীন আহমেদ’ (২০১৩)। কলকাতার পদ্মপুকুরে শৈশব-কৈশোর কাটানো, কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থীর ‘শিল্পগুরু’ হয়ে ওঠার পর্যায়ক্রমিক উপস্থাপনা এবং তাঁর শিল্পকর্মসমূহের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এ গ্রন্থের সর্বত্র লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশের চিত্রকলা-জগতের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের এক কিংবদন্তির নাম কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২-২০১৪), যিনি ছয় দশক ধরে তাঁর সৃষ্টিসম্ভারে শোভিত করে গেছেন বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পকে। তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিশীল জীবন-পরিক্রমার নান্দনিক উপস্থাপনায় রচিত সৈয়দ আজিজুল হকের অপর গবেষণাগ্রন্থ ‘কাইয়ুম চৌধুরী : শিল্পীর একান্ত জীবনকথা’ (২০১৫)। কাইয়ুম চৌধুরীর ব্যক্তিজীবন ও শিল্পীজীবনের নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থে তাঁর ‘শিল্পী’ হয়ে ওঠার জীবনেতিহাস অবিশ্বাস্য শিল্পকুশলতায় বাণীবদ্ধ করেছেন লেখক। এগারোটি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত এ গ্রন্থের কেবল প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনামগুলো লক্ষ করলেও খুব সহজেই অনুধাবন করা যাবে, কতোটা বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে কতোটা গভীর মমতায় গ্রন্থটি সৃজন করেছেন গবেষক।
শিরোনামগুলো হলো- ‘বাল্য-কৈশোর : বাংলার নদী-মাঠ-ঘাট ভালোবেসে’, ‘শিল্পের পথে, সুন্দরের পথে যাত্রা’, ‘স্বপ্নের রাজকুমারী অড্রে হেপবার্ন’, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’, ‘জীবিকার পথে : নানা চড়াই-উতরাই’, ‘বইয়ের প্রচ্ছদ ও পত্রিকার এক সম্মোহনী জগৎ’, ‘প্রেম-বিয়ে-সংসার-সন্তান : আনন্দ-বেদনার কাব্য’, ‘যাঁদের শিল্পচেতনায় আলোকিত’, ‘সৃজনশীলতার বিচিত্র দিক : ফটোগ্রাফি-ছড়া-কবিতা’, ‘ভুবন ভ্রমি বিস্ময়ে’ ও ‘ফিরে চল মাটির টানে’ প্রভৃতি। উল্লিখিত প্রতিটি গ্রন্থ-বিন্যাসের ক্ষেত্রেই গবেষকের এই সৃজন-প্রক্রিয়া লক্ষণীয়।
সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে ‘গবেষণা’ বলতে কী বোঝায় এবং কীভাবে তা সম্পন্ন করতে হয়, সৈয়দ আজিজুল হকের উল্লিখিত গ্রন্থসমূহ নিঃসন্দেহে তার প্রামাণিক দলিল। গবেষক প্রতিটি গ্রন্থকে কতোটা যুক্তিনিষ্ঠতার সঙ্গে তাত্ত্বিক কাঠামোর আদলে শিল্পসম্মতভাবে বিনির্মাণ করেছেন, গ্রন্থপাঠে তা সহজেই অনুমেয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে গবেষণাক্ষেত্রে অবদানের জন্য নানাবিধ পুরস্কারের প্রচলন থাকলেও সম্ভবত তাঁর প্রচারবিমুখ, রুচিশীল ও নিভৃতচারী স্বভাবের জন্যই তাঁর ভাগ্যে রাষ্ট্রস্বীকৃত কোনো গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার মেলেনি।
গবেষক সৈয়দ আজিজুল হক ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল বর্তমান পিরোজপুর জেলার সেহাঙ্গল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ নুরুল হক (জন্ম : ১৯৩১) এবং মাতা নাম মোসাম্মৎ হাজেরা খাতুন (১৯৩৫-২০১৪)। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে নিজ গ্রাম সেহাঙ্গলে। সেহাঙ্গল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও বরিশাল বিএম কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক সম্পন্ন করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্জন করেন বিএ অনার্স (১৯৮০), এমএ (১৯৮১), এমফিল (১৯৮৯) এবং পিএইচডি (১৯৯৫) ডিগ্রি।
পেশাগত জীবনে তিনি একজন শিক্ষক। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইসস্টিটিউটে ‘প্রভাষক’ হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সেখানে ‘সহকারী অধ্যাপক’ ও ‘সহযোগী অধ্যাপক’ হিসেবে কর্মরত থাকার পর ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ‘অধ্যাপক’ হিসেবে যোগদান করেন; এবং বর্তমানেও একই বিভাগে কর্মরত রয়েছেন।
এসএইচ/
আরও পড়ুন