ঢাকা, সোমবার   ০৬ মে ২০২৪

সৌদিতে আগুনে পুড়ে মৃত্যু

স্বামীর সাক্ষাৎ পাবার আগেই বিধবা কলেজছাত্রী মরিয়ম

বদরুল হাসান লিটন, রাজশাহী থেকে

প্রকাশিত : ১১:১৩, ১৬ জুলাই ২০২৩

স্বামীর মৃত্যুতে মরিয়মের আহাজারি

স্বামীর মৃত্যুতে মরিয়মের আহাজারি

সৌদি আরবে সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বারইপাড়া গ্রামের চাচা-ভাতিজাসহ তিনজন ও মাধাইমুড়ি গ্রামের একজন। যাদের মধ্যে সাত বছরের প্রবাসী রুবেল হোসাইন নয় মাস ছয়দিন আগে মোবাইল ফোনে ভিডিও কনফারেন্সে বিয়ে করেন। প্রেম করে বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার আগে বিধবা হলেন কলেজছাত্রী মরিয়ম আক্তার।

স্বামীর মৃত্যু সংবাদে থামছেই না মরিয়মের আহাজারি। 

শনিবার সন্ধ্যায় সরজমিনে রুবেল হোসাইনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় মরিয়ম আক্তার মোবাইল ফোনে স্বামীর ছবি দেখে প্রলব করছেন, “আমার স্বামীকে একটার বার হলেও দেখতে চাই রে...। স্বামীকে আমি কাছ থেকে দেখিনি রে...। আপনাদের পায়ে ধরি রে...; আমার স্বামীকে একনা এনে দেন...রে ভাই। স্বামিকে কোন দিন চোখের কাছ থেকে দেখিনি রে...। যা দেখেছি দূরে থ্যাকা...রে। যত কথা কছে দূরে থ্যাকাই কথা কছে রে...।’

‘আমি মোবাইল ভাংগিছি তাই একটা কথা কইনি রে...। সাথে সাথে মোবাইল কিনে দিয়েছে। বিয়ের আগেও দুইটা মোবাইল ভাংগিছি রে...। উনি আমাক কিনে দিছে রে...।’

মোবাইলে স্বামীর ছবি দেখে কাঁদতে কাঁদতে মরিয়ম বলছিলেন, ‘আমার রুবেল বড় বড় চুল রাখতো রে...। ঈদের আগে আমি বলে চুল কাটিয়েছি রে...। বলে তাকে বলছিল রে...; মায়ের কথায় চুল কাটিসনি; বউয়ের কথায় চুল কাটলু। আরেক ছবি দেখে বলছিলেন এই গেঞ্জি পড়ে আমার রুবেল মারা গেছে রে...।’

নিহত আরিফ হোসেনের মায়ের আহাজারি

মরিয়ম জানান, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে তাদের শেষ কথা হয়। দেশে আসার জন্য শুক্রবার কাগজপত্র জমা দিয়ে কারখানায় যাবেন বলে স্ত্রীকে জানিয়েছিল রুবেল। শুক্রবার রাতে আবার কথা বলবে বলেছিল। রাতে কলও দিয়েছিল মরিয়ম। কিন্তু ফোন বাজে কেউ রিসিভ করেনি। রাত নয়টা পর্যন্ত ফোন বেজেছে। এরপর ফোন আর বাজেনি। শনিবার সকাল ৮টার দিকে রুবেলের প্রবাসী বড় ভাই ফোন করে জানায় রুবেল মারা গেছে।  

তিন ভাইয়ের মধ্যে রুবেল সবার ছোটে। স্থানীয় দালালকে ১৬ কাঠা জমি লিখে দেওয়া ছাড়াও দেড় লাখ টাকা নগদ দিয়ে ২০১৬ সালে সৌদি আরব পাড়ি জমান রুবেল। তার বড় দুইভাই আগে থেকেই প্রবাসী। বড়ভাই সৌদি আরব এবং মেজে ভাই দুবাই থাকেন।

বারইপাড়া গ্রামের শাহাদাত হোসাইনের একমাত্র ছেলে আরিফ হোসেন রুবেল সৌদি আরব যান আট মাস আগে। ২০১৬ সাল থেকে প্রবাসী চাচা সাজেদুল ইসলাম আরিফকে নিয়ে যান। কাজের ব্যবস্থা করেন একই কারখানায়। শুক্রবার আল আহসা শহরের হুফুফ শিল্প এলাকার ওই সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান চাচা-ভাতিজা। 

স্বামী হারিয়ে সাজেদুলের স্ত্রী শোকে পাথর হলেও ছেলে হারানোর শোক সইতে পারছে না আরিফের মা। এ শোক ক্যাম করে সইবো আরিফের মায়ের এই আর্তনাতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে বারইপাড়া গ্রামের বাতাস।

নিহত আরেকজন ফিরোজ আলী সরদারের বাড়ি পাশের গ্রাম মাধাইমুরি। তিনি আনিসুর রহমানের ছেলে। সাড়ে তিন বছর ধরে সৌদি আরবে রয়েছেন ফিরোজ। 

নিহত সাজিদুলের পরিবার

খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়ে নিহতের বাড়িতে যান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। 

উপজেলার ঝিকড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রবাসীদের গ্রাম নামে পরিচিত বারইপাড়া গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় দেড়শ’ প্রবাসী রয়েছে। সচ্ছল প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকে প্রবাসী রয়েছে। 

তিনি বলেন, চার প্রবাসীর মৃত্যুতে শুধু পরিবারের ক্ষতি তা নয়। এটি দেশেরও ক্ষতি। আমরা চাই নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হোক। এছাড়াও নিহতদের পরিবার যেন ক্ষতিপূরণ পায় সে ব্যাপারে যেন সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

নিহতদের বাড়িতে গিয়ে লাশ ফেরত আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত চলতি দায়িত্ব) সুমন চৌধুরী। তিনি বলেন, লাশ নিয়ে আসার জন্য একটি ফরম পুরণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। সে কাজটি আমরা দ্রুত করবো। এ ক্ষেত্রে যত সহযোগিতা দেয়ার প্রয়োজন আমরা দিব।

উল্লেখ্য, শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ হতে ৩৫০ কিমি পূর্বে অবস্থিত আল আহসা শহরের হুফুফ শিল্প এলাকায় একটি সোফা কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৯ বাংলাদেশি ও ১ ভারতীয়সহ মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ২ জন।
 
এএইচ


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি