হাসপাতালে রোগী নেই অথচ খরচের খাতায় কোটি টাকার ঔষধ
প্রকাশিত : ১৯:০৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

চিকিৎসক ও নার্স সংকটে ধুঁকছে রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হাসপাতালগুলো। এ অঞ্চলে ছয়টি হাসপাতালে ৩৪ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র আটজন।সিনিয়র নার্স থাকার কথা ৩০ জন, কিন্তু রয়েছেন মাত্র ২০ জন। ফার্মাসিস্ট ৩৩ জনের বিপরীতে রয়েছে ১৫ জন।
ফলে এসব হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। অথচ এ হাসপাতালগুলোর জন্য বছরে বরাদ্দ দেয়া হয় কোটি টাকার ঔষধ। যেগুলো রোগীদের নামে বিতরণ করাও হয়েছে কাগজে কলমে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য ছয়টি হাসপাতাল রয়েছে। এরই মধ্যে রাজশাহীতে ২০ শয্যা, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৯০ শয্যা, লালমনিরহাটে ৩০ শয্যা, পার্বতীপুরে ১৬ শয্যা, পাবনার পাকশীতে ৮০ শয্যা এবং সান্তাহারে ৮০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল রয়েছে।
রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর জন্য ২০১৮-১৯ বছরে মোট ৮৩ লক্ষ ৬৫ হাজার ৫২৯ টাকার ঔষধ কেনা হয়। এরই মধ্যে রাজশাহীকে দেয়া হয় ২০ শতাংশ ঔষধ।যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ১০৫ টাকা। আর এই বছরে রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয় ২১৭ জন। আউটডোর থেকে চিকিৎসা নেয় ২১ হাজার ৫৪৭ জন।
রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালে নেই রোগীর আনাগোনা। এখানে জরুরি কোনো রোগী আসেন না, কেউ আসলেও ভর্তি হন না। সারা বছরই ফাঁকা থাকে এ হাসপাতালটি। অথচ এ হাসপাতালে এক বছরে বরাদ্দ এসেছে ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ১০৫ টাকার ঔষধ।যেগুলো রোগীদের নামে বিতরণ করাও হয়েছে।
সম্প্রতি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালের আউটডোরে একজন রোগীও নেই। বসে আছেন ডাক্তার ও নার্সরা।
ইনডোরেও কোনো রোগী নেই। বসে আছেন নার্সরাও।এক নার্স দেখছেন টিভি।একজন ডাক্তার বসে আছেন, তিনি মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত।আউটডোরের সামনেই মেডিসিন কর্ণার। সেখানে দেখা গেল, একটু জটলা।সেখানে সবাই ঔষধ নিচ্ছেন। সেখান থেকে এক বক্স ওষুধ নিয়ে ওপরে চলে গেলেন একজন প্যাথলজি কর্মী।
তিনি কোন ডাক্তার দেখাননি।কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো দুইজন ব্যক্তি চার বক্স ঔষধ নিয়ে বাইরে চলে গেলেন।তাদের কাছেও কোনো ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র নেই।এর কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ভিন্ন এক তথ্য।এক কর্মকর্তার কাছে তার এক বন্ধু এলেন, তিনি দুটি সিঙ্গাড়া নিয়ে এসেছেন বন্ধুর জন্য।তিনি সিঙ্গাড়া দুটি রাখলেন, আর বিনিময়ে তাকে দেয়া হলো দু’টি চোখের ড্রপ। কোনো কাগজ লাগেনি এ ঔষধ নিতেও।
সংশ্লিষ্টরা বললেন, রেলওয়ে হাসপাতালের এমন দৃশ্য রোজকার।রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই কম।বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতাল ফাঁকা থাকে।ইনডোরের বেডগুলো প্রায় ফাঁকাই থাকে। আর আউটডোরেও রোগীর সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। তবে প্রতিদিনই এখানে নামে-বেনামে ঔষধ নিচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন। ঔষধ বিতরণের রেজিষ্ট্রার ঠিকই মানা হচ্ছে। রোগী দেখা না গেলেও খাতা ভর্তি হচ্ছে রোগীর নামে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে সেখানকার এক কর্মচারী বলেন, এখানে কোন রোগী হয় না। প্রতিদিনই রোগীদের নাম লিখে নিজেদের লোককে এসব ঔষধ দেয়া হয়।এর সাথে ওপর লেবেলের কর্মকর্তা ও ডাক্তাররা জড়িত বলে জানান তিনি।
রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট গোলাম কবির বলেন, অনেক সময় ডাক্তাররা ব্যস্ত থাকেন তখন আমরাই ঔষধ দিয়ে দিই। পরে সেটি ডাক্তারের কাছে থেকে স্লিপ করে নিই। তবে স্লিপ ছাড়া কোনো ঔষধ দেন না বলে জানান তিনি।
এদিকে, হাসপাতালের রেজিষ্ট্রারে নাম না থাকলেও দেখানো হয়েছে ঔষধ বিতরণ। দায়িত্বে থাকা ফার্মাসিস্ট আবদুল আজিজ বলেন, এখানে একজনের ঔষধ অন্যজন এসে নিয়ে যান।
হাসপাতালের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এস এ এম এমতেয়াজ বলেন, বিষয়টি আমাদের দেখার নেই। ঔষধ বিষয়ে ডিএমও ডা.এসএম মারুফুল আলমের সাথে কথা বলতে বলেন তিনি।
মারুফুল আলম বলেন, আমরা তো ঔষধ লিখে দিই। বিতরণ বিভাগ এটি বিতরণ করে। অতিরিক্ত দেয়ার কোনো অভিযোগ নেই। তবে বিষয়টি যদি এমন হয় তাহলে আমরা সেটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।
রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার হারুন অর রশিদ বলেন, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হাসপাতালগুলোতে কোনো অনিয়ম আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে,পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে,সৈয়দপুরে ৯০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ রয়েছে সাতটি।এর মধ্যে পাঁচটি পদই শূন্য রয়েছে।দীর্ঘদিন ধরেই একজন মাত্র চিকিৎসক দিয়ে চলছিল সেবা প্রদান।তবে সম্প্রতি একজন ডেন্টাল সার্জন এখানে যোগদান করেছেন।লালমনিরহাটে ৩০ শয্যা বিশিষ্ট রেলওয়ে হাসপাতালে ১০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসা দিচ্ছেন মাত্র একজন।
পার্বতীপুরের ১৬ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজনও চিকিৎসক নেই এই হাসপাতালে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে পাবনার পাকশী রেলওয়ে হাসপাতাল। এখানে ১৩ জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র তিনজন চিকিৎসক।
সান্তাহারে দুজনের বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন একজন। আর রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালে চারজন চিকিৎসক পদের বিপরীতে রয়েছেন দু'জন।প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে এসব হাসপাতালের ওপর আস্থা হারাচ্ছে রোগীরা। এই হাসপাতালগুলোতে রেলওয়ের চাকরিজীবীদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এমন সমস্যার সমাধান না হওয়ায় এই হাসপাতালগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কর্মকর্তা, কর্মচারীরা।তারা বাধ্য হয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন বাইরের হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা হয় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হাসপাতালগুলো। কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য নির্মিত এই হাসপাতালগুলো চিকিৎসাসেবা তো দূরের কথা, নিজেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
আই/কেআই
আরও পড়ুন