ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

ইউরোপের মেয়ে বাংলাদেশের ছেলে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:২৮, ৩ আগস্ট ২০২০

এ এক ভালোবাসার গল্প। যে গল্পটা ইউক্রেনের মেয়ে লিজা ও বাংলাদেশী ছেলে অপুর। ছবির মতো সুন্দর দেশ ইউক্রেন। সেখানকার ছোট্ট এক শহরে জন্ম এলিজাবেথ দামেস্কার। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে এলিজাবেথ বেড়ে উঠেছেন একটি ভেঙে যাওয়া সংসারে। খুব অল্প বয়সেই জন্মদাতা পিতা আলাদা হয়ে যান তাদের থেকে। সেই থেকে মায়ের কাছেই মানুষ হন এলিজাবেথ। মায়ের কস্টার্জিত উপার্জন দিয়েই স্নাতক পাশ করেন তিনি।

সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বড় হওয়া মানুষগুলো যেন আলাদা জীবনীশক্তি নিয়েই বেড়ে ওঠে। তার বেলাতেও সেটির ব্যতিক্রম হয়নি। এলিজাবেথের বয়সটা তখন কুড়ি কিংবা একুশ। শুরু হলো রাজনৈতিক পালাবদলের মেলা। সেই সঙ্কটে কাজের সন্ধানে তার মা পাড়ি জমালেন পোল্যান্ডে।

তাগিদ এলো নিজের জীবনকে নিজেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হতে হবে স্বাবলম্বী। ২০১৬ সালের ঘটনা। জার্মানির জেনসন এলাকার একমাত্র বাংলাদেশি কৃষি উদ্যোক্তা মোক্তাজুল ইসলাম কাজলের স্টবেরি ক্ষেত থেকে তোলা হতো স্টবেরি। আর এতে কর্মের সন্ধানে আসা ইউক্রেন থেকে কিছু শ্রমিক কাজ করতো। তাদের ভেতর একজন এলিজাবেথ দামেস্কা। মেয়েটার দুই চোখভর্তি চঞ্চলতা। সেই চঞ্চল মেয়েটার সাথে সেখানে কাজ করতেন কিছু বাঙালি তরুণ। তাদের সঙ্গে কথাবার্তায়, বাঙ্গালিয়ানা শব্দের সাথে আর মানুষদের সাথে মিশে তার নাম হয়ে যায় লিজা। কৌতুহলী মেয়ে লিজার ভালো লেগে যায় বাঙলা। ভাঙা ভাঙা কিছু শব্দও শিখে যায় সে।

সেই স্ট্রবেরি ফার্মে কাজ করা বাঙালি তরুণদের গল্পগুলোও বেশ করুণ। দুঃসাহসিক সংগ্রামের মাধ্যমে সাগর পেরিয়ে জার্মানি পাড়ি জমিয়েছেন একেকজন। রেখেছেন জীবনের বাজি। এদেরই একজন বাংলাদেশের নরসিংদীর শামসুল আলম অপু। জীবনের গল্পটাকে বদলে দেবার আশায় উদ্যোমী এই তরুণও পাড়ি জমান স্বপ্নের ইউরোপে।

একসাথে কাজ করতে করতে লিজার ভালো লেগে যায় অপুকে। বাকী জীবনটা একসাথেই কাটাবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এ যেন কোনো রূপকথার গল্পেই মতোই ঘটনা। ছবির মতো সুন্দর দেশে, ছবির মতো সুন্দর এক অনিন্দ্য ভালোবাসা। কিন্তু বাঁধ সাধলো ভাগ্যদেবতা।

এই যুগলের ভালোবাসা যখন সুখের ভেলায় ভাসছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেলো সব। অপুর ব্রেন টিউমার ধরা পড়লো। চিকিৎসক জানালেন- আর অল্প কিছুদিন বাঁচবেন অপু। লিজার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। কিন্তু তাতেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়লেন না তিনি। অপুকে কেন্দ্র করেই সাজিয়েন নিলেন নিজের জগত।

শুরু হলো নিজের ভালোবাসাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এরই ভেতর লিজা নিজেই অপুকে বিয়ে করার তুমুল আগ্রহ প্রকাশ করেন। নিজ তাগিদেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইসলামি বিধান মোতাবেক একদিন ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে অপুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

তাদের বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন স্ট্রবেরি ফার্মের মালিক কাজল। তার ভাষ্যমতে, লিজার কথা ছিলো একটাই, অপু যতদিন বাঁচবে- সে তার সাথেই থাকতে চায়। চব্বিশ ঘন্টা ছায়ার মতোই আপুকে আগলে রাখতো লিজা। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া অপু হয়ে ওঠে লিজার একমাত্র অবলম্বন, জীবনে চলার নতুন পথ।

নরসিন্দীর শিবপুর ঘাসিরদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শশুড়বাড়ি লিজার। অপুর সাথে বাংলাদেশে এসে থেকেও গিয়েছেন তিনি। বাঙালি গৃহবঁধুর মতোই অপুর পরিবারে সাথে মিশে গিয়েছেন। লিজার এই ভালোবাসায় চিকিৎসকদের বেঁধে দেয়া সময়ের থেকেও বেশি জীবনসঞ্চার হয় অপুর।  

তবে নিয়তির নির্মম পরিহাসের কাছে হার মানতে হয় অপুকেও। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। এই চলে যাওয়াতেও অপুকে ভুলে যাননি লিজা, অপুর কবরে দোয়া পাঠ করার মাধ্যমেই স্মরণ করেন তাকে। অপুর ধর্ম, দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুকেই জাপটে ধরে বাঁচার নতুন অবলম্বন খুঁজে পান লিজা।

অপুর মা লিজাকে নিজের পুত্রবধু নয় বরং ছেলে বলেই পরিচয় করিয়ে দেন। পুরো পরিবারটার কাছেই লিজা এক বিস্ময়ের নাম। সবাই যেন লিজার মাঝেই খুঁজে পায় হারিয়ে যাওয় অপুকে। এমনকি গ্রামাঞ্চলের মানুষেরাও মুগ্ধ এক বিদেশিনীর অমায়িক ব্যবহারে।

পুরো পরিবারের সাথে রোজা রাখা, ইফতার করা থেকে শুরু করে করেছেন যাবতীয় কাজকর্মও। নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াতও করেন তিনি। যা একটা ভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মেয়ে হয়ে করাটা বেশ কস্টসাধ্য বটে। অপু নেই, তবুও লিজা মনে করেন বাকীটা জীবন সৃষ্টিকর্তার কাছে অপুর জন্য প্রার্থনা করে কাটিয়ে দেয়াটা তার কর্তব্য। 

আর এভাবেই আজও অপুর স্মৃতি নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে গেছেন লিজা। গল্প মনে হলেও গল্প নয়, এ এক সত্যিকারের প্রেম কাহিনী।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি